উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় ৬ হাজার ফুট উঁচুতে হিমালয়ের কোলে শৈল শহর জোশীমঠ অবস্থিত। গাড়োয়াল পাহাড়ের কোলে ছোট জনপদ এটি। জোশীমঠ নিয়ে ক্রমশ বেড়ে চলেছে উদ্বেগ! মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য প্রকৃতির রোষের শিকার উত্তরাখণ্ডের এই আস্ত পাহাড়ি শহর জোশীমঠ,এখন দ্রুত ডুবছে। জোশীমঠের মতো পরিস্থিতি যাতে রানিগঞ্জের ক্ষেত্রে না ঘটে সেজন্য যথাশীঘ্র সেখানকার কয়লাখনির ফাঁপা জায়গাগুলোতে বালি কিংবা মাটি দিয়ে ভরাট করার ব্যবস্থা করতেই হবে, নইলে বিপদ আসন্ন।। এ সম্পর্কে লিখেছেন আশিকুল আলম বিশ্বাস।
উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় ৬ হাজার ফুট উঁচুতে হিমালয়ের কোলে শৈল শহর জোশীমঠ অবস্থিত। গাড়োয়াল পাহাড়ের কোলে ছোট জনপদ এটি। জোশীমঠ নিয়ে ক্রমশ বেড়ে চলেছে উদ্বেগ! মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য প্রকৃতির রোষের শিকার উত্তরাখণ্ডের এই আস্ত পাহাড়ি শহর জোশীমঠ,এখন দ্রুত ডুবছে। ইসরো’র রিপোর্টে সামনে এসেছে আরও উদ্বেগজনক তথ্য। গত ১২ দিনে ৫.৪ সেন্টিমিটার নীচে বসে গিয়েছে জোশীমঠ। মূলত মধ্য জোশীমঠে ক্রমশ বসে যাচ্ছে মাটি। জোশীমঠ-আউলির রাস্তাও একইভাবে ধসছে। ভূমিধসের কারণেই ক্রমশ ফাটল ধরছে বিভিন্ন বাড়ি এবং রাস্তায়। ৭০০ এর বেশি বাড়িতে ফাটল ধরা পড়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জোশীমঠকে থাকার অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যাদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে তাদেরকে আপাতত বিভিন্ন সরকারি শিবিরে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের প্রিয়, স্মৃতি বিজড়িত ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। সরকারের পক্ষ থেকে আপাতত তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একের পর এক বাড়িতে ফাটল বাড়ছে। বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য হোটেল মালারি ইন ও মাউন্ট ভিউ, পাশাপাশি দুটি হোটেল ভাঙা শুরু হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে হোটেলের এক একটা তলা ধীরে ধীরে ভেঙে সরানো হচ্ছে। হোটেলের পিছনের দিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদেরও সরানো হয়েছে। এই তীব্র শীতে নিজের বাড়ি ছেড়ে ভয়ে রাস্তায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে পরিবারগুলি। জোশীমঠ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বহুগুনা নগরেও একাধিক বাড়িতে ফাটল ধরা পড়েছে। বিপজ্জনক বাড়িগুলিতে রেড ক্রস দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেখান থেকে বাসিন্দাদের সরানো হয়েছে। ২০২১ সালের হড়পা বানেও বহু ক্ষতি হয়েছিল এই এলাকার। মৃত্যুও হয়েছিল বহু মানুষের। ভূমিকম্পের সামান্য কম্পনও বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনতে পারে। গোটা শহরটাই ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে মাটিতে।জোশীমঠ শহরের সব ফাটল ধরা বাড়ি ভেঙে ফেলা শুরু করছে সরকার। আশপাশের এলাকায় ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে পুলিশ। উত্তরাখণ্ডের মুখ্য সচিব এসএস সান্দু বিপজ্জনক নির্মাণ ভেঙে ফেলার নির্দেশ জারি করেছেন। ৬৭৮টি নির্মাণে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। আরও ২৭টি পরিবারকে সরানো হয়েছে নিরাপদ স্থানে। চামোলিতে রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ৮২টি পরিবারকে সরকারি শেল্টারে সরানো হয়েছে। ২০০টি বাড়িকে বিপজ্জনক ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবারগুলিকে বলা হয়েছে, কোথাও বাড়ি ভাড়া নিতে। আগামী ৬ মাস তাঁদের জন্য ৪ হাজার টাকা করে বাড়িভাড়া বাবদ দেবে রাজ্য সরকার।
১৯৩৯ সালে প্রথম বার এই জনপদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ওঠে। তার পর কেটে গিয়েছে ৮৪ বছর। ২০০৯-এর ২৪ ডিসেম্বর জোশীমঠের কাছেই এক পাহাড়ের পেটে আচমকা থমকে যায় একটি সুড়ঙ্গ খোঁড়ার যন্ত্র। কারণ, সামনে হাজার হাজার গ্যালন জল। মাসের পর মাস কেটে গেলেও জলের স্রোত কমেনি। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, মানুষের তৈরি যন্ত্র প্রকৃতির তৈরি একটি বিরাট জলভাণ্ডারে ছিদ্র করে দিয়েছে। সেই ছিদ্র দিয়ে বেরোচ্ছে হাজার হাজার গ্যালন জল। একটি হিসাব অনুযায়ী, দীর্ঘ সময় ধরে দৈনিক ৬ থেকে ৭ কোটি লিটার জল সেখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। একটা সময় নিঃশেষ হয়ে যায় সেই বিপুল জলভাণ্ডার। এর ফলে এলাকার যত ছোটখাটো ঝর্না ছিল, সবই শুকিয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ওই বিপুল জলভাণ্ডার শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে এলাকার মাটি শুকিয়ে যায়। তা হয়ে যায় ঝুরঝুরে, ফাঁপা। ফলে পাহাড় ভাঙার ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে থাকা জোশীমঠের ধ্বংস শুধু সময়ের অপেক্ষা। ১৯৭৬ সালে এমসি মিশ্রের সভাপতিত্বে ১৮ সদস্যের কমিটি সমীক্ষা রিপোর্টে স্পষ্ট করে বলা বলেছিল, প্রাকৃতিক ও মানুষের কর্মকাণ্ডের জেরে জোশীমঠের স্থায়িত্ব বড়জোর ১০০ বছর। কমিটির সেই সতর্কবার্তা ও সুপারিশকে গুরুত্ব দেয়নি উত্তরাখণ্ড সরকার। ধাপ কেটে, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তৈরি করেছে রাস্তাঘাট। গড়ে তুলেছে নতুন জনবসতি। রিপোর্ট বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে অন্তত ১২৮টি ধসের মুখে পড়েছে চামোলি-জোশীমঠ এলাকাটি। ২০২১ সালে উত্তরাখণ্ডের চামোলিতে কাদা-ধসের বন্যায় তলিয়ে গিয়ে প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তখন থেকেই জোশীমঠের বাড়িগুলিতে বড় বড় ফাটল নজরে আসতে শুরু করে। কিন্তু, তারপরেও প্রশাসনের টনক নড়েনি। জোশীমঠের পরিস্থিতি নিয়ে ইতিমধ্যেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বারবার এলাকায় যাচ্ছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী। জোশীমঠের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির জন্য ৪৫ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী। জোশীমঠের মতো অবস্থা হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের রানিগঞ্জেরও,এমনই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রানিগঞ্জ নিয়ে তাঁর আশঙ্কা অমূলক নয় বলে জানালেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিশেষজ্ঞরাও।
রানিগঞ্জের বিধায়ক তথা আসানসোল-দুর্গাপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটি-র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরিস্থিতির জন্য আদতে কেন্দ্রের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। ওই বিধায়কের মতে, “ধস-প্রবণ রানিগঞ্জের উন্নয়ন সহ পুনর্বাসনের জন্য ২৬০০ কোটি টাকার প্রকল্পের ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। কিন্তু, তার মধ্যে কয়েক দফায় ১৫০ কোটির মতো টাকা দিয়েছে। তাই এই টাকায় কিছু কাজ করা সম্ভব হয়নি।” অবিলম্বে রানিগঞ্জের পরিত্যক্ত কয়লা খনিগুলি ভরাট করা না হলে এখানেও জোশীমঠের মতো বিপর্যয় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম বিশ্বাসও। রানিগঞ্জে কেন জোশীমঠের ছায়া? রানিগঞ্জ কেন ধস-প্রবণ হয়ে উঠেছে, তা বিশদে বিশ্লেষণ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম বিশ্বাস। তিনি বলেন, “কোলিয়ারি অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ কয়লা তুলে নেওয়ার পর সেখানে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সেই শূন্যতা বালি বা মাটি দিয়ে ভরাট করা জরুরি। কিন্তু, আদতে সেটা করা হয় না। ভূ-পৃষ্ঠের নীচে গভীর শূন্যতা থাকলেও সেটা উপর থেকে বোঝা যায় না। ওই খনি অঞ্চলের উপর বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে, খেলার মাঠ, রেললাইন রয়েছে। নীচে শূন্যতা এবং উপর থেকে ক্রমাগত চাপ বাড়ার ফলেই ভূমিধস নামে, বাড়িতে ফাটল ধরে। রানিগঞ্জে এই পরিস্থিতিই হয়েছে।” তাই কয়লা উত্তোলনের পর শূন্যস্থান পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি। তারপর ভূমিধস হলেও সেটা ছোট আকারে হবে, জোশীমঠের পরিস্থিতি হবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি। জোশীমঠের মতো পরিস্থিতি যাতে রানিগঞ্জের ক্ষেত্রে না ঘটে সেজন্য যথাশীঘ্র সেখানকার কয়লাখনির ফাঁপা জায়গাগুলোতে বালি কিংবা মাটি দিয়ে ভরাট করার ব্যবস্থা করতেই হবে, নইলে বিপদ আসন্ন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct