বাংলার নবজাগরণ বলতে বোঝায় ব্রিটিশ রাজত্বের সময় অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার ও বহু কৃতি মনীষীর আবির্ভাবকে। মূলত রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) সময় এই নবজাগরণের শুরু এবং এর শেষ ধরা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সময়ে। যদিও এর পরেও বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ এই সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদীক্ষার জোয়ারের বিভিন্ন ধারার ধারক ও বাহক হিসাবে পরিচিত হয়েছেন। ঊনবিংশ শতকের বাংলা ছিল সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎদের এক অনন্য সমাহার যা মধ্যযুগের অন্ত ঘটিয়ে এদেশে আধুনিক যুগের সূচনা করে। তা িনয়ে সন্দর্ভটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার...
১১. চন্দ্রকুমার ঠাকুর (১৭৮৭-১৮৩২) - গোপীমোহন ঠাকুরের পুত্র , প্রসন্নকুমার ঠাকুরর ভ্রাতা চন্দ্রকুমার ঠাকুর দেশে শিক্ষাপ্রসারে উৎসাহী ছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি দেশীয় ভাষায় শিক্ষাপ্রসারেও আগ্রহী ছিলেন। দেশের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্যও তিনি আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকোচন করা হলে তিনি তার প্রতিবাদ (১৮২৩) করেন। ১৮২৭ সালে স্ট্যাম্প ডিউটির বিরুদ্ধেও আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন তিনি। এ ব্যাপারে পার্লামেন্টে যে দরখাস্ত পাঠানো হয়েছিল , তাতে সই করেন চন্দ্রকুমার। সিভিল কেসে ভারতীয় জুরি নিয়োগের আন্দোলনেও তিনি যোগ দেন।
দ্রঃ সংবাদপত্রে সেকালের কথা ( ১ম ও ২য় খণ্ড )। The Supplement to the Government Gazette ( 26th April -27th April -28th May , 1827) . The Calcutta Gazette ( 17th April, 1832)
১২. রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭?-১৮৫২) - সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার ও তুলাচাষের প্রস্তুতির জন্য রামদুলাল দে, রাধাকান্ত দেব , রসময় দত্তকে নিয়ে রাধামাধব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তবে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। কিন্তু এতে দমে যান নি। ব্যবসা ছিল তাঁর রক্তে। পিতা ফকিরচাঁদের উত্তরাধিকার নিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রুস্তমজির মতো ব্যাঙ্ক ব্যবসার উন্নতির চিন্তা করতেন। ১৮২৯ সালে জেনারেল ব্যাঙ্ক ও ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এরপর তিনি ভারত ও ইউরোপের মধ্যে জাহাজ চলাচলের ব্যবসার ( ১৮৩৩) পরিকল্পনা করেন, তবে এই পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয় নি। রাধামাধব ছিলেন হিন্দু কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। ছাত্রদের উন্নতিবিধানের চেষ্টা করেছেন। তবে ইংরেজির সঙ্গে মাতৃভাষাচর্চার গুরুত্বের কথা তিনি অনুভব করতেন। ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন হিন্দু কলেজ পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। গৌড়ীয় সমাজের ( ১৮২৩) মাধ্যমেও তিনি মাতৃভাষাচর্চার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন।
দ্রঃ সংবাদপত্রে সেকালের কথা (১ম ও ২য় খণ্ড )। সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র ( ২য় খণ্ড) / বিনয় ঘোষ। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।
১৩. রামলোচন ঘোষ ( ১৭৯০-১৮৬৬) - দেশে শিক্ষা প্রসারে রামলোচন নানাভাবে সাহায্য করেছেন। পাবলিক ইন্সট্রাকশন কমিটি ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি চালু করলে তিনি ১ হাজার টাকা দান করেন ,কৃষ্ণনগরে কলেজ তৈরির সময়ে (১৮৪৬) তিনি অর্থ সাহায্য করেন , নদিয়া জেলায় স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারেও যুক্ত ছিলেন তিনি , যুক্ত ছিলেন কৃষ্ণনগর শিক্ষা কমিটি ও পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে। মাতৃভাষা চর্চার ব্যাপারেও তাঁর উৎসাহ ছিল। তিনি প্রস্তাব করেন হিন্দু কলেজ পাঠশালার মতো ঢাকা কলেজেরও একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করা হোক। কিন্তু কাউন্সিল অব এডুকেশন সে প্রস্তাব মঞ্জুর করেন নি। ১৮৩৬ সালে যে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয় , রামলোচন ছিলেন তার সক্রিয় সদস্য। এই সভায় রাজনৈতিক আলোচনার সূত্রপাত করেন কালীনাথ রায় চৌধুরী ও রামলোচন ঘোষ। ১৮৩৬ সালে সরকার রাজস্বহীন জমি পুনরুদ্ধার করতে চাইলে রামলোচন ঘোষ তাকে সমর্থন করেন। এতে অনেকে অসন্তুষ্ট হলেও তাঁর যুক্তি ছিল এতে জমিদাররা আলস্য ও আরাম ত্যাগ করে উপার্জনে উদ্যোগী হবে।
দ্রঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা / যোগেশচন্দ্র বাগল। মুক্তির সন্ধানে ভারত / ওই। Freedom Movement in Bengal / (edt) Nrimal Sinha .
১৪. রুস্তমজি কাওয়াসজি (১৭৯২-১৮৫৪) - জন্মসূত্র মুম্বাইএর মানুষ হলেও রুস্তমজি কলকাতায় আসেন ব্যবসার সূত্রে। ভারেত অর্থনৈতিক জাগরণের অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি। যৌথ কারবারের পথপ্রদর্শক তিনি। তাঁর কোম্পানি ‘রুস্তমজি , টার্নার অ্যান্ড কোং’। সম্ভবত দ্বারকানাথ ইংরেজদের সঙ্গে যৌথ কারবারের প্রেরণা পেয়েছিলেন এখান থেকেই। বিমা, ব্যাঙ্ক ও জাহাজ ব্যবসার উন্নতি সাধন করেন তিনি। বিমা ব্যবসা জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারে মনে করে তিনি ১৮২৮ সালে ইউনিয়ন ইনসিউরেন্সে কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হন। অন্যান্য ইনসিউরেন্স কোম্পানি , যেমন দ্য লভেবল সোসাইটি (১৮৩৩), দ্য সান লাইফ কোং (১৮৩৪) , দ্য নিউ ওরিয়েন্টাল লাইফ ইনসিউরেন্স কোং ( ১৮৩৫), দ্য ইন্ডিয়ান ব্রাঞ্চ অব দ্য ইউনিভার্সাল লাইফ ইনসিউরেন্স কোং (১৮৩৫) প্রভৃতিরও শেয়ার ছিল তাঁর। সরকার বিমা ব্যবসায় নামতে চাইলে বেসরকারি উদ্যোগ মার খাবে বলে দ্বারকানাথের সঙ্গে তিনিও প্রতিবাদ করেন।১৮৩৭ সালে তিনি ডকিং কোমাপানির সঙ্গে যুক্ত হন। খিদিরপুর ও শালকিয়ায় তৈরি হত তাঁর জাহাজ। ১৮৪৪ সালে তিনি ইন্ডিয়ান স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির ডাইরেক্টর নিযুক্ত হন। দেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রেও তাঁর উদ্যোগ ছিল , যেমন ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে , ৪জন ছাত্রকে ডাক্তারিবিদ্যা শিক্ষার জন্য বিলেতে পাঠানোয় , কলকাতা মেডিকেল কলেজের সেরা ছাত্রকে স্বর্ণপদক দানে , এগ্রি হর্টিকালচারাল সোসাইটি ও এশিয়াটিক সোসাইটিকে আর্থিক সাহায্য দানে, কলকাতার নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিষ্ঠার চিন্তায়।
দ্রঃ উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা / যোগেশচন্দ্র বাগল। Supplement to the Government Gazette of 26th April 1827
১৫. মতিলাল শীল (১৭৯২-১৮৫৪) - আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসায় বিরাট সাফল্য লাভ করেছিলেন মতিলাল শীল। জাহাজি শিল্পেও আত্মনিয়োগ করে তিনি বিদেশিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। আন্তর্দেশীয় জাহাজি ব্যবসায় প্রথম বাষ্পীয়পোত ব্যবহার করেন। জনহিতকর নানা কাজে তিনি অকাতরে অর্থসাহায্য করতেন। হিন্দু চ্যারিটেবল ইন্সটিট্যুশন, হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ, কলকাতা মেডিকেল কলেজ লাভ করেছিল তাঁর সাহায্য। ‘ধর্মসভা’র নেতৃস্থানীয় সদস্য হলেও বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করেছিলেন।
দ্রঃ সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। Traders and Trades in Old Bengal / Sabyasachi Bhattacharya . History of Vaisyas of Bengal / Pramatha Nath Mullick
১৬.দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) – দক্ষতার সঙ্গে পৈত্রিক সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও নতুন জমিদারি ক্রয় , ধনী জমিদারদের আইনি এজেন্ট হিসাবে কাজ ইত্যাদির পাশাপাশি দ্বারকানাথ এ দেশে আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পথিকৃৎ। তাঁর অভিমত ছিল ব্রিটিশের সম্পদ শোষণ বন্ধ করতে হলে জমিদারদের ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তিনি অনুধাবন করেছিলেন পুঁজি , প্রযুক্তি কৌশল ও নব উৎপাদন পদ্ধতি ব্যবসার সমৃদ্ধি ঘটাতে পারে।দ্বারকানাথের উদ্যোগে ১৮২৯ সালে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ও ১৮৩৪ সালে কার টেগোর অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপে রেশম ও নীলের রপ্তানি , রানিগঞ্জে কয়লাখনি ক্রয় , রামনগরে চিনির কারখানা , খিদিরপুরে জাহাজ নির্মাণ , কামারকলিতে গুটি থেকে রেশম নিষ্কাশন , শিলাইদহে নীল কারখানা স্থাপন তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের নিদর্শন। ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য তাঁকে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের সদস্য করা হয়। দ্বারকানাথ ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত মানুষ। তাই তিনি রামমোহনের সহযোগী হয়ে ওঠেন সতীদাহ বন্ধ করার আন্দোলনে। । পশ্চিমের উদারনৈতিক শিক্ষাপ্রসার তাঁকে প্রাণিত করেছিল। হিন্দু কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি , কলকাতায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোগ , চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নে উৎসাহ দিয়েছিলেন ছাত্রদের। মধুসূদন গুপ্তসহ প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের শবব্যবচ্ছেদে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ১৮৪৫ সালে দ্বিতীয়বার বিলাত যাত্রার সময়ে ভোলানাথ বসু , গোপাললাল শীল , সূর্যকুমার চক্রবর্তী , দ্বারকানাথ বসু – এই চারজন মেডিকেল কলেজের ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে যান।মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা আন্দোলনে , সুপ্রিম কোর্টের দেওয়ানি বিভাগে এ দেশের মানুষদের জুরি মনোনীত করার আন্দোলনে , ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করে দেশীয়দের সেই পদে নিয়োগের দাবিতে তিনি সোচ্চার ছিলেন। অনাদায়ী খাজনার জন্য জমিদারি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ল্যাণ্ডহোলডার্স সোসাইটি যে আন্দোলন করে , তিনি তার পুরোভাগে ছিলেন। এদেশে সঠিকভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনার জন্য তিনি বিলাত থেকে জর্জ টমসনকে নিয়ে আসেন।
দ্রঃ ঠাকুরবাড়ির কথা / হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বারকানাথ : পরাধীন দেশের রাজপুত্র। মুছে দাও দ্বারকানাথকে / রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বারকানাথের মৃত্যুমুখোশ / অনিরুদ্ধ সান্যাল। Dwarakanath / Krishna Kripalani , Memoir of Dwarakanath Tagore / Kissory Chand Mitra . Life of Dwarakanath Tagore / Sreenath Banerjee .
১৭. কালীনাথ রায় চৌধুরী (১৭৯৭-১৮৪০) – ইংরেজি , সংস্কৃত ও পারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। রামোহনের প্রভাব তাঁর উপর পড়েছিল। তিনি যোগদান করেন ব্রাহ্মসমাজে। অংশগ্রহণ করেন সতীদাহবিরোধী আন্দোলনে। এ সবের জন্য রক্ষণশীল সমাজ তাঁকে বর্জন করেন। তরুণদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮৩২ সালে সহোদর বৈকুণ্ঠনাথের সহযোগিতায় টাকি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আর্থিক সাহায্য দান করেন হিন্দু বেনাভোলেন্ট ইন্সটিট্যুশন , হিন্দু ফ্রি স্কুল , বরানগর ইংলিশ স্কুলকে। মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন। কালীনাথ বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সে সভায় কোন ধর্মীয় আলোচনা না করার যে প্রস্তাব গৌরীশংকর তর্কবাগীশ উথ্থাপন করেন , তা সমর্থন করেন কালীনাথ।
দ্রঃ বঙ্গীয় সমাজ / সতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী। Freedom Movement in Bengal / Nirmal Sinha (edt.)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct