নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন এমন এক মানসিক বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করেছেন, যার অভাব রয়েছে অনেকের মধ্যে। তিনি আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার একটি ভিন্ন উপায় দেখিয়ে দিলেন। জীবনের সবচেয়ে কঠিন জিনিসগুলোর মধ্যে একটি হল কখন থামতে হবে তা জানা। জেসিন্ডা আরডার্ন এক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিলেন। তিনি এই থামতে জানাটাকে প্রায় সহজ করে তুললেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে লিখেছেন গ্যাবি হিন্সলিফ। আজ শেষ কিস্তি।
তিনি যে পরিস্থিতিতে চলে যাচ্ছেন, তা-ও আমাদের স্বীকার করতে হবে। কারণ এক জরিপে দেখা যায়, গত মাসে তার শাসনামলের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ২০১৭ সালে নেতা হওয়ার পর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি তিনি আর কখনো হননি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এটা একটা রেকর্ড। অন্য সবার মতো, নিউজিল্যান্ডবাসী বর্তমানে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে দিন যাপন করছে। জরিপের ফলাফল বলছে, তার দলটিকে এবারের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে বেশ বেগ পেতে হবে। করোনা মহামারির মধ্যেও তিনি ভেঙে পড়েননি। এই সময় আরডার্নকে একটি কঠোর শূন্য কোভিড নীতি অনুসরণ করতে হয়। এই সাহসিকতা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দেশে-বিদেশে তার প্রতি সম্মান জানানো হয়। তার বলিষ্ঠ নীতির কারণেই তার দেশে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পায় ঈর্ষণীয়ভাবে। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তিনি নতুন পৃথিবীর এই একবিংশ শতকের যথার্থ ভূমিকা পালন করেছিলেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। কোভিড ঝড়ের মুখোমুখি হওয়ার সময় নিউজিল্যান্ডবাসীকে ‘শক্তিশালী ও সদয় হতে’ আবেদন জানিয়েছিলেন। তিনি একজন নরম ও সহানুভূতিশীল আদর্শের বাহক হয়ে মডেল নেতৃত্বের অধিকারী হয়ে ওঠেন। বিশ্ব জুড়ে প্রগতিশীলরাও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কেননা, যে কোনো মূল্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে তিনি মানুষের উন্নতমানের জীবনযাপন ও সুখের সাধনাকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেন।
কিন্তু অন্যান্য দেশ কোভিড-পরবর্তী সময়ে অচলায়তনের দ্বার খুলতে শুরু করলেও নিউজিল্যান্ড আরো সতর্কতাস্বরূপ তা করেনি। এতে দেশটির জনগণ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ক্রমবর্ধমান অপরাধ, ক্রমাগত আবাসন সংকট এবং একের পর এক ক্ষুব্ধ অ্যান্টি-ভ্যাক্সার প্রতিবাদ দেশের সংসদের বাইরে হিংসাত্মক সংঘর্ষে রূপ নেয়। এখন মাথা নত করে তিনি সম্ভবত স্বীকার করছেন যে, তিনি কেবল তার নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু এই শরৎকালে তার দলের ক্ষমতা ধরে রাখার সর্বোত্তম সুযোগ হতে পারে এমন একজন নেতার অধীনে দেশ পরিচালনা করা, যিনি গত কয়েক বছর ধরে তার নিজের শক্তি জমা করেছেন। ক্ষমতা থেকে সরে যেতে একজন মানুষের কি আত্মসচেতনতা থাকতে পারে? মার্গারেট থ্যাচার শেষ অবধি নির্মমভাবে লড়াই করেছিলেন বলে উত্তর দেওয়ার জন্য এটি একটি জটিল প্রশ্ন। কিন্তু এই স্তরে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হলে অহংবোধের সতেজ অভাবের প্রয়োজন হয়। সম্ভবত ব্রিটিশ শ্রমমন্ত্রী এস্টেল মরিসের ২০ বছর আগে শিক্ষাসচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে এই ঘটনার দারুণ মিল আছে। কারণ তিনি সে সময় নিজেকে যথেষ্ট উপযুক্ত বলে মনে করেননি। তিনি অনুমান করেন, নিকোলা স্টার্জন পরবর্তী নির্বাচনে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টিকে নেতৃত্ব না-ও দিতে পারেন। যা হোক, সুন্দরভাবে আরডার্নের বিদায় কার্যকর করা যেতে পারে, তবু একজন নারীর প্রস্থান উদ্যাপনের বিষয়ে কিছুটা অস্বস্তিকর বিষয় রয়েছে বৈকি। কেননা, আরডার্ন এত দিন ধরে যে ধরনের অপমানজনক ব্যবহার ও জীবননাশের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন, তা অনেকের অজানা নয়। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালীন সন্তান জন্মদানকারী দ্বিতীয় নারী নেত্রী তিনি। তিনি কারো কারো কাছে একজন আদর্শ নেত্রী বলে অন্যদের কাছে টার্গেট ছিলেন। তিনি কীভাবে অফিসে সকালের অসুস্থতা বা মাতৃত্বকালীন ছুটি মোকাবিলা করেন এবং অন্যের আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে তুলে অফিস করেছেন, তা-ও আমাদের অজানা নয়। তিনি তার জীবনসঙ্গী ক্লার্ক গেফোর্ডের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি করেছিলেন যে, তিনি প্রাথমিকভাবে তাদের মেয়ের দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতেই থাকবেন। এটি এমন একটি কাজ, যা শক্তিশালী পুরুষেরা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে অনাদিকাল থেকে শেয়ার করে আসছেন। আবার এটি এমন একটি কাজ, যার জন্য নারীদের আরো সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়। তবে এখানে শেষ মুহূর্তে একটি দ্ব্যর্থহীন মর্মস্পর্শিতা ছিল, যখন তিনি তার মেয়ে নেভের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। তিনি এ সময় তার আদরের সোনামণিকে বলেন, ‘তুমি এ বছর যখন স্কুলে পড়াশোনা শুরু করবে, তখন তোমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি।’
এটি সহজ হতে পারে না, তবে আরডার্ন সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন হয়ে গর্ব করতে পারেন, যিনি যথাসময়ে সত্যিকারের খোঁচাটি দিতে পারেন। তিনি এর মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার ভিন্ন উপায়ও আছে এবং তিনি এটি করে দেখিয়েছেন। তার বয়স মাত্র ৪২ বছর। তর্কের খাতিরে এখনো তিনি অল্প বয়সি। তিনি এরপর আবার সামনের সারির রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু তিনি কি সত্যিই সেটা চান? তার পদত্যাগের বক্তৃতায় আরো একটি স্বীকৃতি রয়েছে। আরডার্ন মনে করেন, নেতৃত্ব আসলে একটি সীমাবদ্ধ প্রক্রিয়া; ক্ষমতা হলো অসম্ভব কঠিন বিষয়গুলোর একটি, যার প্রতিটিতে অনিবার্যভাবে রয়েছে কিছু জ্বালাপোড়ার পুঁজি। অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, অধিকাংশ নেতার সমস্ত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় শেষ হয়। আরডার্নের জয় এখানে যে, তিনি সবকিছুকে নিজের হাতে নিয়ে তার প্রস্থানকে সাফল্যের একটি ভিন্ন উপায় হিসেবে পুনর্নির্মাণ করলেন। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct