২০২২ সাল শেষেও বিশ্বের যে ক’টি অঞ্চলে অস্থির পরিস্থিতি বজায় থাকার ইঙ্গিত রয়েছে তার মধ্যে একটি হল মধ্যপ্রাচ্য। এই অঞ্চলে বিশ শতকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশজুড়ে যে ভারসাম্য ছিল তা ভেঙে পড়ে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে। দ্বিতীয় দশকে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরি হতে থাকে। তৃতীয় দশকের প্রথম দুই বছর ছিল নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যের ভিত্তি তৈরির সময়। ২০২৩ সাল এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নতুন এক সময়কালের সূচনার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বছর হতে পারে। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
গত কয়েক বছর ধরে তুরস্কে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং সিরিয়ার সঙ্ঘাত থেকে লক্ষাধিক শরণার্থীর চলমান উপস্থিতি সামাজিক অস্থিরতা এবং অতি জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে জাগিয়ে তুলছে। জনমত জরিপ অনুসারে, এক বছর আগে রাষ্ট্রপতি রজব তৈয়ব এরদোগানের জন্য অনুমোদনের রেটিং সর্বনিম্ন ছিল এবং বছরের ব্যবধানে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ভোটারদের কাছে আবেদন সৃষ্টির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশটিতে ব্যাপক অসন্তোষ রয়ে গেছে। তুর্কিয়ে জনগণের একটি বড় অংশ পরিবর্তন চাইছে। ২০২৩ সালে বিরোধী পক্ষের জন্য এই পরিবর্তনের একটি সুযোগ আসতে পারে, দেশের শতবর্ষের সময়ই জুনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটি তুরস্কের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জটিল নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এরদোগান এবং তার ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) চ্যালেঞ্জময় সময়ের একটি ঘটনা বিরোধী দল এবং প্রার্থীদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই মাসে ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগ্লুকে দুই বছরেরও বেশি মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তার ওপর আরোপিত রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শাস্তিতে অনেকে বিশ্বাস করে যে, এটি নির্বাচনে এরদোগানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতা জাগিয়ে তুলবে। বিরোধী দলগুলোর পেছনে একত্রিত হওয়ার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে মনে করা ইমামোগ্লুকে রাজনীতি থেকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঠিক দুই দশক আগে এরদোগানের বিরুদ্ধে এমন একটি পদক্ষেপ বর্তমান রাষ্ট্রপতির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলেছিল। এখন এটা কি এরদোগানের পতন ঘটাতে পারে, তা নিয়ে অনেকে নানামুখী বিশ্লেষণ করছেন। ইমামোগ্লু নিষেধাজ্ঞা এবং তুরস্কে উদ্বেগজনক বিভিন্ন সঙ্কটের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, এরদোগান এখনো বিরোধীদের সামনে একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে আছেন। একেপি এখনো বর্তমান নির্বাচনে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় দল আর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পার্টির (এমএইচপি) সাথে তারা জোট বজায় রেখেছে। গত নির্বাচনের পর থেকে এমএইচপির র্যাংকিংয়ের পতন হয়েছে, কিন্তু উভয় দলই একসাথে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।
তুর্কিয়ে সরকারের ‘ভিশন ২০২৩’-এর বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এটি গত দশকে ঘোষণা করা উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলোর একটি সেট। এর অগ্রগতি অবশ্যই নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচন চলাকালীন সময়ে মূল্যায়ন করা হবে, যা ২০২৩ একেপির টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। তুরস্কে সাধারণভাবে জাতীয় নিরাপত্তা ও অগ্রগতির জন্য এরদোগানকে বিকল্পহীনভাবে দেশের অনেক মানুষ। তিনি তুরস্ককে আঞ্চলিক পরাশক্তি করেন এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিকভাবে দেশটিকে ইউরোপের রুগ্ণ দেশের অবস্থান থেকে প্রতিশ্রুতিশীল দেশে রূপান্তরের নায়কও তিনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির নানা দিকে দুর্বল অবস্থা বিশেষত লিরার দাম অবনয়ন এবং উচ্চ হারের মূল্যস্ফীতি এরদোগানের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি অনেক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। আগামী ৫-৬ মাসে এ ক্ষেত্রে সাফল্যের পাশাপাশি সিরিয়ার সাথে রুশ মধ্যস্থতায় যে আলোচনা আঙ্কারা শুরু করেছে তার সাফল্যের পথ ধরে সিরীয় শরণার্থীদের স্বদেশে পুনর্বাসন করতে পারলে এটি আবারো এরদোগানের জন্য বিজয়ের ভিত তৈরি করে দিতে পারে। তুর্কিয়ে ও ইরান কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে, তুরস্ক এবং ইরানের মধ্যে একটি বিস্তৃত পরিসরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে। আঙ্কারা যখন যুদ্ধে বাকুকে তার ড্রোন এবং সামরিক সহায়তা দিয়ে সমর্থন করেছিল, তখন তেহরান গোপনে ইয়েরেভানকে সমর্থন করে চুপচাপ অস্ত্র হস্তান্তর করে। আর্মেনিয়ার প্রতি ইরানের সমর্থন একটি সুস্পষ্ট এবং প্রত্যাশিত নীতি, এটি শুধু উত্তর-পশ্চিম ইরানে তার আজেরি জনসংখ্যার মধ্যে জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে প্রশমিত করার প্রচেষ্টা হিসাবে নয়, তবে প্রাথমিক কারণ এটি বাকুকে মোকাবেলা করার জন্য তেহরানের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের মধ্যে রয়েছে। ’দেশের মধ্যে সমস্যা আঞ্চলিক কৌশলগত সুবিধাকে কেন্দ্র করে। এর একটি মূল উদাহরণ হলো জাঙ্গেজুর করিডোরকে ঘিরে সমস্যা, এটি একটি আর্মেনিয়ান ভূখণ্ড যা আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড এবং এর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নাখিচেভানকে আলাদা করে রেখেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct