কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে বিদ্রোহী তথা জাতীয় কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক সর্বোপরি সৈনিক হিসেবে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন যা বিশ্ব ইতিহাসে আজ ও স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছে। নজরুল কে ‘ বিদ্রোহী কবি ‘ বলা হয় একথা সত্য। কিন্তু মনের গহীনে এই প্রশ্ন উঁকি মারে, কার বিরুদ্ধে তাঁর এই বিদ্রোহ কিংবা জেহাদ? লিখেছেন এম ওয়াহেদুর রহমান
কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে বিদ্রোহী তথা জাতীয় কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক সর্বোপরি সৈনিক হিসেবে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্ৰাম করেছেন যা বিশ্ব ইতিহাসে আজ ও স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছে। নজরুল কে ‘ বিদ্রোহী কবি ‘ বলা হয় একথা সত্য। কিন্তু মনের গহীনে এই প্রশ্ন উঁকি মারে, কার বিরুদ্ধে তাঁর এই বিদ্রোহ কিংবা জেহাদ? আসলে যেখানেই তিনি দেখেছেন মানবতার লাঞ্ছনা, দেখেছেন ধর্মের ছদ্মবেশে মানবিক অধিকার হরণ, যেখানে শোষণ - শাসন ত্রাসের নির্বাধ বিস্তার, অসাম্যের নির্লজ্জ উদ্ধত আস্ফালন, যেখানে সাম্রাজ্য বাদী শক্তির উল্লাস মত্ততা, পরাধীনতার নাগপাশ বন্ধন ; সেখানেই তিনি বিদ্রোহ করেছেন। তাঁর শুভবোধ আমাদের চিন্তা ভূবনে তাই প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলে এক অনাবিল বিলোড়ন। আর আমরা যেন উদভ্রান্তের মতো আশ্রয় খুঁজতে থাকি নজরুলের সাহিত্য দর্শনে, শিল্পদর্শনের ইতিবাচক প্রহরের বিস্তৃত পরিসরে। ক্রান্তি - সংকটের সময়ে নজরুল আমাদের আরো অধিকতর প্রাসঙ্গিক এবং নমস্য। কেননা তাঁর চিন্তা ধারার মূল কথা হলো আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি। তাই তিনি লিখেছেন- “কাটায়ে উঠেছি ধর্ম- আফিম নেশা / ধ্বংস করেছি ধর্ম যাজকী পেশা, / ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত, / এক মানবের একই রক্ত মেশা / কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা !”
তিনি আরো বলেছেন--“মানবতার এই মহান যুগে একবার / গন্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, /তুমি ব্রাম্মন নও, শুদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমান নও / তুমি মানুষ - তুমি ধ্রুব সত্য। ”নজরুল ও তাঁর সাহিত্য সমকালের হয়ে ও সর্বকালের। তাঁর কবি প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁরই স্বীকারোক্তি”আমি সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখ ভরা জল ও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে তাঁকে ক্ষুধাজীর্ণ মূর্তিতে ব্যাথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধ ভূমিতে তাকে দেখেছি, অন্ধকূপে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি। ”ব্রিটিশ সরকারের চোখে রাজদ্রোহের অপরাধে বন্দি নজরুল কোর্টের কাঠ গড়ায় দাঁড়িয়ে জবানবন্দির এক স্থানে বলেছিলেন”আমি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই, আমি অন্যায়ের পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি ...... আমার বাঁশী কেড়ে নিলেই বাঁশির সুরের মৃত্যু হয় না। কারণ আমি আর এক বাঁশি নিয়ে বা তৈরি করে তাতে সেই সুর বা ফুঁ দিতে পারি। সুর আমার, বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং বাঁশির সৃষ্টি কৌশলে ও আমার সাহিত্যে । “সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষের বিপরীতে তিনি সম্প্রীতির প্রত্যাশায় উচ্চ কণ্ঠ ছিলেন। একই সঙ্গে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে ধর্ম, শিক্ষা ও সমাজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ও তাঁর ভাবনা সমূহ গুরুত্ব বহন করে। উপনিবেশ কে আঁকড়ে রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল ভারতের দুই বৃহৎ সম্প্রদায়ের মাঝে। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুল কে ব্যাথিত করেছিল। তাই তিনি উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে সম্প্রীতি তুলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ---- “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু - মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন মনি / হিন্দু তাহার প্রাণ। ”“কান্ডারী ! ‘ হিন্দু না মুসলিম? ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন? / কান্ডারী ! বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র। ”“এসো ভাই হিন্দু ! এসো মুসলমান ! এসো বৌদ্ধ ! এসো ক্রিশ্চিয়ান ! / আজ আমরা সব গন্ডী কাটাইয়া, / সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া / প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি। ”“এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ / সজিব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান গোরস্থান। ”“খালেদ আবার ধরিয়াছে আসি, অর্জুন ছোঁড়ে বাণ / জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু- মুসলমান। ”
নজরুলের সাহিত্য সাধনার মূল প্রতিপাদ্যই বিষয় ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন তৈরি করা যাতে সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মানুষ এক হয়ে একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে পারে। মানুষ ও মানবতার জন্য একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল নজরুল সাহিত্য- নির্ভর আরাধনা। সেই আরাধনা কে সামনে রেখেই তিনি গেয়েছেন সাম্যের গান। তাই তিনি বলেন -”গাহি সাম্যের গান - মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!/ নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, / অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। ”তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য যেমন লিখেছেন ইসলামী কবিতা, ইসলামী গান, হামদ, না’আত। আবার একই সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য লিখেছেন দেব - দেবী নিয়ে গান, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত। তিনি লিখেছেন নাতে রাসুল --“তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/ মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে/ যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে। ”ঠিক একই ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় দেবী মা - কালী কে নিয়ে লিখেছেন ---“আমার কালো মেয়ের পায়ের নীচে/ দেখে যা আলোর নাচন, / মায়ের রুপ দেখে বুক পেতে শিব / যার হাতে মরণ বাঁচান, / আমার কালো মেয়ের আঁধার কোলে/ শিশু রবী শশী দোলে। ”সুতরাং যেখানে মানবতা প্রায় ভূলুণ্ঠিত, পরমতসহিষ্ণুতা, হিংসার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত, সেখানে নজরুলের জীবন ও সৃষ্টি এবং এর মিথস্ক্রিয়ায় উঠে আসা দর্শন দেখাতে পারে মানবপ্রেমের সুনিগ্ধ জলপ্রপাত, পরমতসহিষ্ণুতার বাতায়ন, সৌহার্দ্যের অমিয় ধারা। তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং সাহিত্যের জগতে ও হিন্দু - মুসলিম বিভাজন যখন ছিল সুস্পষ্ট, সম্পর্ক ছিল শীতল ও বৈরী, তখন নজরুল তাঁর জীবনাচরণ ও সাহিত্যের মাধ্যমে বিবাদমান দুই সম্প্রদায়ের মাঝে মিলনের সেতুবন্ধন রচনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রতিটি রচনায় উদারতা, সাম্য - মৈত্রী, আদল - ইনসাফ, এবং ঐক্য - সংহতিরই আওয়াজ বারংবার প্রতিফলিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের প্রাণান্তকর সংগ্ৰাম, সাম্য ও মুক্তির বাণী আজকের দিনে ও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি সম্প্রদায়গত বিভেদ - বিভাজন সর্বোপরি সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে যে কবিতা, গান, গল্প, নাটক প্রভৃতি রচনা করেছেন, তা মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, ভাতৃত্ব বোধ তথা মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct