লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের ওসমানীয় শাসনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির শত বছর পূর্তির পর প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী ১৪ মে। দৃশ্যত দুই দশক ক্ষমতায় থাকার পর, এরদোগানের শাসন অনেক পর্যবেক্ষকের কাছে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হতে পারে। তবে একই সাথে এরদোগানের সামনে দেশ বিদেশের শক্তিসমূহের যুগপৎ আয়োজন কঠিন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করতে পারে। ছয়টি প্রধান বিরোধী দল এরদোগানের জোটকে হারানোর জন্য একক প্রার্থী দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
জান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের ওসমানীয় শাসনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির শত বছর পূর্তির পর প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী ১৪ মে। দৃশ্যত দুই দশক ক্ষমতায় থাকার পর, এরদোগানের শাসন অনেক পর্যবেক্ষকের কাছে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হতে পারে। তবে একই সাথে এরদোগানের সামনে দেশ বিদেশের শক্তিসমূহের যুগপৎ আয়োজন কঠিন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করতে পারে। দেশটির ছয়টি প্রধান বিরোধী দল এরদোগান ও তার পিপলস জোটকে হারানোর জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একক প্রার্থী দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপ আমেরিকার গভীর ক্ষমতা বলয়ের একটি অংশও যে এই নির্বাচনে এরদোগানের শাসনের অবসান কামনা করছে তাতে সংশয়ের অবকাশ কমই। পশ্চিম ইউরোপে নতুন করে ইসলামফোবিয়া ছড়িয়ে তুরস্কবিরোধী হাইপ তৈরিসহ নানা আয়োজন বিষয়টিকে স্পষ্ট করে। আমেরিকান মিডিয়া ব্লুমবার্গ বলেছে, তুরস্কের এই নির্বাচন হবে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। জার্মান সরকারি মিডিয়ায় এরদোগানোত্তর সরকার কিভাবে গঠন করতে হবে তার রূপরেখা প্রকাশ করেছে। এতে ধারণা করা যায় তুরস্কে পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে নানা পক্ষ থেকে। নানা আয়োজন ও এরদোগান তুরস্কের এবারের নির্বাচন ঘিরে নানামুখী উদ্যোগ আয়োজন নিয়ে শাসক দল ও এরদোগান নিজে একেবারে অন্ধকারে রয়েছেন এমনটি মনে হয় না। তবে তার প্রতিপক্ষ দেশী বিদেশী শক্তিকে একসাথে এই মাত্রায় এর আগে মোকাবেলা করতে হয়নি এরদোগানকে। প্রতিপক্ষের ধারণা এটিই হবে প্রথম নির্বাচন অর্থনৈতিক মন্দা এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ফাটলে দুই দশকে যেখানে এরদোগান স্পষ্টভাবে ফেভারিট নন। বিরোধী জোটের এরদোগানের শাসক ব্লককে পরাজিত করার সম্ভাবনা থাকলেও তাদের বিজয় সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের একটি মসৃণ প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তা দেবে না। বিরোধীরা যদি এরদোগানকে পরাজিত করতে পারেন, তাহলে নতুন সরকারকে পশ্চিমা মিত্রদের ইচ্ছানুসারে তুরস্কের কূটনৈতিক কোর্স এবং অর্থনৈতিক নীতি পুনর্গঠন আর সংসদীয় শাসনে ফিরে যাওয়ার কঠিন কাজগুলো গ্রহণ করতে হবে। বিরোধী জোটের বৈচিত্র্যময় গঠনের কারণে, এই লক্ষ্যগুলো অর্জন করা নির্বাচনে জেতার মতো কঠিন হতে পারে। আর তুর্কি জনগণ বিদেশী হস্তক্ষেপে ক্ষমতার পরিবর্তন কতটা চাইবে সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ।
তুরস্কের উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধিজনিত ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) গত এক বছরে জনমত জরিপে নিম্নগামী প্রবণতার সম্মুখীন। এমনকি একেপির সাথে পিপলস অ্যালায়েন্সের অতি-জাতীয়তাবাদী অংশ এমএইচপি জোট হওয়া সত্ত্বেও, এরদোগান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভের জন্য প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ ভোট পেতে অসুবিধায় পড়ছেন বলে মনে হচ্ছে। বিপরীতে, বেশির ভাগ জনমত জরিপ অনুসারে, বিরোধী শিবিরের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা ওয়ান টু ওয়ান ম্যাচে এরদোগানকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মধ্য-বাম রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতৃত্বে বিরোধী শিবির, এরদোগানের শাসনামলে যেকোনো সময়ের চেয়েই বেশি ঐক্যবদ্ধ। একেপি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া দুটি দল-প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলুর ফিউচার পার্টি (জিপি) ও প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাবাকানের ডেমোক্রেসি অ্যান্ড প্রগ্রেস পার্টি (ডেভা) তুর্কি জাতীয়তাবাদী গুড পার্টি (আইয়িপি), ইসলামিস্ট ফেলিসিটি পার্টি (এসপি) এবং মধ্য-ডান ডেমোক্র্যাট পার্টি (ডিপি) নিয়ে গঠিত নেশন অ্যালায়েন্সের সাথে কাজ করছে। স্পষ্টতই, এরদোগান এতে লড়াই না করে দমে যাবেন না। বিরোধী দলগুলোকে মোকাবেলার জন্য তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন। শাসক ব্লকের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোতে বিশেষ প্রভাব রয়েছে। বিরোধী দলের জাতীয়তাবাদী ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার জন্য, এরদোগান কুর্দি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করতে পারেন, যার মধ্যে সাংবিধানিক আদালতের দ্বারা পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সম্ভাবনা থাকতে পারে। সে সাথে জনমত গড়ে তুলতে সিরিয়ায় আন্তঃসীমান্ত সামরিক অভিযান শুরু করতে পারে আঙ্কারা। সেই অভিযানের সম্ভাবনা অবশ্য আট দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করি ভূমিকম্পের পর বেশ খানিকটা কমে গেছে, যে দুর্যোগে তুরস্ক সিরিয়া মিলিয়ে ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কেউ কেউ ২০২৩ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে পিকেকের সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা করছেন। এ ধরনের আক্রমণগুলো জনসাধারণের মনোযোগ অর্থনীতি থেকে সন্ত্রাসের দিকে সরিয়ে নেয়, যার ফলে একটি জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় যা শাসক ব্লকের সমর্থন সৃষ্টি করতে পারে। এই ঘটনাগুলো এরদোগানের সমর্থনে জনমতের পতনকে স্থির করতে পারে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রত্যাশী বিরোধী দলের জোট বলেছে যে তারা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জিতলে তুরস্কের সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে। এটি হবে দেশটির নির্বাচন-পরবর্তী ভবিষ্যতের জন্য একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। তবে এটি ক্ষমতার একটি বৃহত্তর বিভাজনের পূর্বাভাস দেয়। সিএইচপি ছাড়াও ‘টেবিল অব সিক্স’ নামে পরিচিত বিরোধী জোট থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল কুর্দিপন্থী এইচডিপি বাদ পড়েছে। জানুয়ারির গোড়ার দিকে, সাংবিধানিক আদালত দলটির কোষাগারের অর্থ অবরুদ্ধ করে এবং নিষিদ্ধ পিকেকের সাথে সম্পর্কের কারণে দলটি নিষিদ্ধ হবার সম্মুখীন। ২০২৩ সালে অনেকগুলো সাধারণ নির্বাচন হবে। যার মধ্যে নাইজেরিয়ায় নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারিতে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি নিঃসন্দেহে হবে ১৪ মে তুরস্কে। ব্লমবার্গের মতে, তুর্কি নির্বাচনের ফলাফল ওয়াশিংটন এবং মস্কোর পাশাপাশি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার রাজধানীতে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হিসাব নিকাশে প্রভাব ফেলবে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ফেলো জিয়া মেরাল বলেছেন, ‘তুরস্কে যা ঘটে তা শুধু তুরস্কেই থাকে না। তুরস্ক একটি মধ্যম শক্তি হতে পারে, কিন্তু বৃহৎ শক্তিগুলোর তার নির্বাচনে অংশীদারিত্ব রয়েছে।’ পশ্চিমা নেতারা এরদোগানের বিদায় দেখে খুশি হবেন। পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ অনুসারে, এরদোগান রাশিয়ার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জনের মাধ্যমে ন্যাটোর নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করেছেন, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্যপদ অবরুদ্ধ করে ন্যাটো জোটকে হতাশ করেছেন, বারবার শরণার্থী দিয়ে ইউরোপকে প্লাবিত করার হুমকি দিয়েছেন এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গ্রিসের দিকে ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক বক্তব্য ছুড়েছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct