স্কুলে মূল্যবোধের শিক্ষা কিভাবে দেবেন
শেখ হাফিজুর রহমান
ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট, দিল্লি
প্রথাগত ও গতানুগতিক পাঠক্রম এবং শিক্ষা পদ্ধতি এখন সেকেল হয়ে গেছে, কারণ বতর্মান যুগের প্রজন্মের রুচি, চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা ইত্যাদি বদলে গেছে। আগেকার মতো, পড়াশোনায় এখন আর তত্ত্বমূলক কতকগুলি বিষয়ের উপর শুধু জোর দেওয়া হয় না, এক তরফা লেকচার ডেলিভারী দেওয়া হয় না বরং এখন পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষদানের আদেশ-উপদেশ শিক্ষাবিদ, শিক্ষা মনোবৈজ্ঞানিকগণ দিয়ে গেছেন। শিক্ষাবিদগণ মনে করেন শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সুষম বিকাশ। তাদের দৈহিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক, নৈতিক ও সৌন্দর্যমূলক সব রকমের বিকাশ হলেই সে কার্যকরী বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত হবে। সেইজন্য তাদের উপরোক্ত বিকাশের জন্য যে সমস্ত বিষয় ও কর্মসূচী উপযোগী সেইগুলি নিয়েই আধুনিক পাঠক্রম গঠিত হওয়া উচিৎ। যেমন বৌদ্ধিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের জন্য মনোবৈজ্ঞানিক সম্মত মূল্যবোধ শিক্ষা এবং তার শিক্ষন-বিদ্যা (Pedagogy) ব্যাপক ভাবে এখন পাঠ্যসূচিতে নাই। এই মূল্যবোধ শিক্ষা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। মনোবৈজ্ঞানিকদের মতে প্রৌঢ় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য, তাদের মানসিক বিকাশের জন্য অনুকূল পদ্ধতি develop করতে হবে। তবে তারা সক্রিয়তার সঙ্গে কৌতুহলপূর্বক শিখতে পারবে এবং যা কিছু শিখবে তা মনে থাকবে। অতএব অধ্যাপন-বিদ্যা সেই অনুযায়ী হতে হবে। যেমন ড. আর.ডি. কেলগ এবং এন.জি. কেলডা (2008) বলেছেন: কৈশোর প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক জিজ্ঞাসু হয়, অনেক কিছু শিখতে চায়, জানতে চায়। তারা ঐসব বিষয় শিখতে চায় যার মধ্যে তাদের রুচিসম্মত, প্রাসঙ্গিক এবং উপযোগী বিষয়াদি আছে। তারা সক্রিয় ও ইন্টার অ্যাকটিভ শিক্ষা পদ্ধতি পছন্দ করে। একঘেঁয়ে বা একতরফা লেকচার পছন্দ করে না। তারা সমবয়সীদের সাথে বিভিন্ন শিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে মিলেমিশে শিখতে বেশী পছন্দ করে। অন্য একজন মনোবৈজ্ঞানিক, আর.এল. ব্রাইটন (2007)ও বলেছেন: শিক্ষার্থীরা পরিবেশের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি জানার জন্য সুযোগ খোঁজে।সেইজন্য সেই অনুযায়ী শিক্ষককে শিক্ষা-বিদ্যা তৈরি করতে হবে। যেমন:
1) পরিবেশগত তথ্য, জ্ঞান উপলদ্ধি করার জন্য ক্লাসরুম লেকচার ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে, বন এলাকায়, পখিরালয়ে, বনপ্রাণী অভয়ারণ্যে, মরুভূমি এলাকায়, বন্যা-প্রবণ এলাকায়, খরা প্রবণ এলাকায় এবং জীব বৈচিত্র্য এলাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে যাওয়া এবং প্রতক্ষ্য করানো একটা উত্তম শিক্ষনবিদ্যা বলা যাবে। জীববৈচিত্র্য এলাকায় গিয়ে বুঝতে পারবে বিভিন্ন প্রাণীসমূহ একে অপরের থেকে ভিন্ন হয়েও কিভাবে একই পরিবেশে থেকে সামঞ্জস্যের সঙ্গে বসবাস করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামঞ্জস্যও সহনশীলতা বোধ জাগ্রত হবে। মরুভূমি ও খরাপ্রবণ এলাকায় গিয়ে বুঝবে জলের মূল্য, জলের জীবনে মহত্ত্ব। যখন ওখানে গিয়ে দেখবে গ্রামের মহিলারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কিভাবে ঘড়াভরা জল নিয়ে আসে, কারণ সেখানে পানীয় জল পাওয়াই যায় না। অর্থাৎ জল সংরক্ষণের মূল্য বুঝবে। সংরক্ষণ করার প্রবণতা হবে এবং সংযতভাবে জল খরচ করা শিখবে। ছাত্র-ছাত্রীদের যদি ডিবেটে, আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে উত্সাহিত করা হয়, তারা অনেক কিছু শিখবে, তাদের মধ্যে আত্ম-বিশ্বাস তৈরি হবে এবং কোনও বিষয়কে বিশ্লেষণ করা শিখবে।তাদরকে কোন বিষয়ে চরিত্রে অভিনয় (রোলপ্লে) করতে দিলে তারা সহমর্মিতা শিখবে, বিভিন্ন রকমের দৃষ্টিভঙ্গি শিখবে এবং যুক্তি সঙ্গত কথাবার্তা বলা শিখবে।স্কুলের বিভিন্ন উদযাপনে, অনুষ্ঠানে তাদেরকে রচনা ও পেন্টিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দিলে তারা অনুপ্রাণিত হবে। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী যেমন মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বোস, শহীদ ভগত সিংহ, আব্বাস তৈয়েবজী, রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকুল্লা খাঁন, টিপু সুলতান আরো অন্যান্যের বিষয়ে বক্তৃতা দেবার জন্য তাদেরকে উত্সাহ দেওয়া দরকার। তাতে তারা মূল্যবোধ যেমন দেশ-প্রেম, বলিদান, দৃঢ় সংকল্প, সহনশীলতা, সহযোগিতা, সাহসিকতা ইত্যাদি মূল্যবোধগুলি শিখবে। মনোবৈজ্ঞানিক আর.ডি. কেলগ এন্ড এন.জি. কেলগ (2008) আরও বলেছেন বই ছাড়া শিক্ষার্থীরা বাস্তবে ঘটিত সত্য ঘটনা ও অনুভূতি থেকেও কিছু শিখতে চায়, সেই তথ্যজ্ঞান তাদের সারা জীবন মনে থাকে। যেহেতু এটা একটা মনোবৈজ্ঞানিক চাহিদা তাই শিক্ষকদেরকে সেই অনুসারে শিক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা পড়াবার সময় বা ইতিহাস পড়াবার সময় টিপু সুলতানের এবং শিবাজী মহারাজের শাসন ব্যবস্থা, প্রজাদের সহিত সদব্যবহারের কথা বর্ণনা করতে হবে। টিপু সুলতান তাঁর হিন্দু প্রজাদেরকে সম্মান ও বিশ্বাস করত। আবার শিবাজী ও মুসলীম প্রজাদেরকে সম্মান করত এবং ভরসা করত। উদাহরণ দিতে পারে যে শিবাজীর সৈন্যদলে ষাট হাজার মুসলীম সৈন্য ছিল, তাঁর বারুদ ঘরের ইনচার্জ ও গুপ্তচর বিভাগের মন্ত্রি মুসলীম ছিল। আবার ওদিকে টিপু সুলতানের অর্থমন্ত্রী ছিল একজন ব্রাহ্মণ, তাঁর নাম পুর্নৈয়া। এইসব সত্য ইতিহাস বর্ণনা করলে শিক্ষার্থীদের মনে ধর্মনিরপেক্ষতা, বিশ্বাস করা, ভরসা করা, সহিষ্ণুতা, সম্মান করা ইত্যাদি মূল্যবোধ জাগ্রত হবে।তারা শিখবে, জানবে যে অতীতে রাজাদের মধ্যে কোনদিন ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে, ক্ষমতার লড়াই, গদীর লড়াই। অতএব তারা বুঝবে যে সমাজে মানুষের মধ্যে ঘৃণা, ভেদা-ভেদ সাম্প্রদায়িক হানাহানি ইত্যাদি যা দেখা যায় তা সবই যুক্তিহীন, ভিত্তিহীন এবং অমানবিক। মনোবৈজ্ঞানিক পি.সি. স্কেল ও কে. রনীও তাই বলেছেন যে বাচ্চারা ছোট বেলায় একটু আত্ম-কেন্দ্রিত থাকে ও স্বার্থপর হয়ে থাকে। কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে অন্যের আশা, অধিকার ও অনুভূতি বোঝবার ও শেখার প্রবণতা দেখায়। অন্য বাচ্চাদের সাথে সাথে খেলা করে, মেলা-মেশা করে ক্রমশ তাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করে। তাই শিক্ষকদের উচিr তাদেরকে ঐসব খেলায়, গেমস-এ অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যার মধ্যে মেলা-মেশা, ইন্টারঅ্যাকশান আছে। এরফলে তাদের মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সামঞ্জস্য বোধ সৃষ্টি হবে। এছাড়া শিক্ষককে মনে রাখতে হবে যে সাইন্স হোক বা হিউমানিটিজ হোক, প্রত্যেক পাঠ্য বিষয়ে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ থাকে, সেগুলো বুদ্ধি দিয়ে, বিশ্লেষণ করে খুঁজে বের করতে হবে।
উদাহরণ 1) আমাদেরকে সমাজে প্রত্যেককেই অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়, নির্ভরও করতে হয়, অন্যের প্রতি দয়া, সহনশীলতা দেখাতে হয় এবং সহযোগ, সমর্থনও করতে হয়। জীবনযাপনের জন্য এই মূল্যগুলো অপরিহার্য। এগুলো শিক্ষক কি ভাবে বোঝাবে? উত্তর হল - শিক্ষক মহাশয় আপনি পরজীবীর একটা বড় ছবি দেখান - যেমন বটগাছের উপর অশ্বত্থ গাছ। মূল গাছ হচ্ছে বটগাছ, তার উপর অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে, তারই রসে বড় হচ্ছে, তারই সঙ্গে সাথে সাথে বেঁচে আছে। বটগাছ যদি অশ্বত্থ গাছকে আশ্রয় দিতে পারে, খাবার খাওয়াতে পারে, সহ্য করতে পারে, সাপোর্ট করতে পারে, এক সঙ্গে থাকার মানসিকতা দেখাতে পারে তাহলে মানুষ হয়ে আমরা অন্য একজনকে সহ্য করতে পারবো না কেন? প্রয়োজনে দয়া দেখাতে এবং সহযোগিতা করতে পারবো না কেন? এইভাবে উপযুক্ত দৃষ্টান্ত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করা যায়। উদাহরণ নং 2) পাচনতন্ত্রে জিহ্বা, দাঁত, খাদ্যনালী, পেট, লিভার, কিডনি প্যাংক্রিয়া ইত্যাদি অভিন্ন অঙ্গ এবং প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। প্রত্যেক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের সমন্বয়, সামঞ্জস্য, নির্ভরশীলতা থাকে বলেই খাবার হজম হয়। যদি দাঁত ও জিহ্বা ঠিকমত খাবারকে না চেবায়, খাদ্যনালী দিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছাতে অসুবিধে হয়, আবার পেটকে ও অনেক পরিশ্রম করে খাবারকে নরম করতে হয়। লিভার, কিডনিকেও অনেক পরিশ্রম করতে হয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে এই উদাহরণ দিয়ে বোঝাবে যে সমাজ একটি দেহের সমান। প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজের এক অভিন্ন অঙ্গ এবং এরা একে অন্যের উপর মুখাপেক্ষী, পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহযোগিতা, হৃদ্যতা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। ভালো করে দক্ষতার সাথে বোঝালে তারা এই মূল্যবোধগুলি সহজে বুঝতে পারবে এবং তাদের মনে ঐ সব মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। উদাহরণ 3) আলোর প্রতিসরণ (Refraction of Light) - আলোর প্রতিসরণ পড়াবার সময় বোঝাতে হবে যে জলভর্তি গ্লাসে একটি পেনসিল বা কোন সরুরড ডুবিয়ে রাখলে পেনসিলটি সোজা হওয়া সত্বেও গ্লাসের বাইরে থেকে একটু বক্র দেখাবে। আসলে কিন্তু বক্র নয়, এটা হয় প্রতিসরণের কারণে। অর্থাৎ যে ফিজিক্স পড়ে নাই, সে তো পেনসিলটিকে বক্রই ভাববে। তার মানে সে ভুল ভাববে বা বুঝবে।এই উদাহরণ দেখিয়ে বোঝাবেন যে কারো সম্বন্ধে, কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে, অনেক সময় আমরা ভুল মন্তব্য দিয়ে থাকি, অন্যকে সহজেই ভুল বুঝি, যেটা অনুচিৎ। তাই সঠিক না জেনে অন্যকে ভুল বোঝা উচিত নয়। এই রকম প্রত্যেক পাঠ্য পুস্তকে অসংখ্য সামাজিক, নৈতিক মূল্য লুকিয়ে আছে, শিক্ষকদেরকে খুবই বুদ্ধি দিয়ে, কল্পনা শক্তিকে বিস্তারিত করে ঐসব গুণগুলিকে বের করে শিক্ষণ-বিদ্যা হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়। এইভাবেই মূল্যবোধ শিক্ষা সফল হবে।
পুঁথিগত কিছু শিখলে সেটা বিদ্যা আর তার প্রয়োগ করাটাই হল শিক্ষা।
আমরা তখনই শিক্ষিত হব যখন অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দেব।
আমরা তখনই শিক্ষিত হব যখন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয়ে সহযোগ করতে এগিয়ে যাব
আমরা তখনই শিক্ষিত হব যখন নিজেকে আলোকিত করে অন্যকেও আলোকিত করার চেষ্টা করব।
আমরা তখনই শিক্ষিত হব যখন বেসাহারাকে সাহায্য করব।
আমরা তখনই শিক্ষিত হব যখন আমরা মুক্ত এবং নির্ভিক হব।
আমরা তখনই শিক্ষিত হব যখন ব্যবহারে কোমল এবং ধৈর্যশীল হব।
আমরা তখনই শিক্ষিত হব যখন অন্যের সমালোচানা না করে সমাজ কল্যাণ কিভাবে হতে পারে সেই নিয়ে নতুন নতুন প্রকল্প তৈরি করব।
অর্থাৎ শিক্ষা মানে চেতনাকে উদ্দীপ্ত করা এবং হৃদয়কে জাগ্রত করা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct