এক অভাবনীয় জীবনকথার গল্প (কুটির থেকে রাজপ্রাসাদ)
দীনমহাম্মদ সেখ
আমাদের মানব জীবন বড্ড ক্ষণস্থায়ী। তবুও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা এই স্বল্প সময়ের পরিসরেও কর্মের জোরে অমরত্ব লাভ করেন। হয়ে উঠেন আমাদের কাছে কিংবদন্তী, চিরঞ্জীবী। বেঁচে থাকেন আমাদের অন্তরাত্মায়। এমনই একজন সাধারণ মেয়ের অসাধারণ হয়ে ওঠার কথা বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থে। তিনি হলেন নদিয়া জেলা তথা পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব, পুতুল চক্রবর্তী। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে সদ্য প্রকাশিত হয়েছে কালীশংকর কর্মকার সম্পাদিত “ কুটির থেকে রাজপ্রাসাদ-১ম খন্ড “ নামক একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। এই গ্রন্থটিতে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর সহধর্মী কালীশংকর কর্মকার, ড. দেবনারায়ন মোদক, সমীর রায়, দিলীপ মজুমদার,কনক ঠাকুর ,সীমান্ত হালদার সহ আরও অনেকে। কবিতা লিখেছেন শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ,কৃষ্ণা চক্রবর্তী, উজ্জ্বল বসু, নীলাদ্রিশেখর সরকার, সুমন বিশ্বাস প্রমুখ।
পুতুল চক্রবর্তী ছিলেন একজন একনিষ্ঠ অভিনেত্রী, নাট্যব্যক্তিত্ব, নির্দেশক ও আবৃত্তি শিল্পী। থিয়েটারই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। যাঁর যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে ‘আপনজন’ নাট্যদলে যোগদানের মাধ্যমে। তারপর শুরু হয় তার বিরামহীন পথচলা। সেই সময়ে বেথুয়াডহরীর মতো একটি মফস্বল থেকে কলকাতা ও পরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার অভিনয় ও গণনাট্য আন্দোলনের একজন মুখ হয়ে ওঠা সহজ ছিল না।এক্ষেত্রে একজনের নামা না বললেই নয় তিনি হলেন আর এক নাটক পাগল পুতুল চক্রবর্তী সহকর্মী তথা প্রাণনাথ কালীশংকর কর্মকার। তিনি ও পুতুল চক্রবর্তী ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। এক্ষেত্রে তাঁকে যোগ্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কালীশংকর কর্মকার। তার লেখায় উঠে এসেছে পুতুল চক্রবর্তীর কিংবদন্তি হয়ে ওঠার কাহিনী, যার প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন তিনি। তিনিও একজন দক্ষ অভিনেতা ও নাট্যকর্মী। কলকাতার নামকরা বিভিন্ন থিয়েটারে তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ করে ছিলেন বিশিষ্টজনদের। প্রশংসা কুড়িয়েছেন ভুরি ভুরি। কলকাতা উত্তম সিনে থিয়েটার্স, শপথ নাট্যদল, পিপলস লিটল থিয়েটার, শ্রীরঙ্গম নাট্যদলে দাপটের সাথে অভিনয় করেছেন। ছুটি, বিসর্জন, উপমা, ভাঙন,ব্রাত্যকথা, অসত্যকাম নাটকে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। নির্দেশনা করেছেন অগ্রদানী,বুদ্ধুরাম,খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন প্রভৃতি নাটকে। কালীশংকর কর্মকারের লেখা “ আমার কথা”য় পুতুল চক্রবর্তীর থিয়েটার জীবনের এমনই নানান কথা, জীবনের চড়াই উৎরাইয়ের কথা উঠে এসেছে, যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।
“কুটির থেকে রাজপ্রাসাদ”---এ পুতুল চক্রবর্তীকে নিয়ে নানান স্মৃতিচারণা করেছেন ড. দেবনারায়ন মোদক, সঙ্গীতগুরু নিমাই দত্ত, সমীর রায়, কনক ঠাকুর সহ আরও অনেকে। আসলে পুতুল চক্রবর্তী ছিলেন বাংলা থিয়েটার ও গণনাট্য আন্দোলনের একজন বটবৃক্ষ। যার সুশীতল ছায়াতলে এসে আশ্রয় পেয়েছেন অগণিত থিয়েটারপ্রেমী মানুষ। তাঁর স্নেহময় ব্যবহারে মুগ্ধ হতো সবাই। “ বেরেথি” ( বেথুয়াডহরী রেপুটেড থিয়েটার) এর জন্ম ১৯৯৮ সালে হলে দীর্ঘ ২৭ বছর যাবৎ সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। সেই বেরেথির বিভিন্ন ছাত্র ছাত্রীদের বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে তাকে নিয়ে লেখা নানান কথা। এক কথায় তার অদম্য মনোবল ও অভিনয় দক্ষতা বাংলার থিয়েটার জাগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র করে রাখবে একথা হলফ করে বলতে পারি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত “ উপমা”র কক্ষে বসে নাটক, থিয়েটার, নির্দেশনা নিয়ে তাঁর অফুরন্ত জ্ঞানভান্ডার বিলিয়ে গেছেন। তিনি বলতেন --- “My life is my Theatre “। “ কুটির থেকে রাজপ্রাসাদ” নামক এই গবেষণাধর্মী গ্রন্থটি নাট্যকর্মী, অভিনেত্রী পুতুল চক্রবর্তী জানতে হলে, নদিয়ার গণনাট্য আন্দোলনকে জানতে হলে পড়তেই হবে । বইটির প্রকাশক ‘বেরেথি’। সম্পাদনা করেছেন কালীশংকর কর্মকার। খুব সুন্দর ঝকঝকে পৃষ্ঠা ও বাইন্ডিং। প্রচ্ছদ করেছেন মৃণাল শীল। বইটিতে পুতুল চক্রবর্তীর অভিনয় জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের নানান ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে যা বইটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct