লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের ওসমানীয় শাসনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির শত বছর পূর্তির পর প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী ১৪ মে। দৃশ্যত দুই দশক ক্ষমতায় থাকার পর, এরদোগানের শাসন অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হতে পারে। তবে একই সাথে এরদোগানের সামনে দেশ বিদেশের শক্তিসমূহের যুগপৎ আয়োজন কঠিন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করতে পারে। ছয়টি প্রধান বিরোধী দল এরদোগানের জোটকে হারানোর জন্য একক প্রার্থী দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
ক্ষমতাসীন একে পার্টির সরকারের বৈদেশিক নীতিকে ‘যৌক্তিকতার বিপরীতে আদর্শগতভাবে’ আচরণ করার অভিযোগ করে, বিরোধী জোট আন্তর্জাতিকভাবে ‘পক্ষ বেছে না নেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে সঙ্কটের মুখে কৌশলগত নিষ্ক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। সাইপ্রাস দ্বীপ, এজিয়ান সাগর, পূর্ব ভূমধ্যসাগর, আজারবাইজান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে তুরস্কের সম্পর্কসহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ বিবৃতি খুঁজে পাওয়া যায় না। তদুপরি, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান, এশিয়ার জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা এবং তুরস্ক-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করা ইতোমধ্যেই বর্তমান সরকারের এজেন্ডায় রয়েছে। তুর্কি বিশ্লেষক দুরানের মতে, বিরোধী জোট এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা সরকার এর মধ্যে করেছে বা করছে। এরদোগান নিজেও তার বক্তব্যে এ কথা বলেছেন। বিরোধী ব্লকের ‘সমতার ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির’ অঙ্গীকার একে পার্টির অধীনে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার মূল কারণ। ৬ দলের জোট বলেছে, ‘আমরা রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে সমতা বোধের সাথে এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক অব্যাহত রাখব।’ এর সাথে বর্তমান নীতির পার্থক্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিরোধী পক্ষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনীতি একাডেমি চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে - যা ইতোমধ্যেই বিদ্যমান। বিরোধী দলগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন পিকেকের নাম উল্লেখ না করে একটি সাধারণ শব্দ ব্যবহার করেছে, সন্ত্রাসবাদ।
বিদেশী নীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিরোধীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং স্পষ্টতার অভাব সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এই অর্থে, বিরোধী দলের সম্ভাব্য প্রার্থীর লিবিয়া, সিরিয়া, পিকেকের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন, এর সিরিয়ার সহযোগী সংগঠন ওয়াইপিজি এবং গুলেনবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ সম্পর্কে কথা বলা সবচেয়ে কঠিন হবে। এসব নিয়ে পশ্চিমের সাথে সরকারের যথেষ্ট উত্তেজনা রয়েছে। বিপরীতে, পিপলস অ্যালায়েন্স ‘তুর্কিয়ের শতাব্দী’ উন্মোচন করেছে যেখানে ভবিষ্যতের জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি, পররাষ্ট্র নীতি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা রয়েছে। অধিকন্তু, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কূটনৈতিক সাফল্য ভোটারদের প্রশংসা অর্জন করেছে। অবশ্যই, পররাষ্ট্র নীতি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষায় সরকারের সাফল্য ভোটারদের ওপর ন্যূনতম প্রভাবশালী বলে মনে হতে পারে। অনেকে মনে করছেন, একটি অস্পষ্ট বৈদেশিক নীতির দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে বিরোধী গ্রুপ স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছে যে এই জোট এরদোগানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। ডেমোক্রেসি অ্যান্ড প্রগ্রেস পার্টি চেয়ারপারসন আলী বাবাকান গর্বিতভাবে বলেছেন যে, তাদের নীতি দলিল ইউরোপীয়দের প্রকাশ্যে স্বীকার করতে প্রভাবিত করবে যে বিরোধীদের প্রধান উদ্বেগ পশ্চিমের মতো অভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমা মিডিয়ায় তুরস্ক সম্পর্কে ছাপানো বিভিন্ন সমালোচনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিরোধীরা তুর্কি পররাষ্ট্র নীতির জন্য ক্ষমা চেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে এরদোগানের তুরস্কের পশ্চিম থেকে দূরে সরে যাওয়া, ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করা, এর প্রতিবেশী অঞ্চলে কঠোর শক্তি ব্যবহার করা এবং এর বৈদেশিক নীতির সামরিকীকরণের মতো বিষয়।
বিরোধীদের বিশ্বাস যে তুরস্ক শুধুমাত্র আলোচনার মাধ্যমে পশ্চিমের সাথে উত্তেজনা কমাতে পারে। বিপরীতে, এরদোগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক তার সমকক্ষদের সাথে আলোচনায় দুই দশকের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সমতার প্রতি এরদোগানের প্রতিশ্রুতির কারণে তুরস্ক তার মিত্রদের সাথে উত্তেজনা অনুভব করে। স্পষ্টতই, তুরস্ক পিকেকে এবং গুলেনপন্থীদের আশ্রয় দেওয়া দেশগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে। সরকার এজিয়ান এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিসের সর্বোচ্চ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। সিরিয়া এবং লিবিয়াতে, এটি তার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রক্ষার জন্য কঠোর শক্তির আশ্রয় নিয়েছে। সব প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে এরদোগান নেতা থেকে নেতার কূটনীতিতে যুক্ত হন। আন্তর্জাতিক সংকটের মুখে, তিনি তার বিশাল অভিজ্ঞতার সাহায্যে নিজেকে একজন নেতা হিসাবে আলাদা করে তুলে ধরেছেন। দুরান মনে করেন, যারা বর্তমানে পশ্চিমাদের বলছে যে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পশ্চিমাদের পাশে থাকতে চায়, তারা একটি বিপজ্জনক খেলা খেলছে। পশ্চিমের সাথে সম্প্রীতির নামে তুর্কি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে ক্ষুণ্ণ করা হলে জ্বালানি ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে। তা না করা হলে, পশ্চিমা জোটকে নতুন তুর্কি বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তুরস্কে জোট সরকারের রেকর্ড খুব বেশি শক্তিশালী নয়। ১৯৫০ সালে তুরস্কের বহুদলীয় গণতন্ত্রে রূপান্তরের পর থেকে কোনো জোট সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। এ কারণে রাজনৈতিক স্থিতি এবং অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতার প্রতি তুর্কিরা এবার গুরুত্ব দিতে পারে। এর পাশাপাশি তুরস্কের বর্তমান নেতৃত্ব নিজস্ব শক্তিমত্তা সৃষ্টির যে পররাষ্ট্র কৌশল নিয়েছে সেটির প্রতি বৃহত্তর তুর্কি জনগোষ্ঠীর সমর্থন লক্ষ করা যায়। এছাড়া তুরস্কের প্রতিবেশী দেশগুলো এবার মধ্যপ্রাচ্যে শাসন পরিবর্তনে পাশ্চাত্যের টুলস হিসাবে ব্যবহার হবে বলে মনে হচ্ছে না। এসব বিবেচনায় এরদোগানের সামনে প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে সফলভাবে নতুন নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ উত্তরণের। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct