কারা বুদ্ধিজীবী! সুশীল সমাজই বা কারা?
সনাতন পাল
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হল মানুষ। তেমনি সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষকেই বলা হয় । সুতরাং মানুষের বুদ্ধি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সমস্ত সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের মধ্যে আবার প্রকার ভেদ আছে,কারো একটু বেশি বুদ্ধি আছে আবার তুলনামূলক ভাবে কারো একটু কম আছে। অর্থাৎ কেউ একটু কম বোঝেন,আবার কেউ একটু বেশি। ভালো কাজ করতে যেমন বুদ্ধির দরকার হয়,তেমনি বুদ্ধির প্রয়োগ না ঘটিয়ে মন্দ কাজও করা সম্ভব নয় । একজন ওভারশিয়ারের যেমন বাড়ীর প্ল্যান করতে বুদ্ধির দরকার হয়,তেমনি ঐ বাড়িতে সিন্ধ খুঁড়তেও একজন চোরকে বুদ্ধির প্রয়োগ করতে হয়। আবার একথাও সত্যি যে আমরা সবাই সব কিছু যেমন বুঝি না,তেমনি সবাই সব কিছু করতেও পারি না। পৃথিবীর সমস্ত সুস্থ মানুষেরই কোনো না কোনো বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বুদ্ধি বেশি থাকাটা যেমন দোষের নয় তেমনি বুদ্ধি কম থাকাটাও অপরাধের নয়। কেউ বুদ্ধির প্রয়োগ ভালো কাজে করবেন! নাকি মন্দ কার্য সম্পাদন করতে করবেন সেটা একান্তই নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির মানসিক প্রবৃত্তির উপরে। আবার এই মানসিক প্রবৃত্তি নির্মাণ যেমন শিক্ষার উপর নির্ভর করে এবং ঐ ব্যক্তি কিরূপ সামাজিক পারিপার্শিকের মধ্যে নিত্য জীবন যাপন করছেন তার উপরেও নির্ভর করে । তবে এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা কখনই অস্বীকার করা যায় না । ব্যক্তির চরিত্র নির্মাণে পারিপার্শিকের যদি কোনো ভূমিকা না থাকত,তাহলে “ সৎ সঙ্গে স্বর্গে বাস আর অসৎ সঙ্গে নরকে বাস” বাস্তবে এই প্রবাদ বাক্যের জন্মই হতো না। যদিও স্বর্গের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে,সেটা আলাদা বিষয়। এক্ষেত্রে স্বর্গ বলতে শান্তি এবং সুখকর পরিণতির কথাই বোঝানো হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন যাবৎ পশ্চিমবঙ্গে ‘বুদ্ধিজীবী ‘এবং ‘ সুশীল সমাজ ‘এই কথা দুটো নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে এবং কিছু মানুষকে সমাজে একটু আলাদা করে অধিক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার একটা সামাজিক বিপদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা বলা মানে কখনই এটা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে না যে,সমাজে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হোক। বস্তুত এটিই সত্যি যে পৃথিবীর সমস্ত মানুষেরই জীবিকার জন্য বুদ্ধির দরকার হয়,সেই অর্থে সমস্ত মানুষই বুদ্ধিজীবী। এখন প্রশ্ন হলো,তাহলে কেন শুধু মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষকে বুদ্ধিজীবী তকমা লাগিয়ে গ্ল্যামারের বেলুন হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে তোলা হচ্ছে? অথচ পৃথিবীতে এমন কোনো জীবিকা নেই,যেখানে বুদ্ধির দরকার হয় না। যাঁরা লোকের বাড়ীতে কাজ করেন,যাঁরা রিক্সা চালান, জমিতে হাল কৃষির কাজ করেন সব ক্ষেত্রেই বুদ্ধির দরকার হয়। তাই শ্রমিক,কৃষক সবাই বুদ্ধিজীবী। এই মানুষ গুলোকে তো আলাদা করে বুদ্ধিজীবী বলা হয় না! আসলে একটা অংশের মানুষ নিজেদেরকে সমাজের মধ্যেই আলাদা একটা কক্ষে অবস্থান করতে চান। শ্রমিক-কৃষকদের সাথে নিজেদের হয়তো একাত্ম করতে চান না। তাঁরা যদি কখনও অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাদপদ মানুষের সাথে মেশেন,তাহলে সেটিকে তাঁর বিশেষ গুণ বলে বিবেচনা করা হয়। তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের থেকে একটা তফাৎ করে চলতে চান। ঠিক যেমন পারফিউমের গন্ধের সাথে ঘামের গন্ধের তফাৎ থাকে। তবে এটাও ঠিক যে সকলের মানসিক স্থিতি একই রকম নয়। কিন্তু ব্যতিক্রমকেও নিয়ম ধরা যায় না।
বর্তমান সময়ে যাঁদেরকে ‘বুদ্ধিজীবী’ এবং ‘সুশীল সমাজ’ নামক নামাবলী গায়ে লাগানো হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নিজস্ব সৃজনশীলতা এবং শিল্প গুণকে পুঁজি করে সমাজে উচ্চ আসনে থাকতে চান। তাঁদের এই গুণের দ্বারা সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হন এবং এই কারণে তাঁদের উপর আলাদা একটা শ্রদ্ধা,ভালোবাসা, বিশ্বাস জন্মায়। সাধারণ মানুষ ভাবেন ঐ গুণীদের মতো তাঁর গুণ নেই,তাই তাঁদের আলাদা মূল্য দিতেই হয়। বর্তমান সময়ে রাজনীতির অঙ্গনে এই তথাকথিত সুশীল সমাজ এই শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলেন।ফলে জনমানসে কোনো রাজনৈতিক দলের ভাবমূর্তি ভালো হয় আর কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ভাবমূর্তি খারাপ হয়। এই কাজের বিনিময়ে তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা লাভ করেন। এই কারণে শাসক-বিরোধী উভয়েই নিজস্ব স্বার্থে নিজেদের পক্ষের এই সমস্ত গুণীজনদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করে থাকেন। কারণ ঐ জনপ্রিয়তা তারা পরে দলীয় রাজনীতির কাজে লাগাবেন। এই সমস্ত নানাবিধ কারণে আজকের রাজনীতিতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের রাজনীতিতে এতো কদর। একটা সময় এই সাধারণ মানুষই গায়ের রক্ত জল করা পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে এঁদের সিনেমা দেখেছেন,নাটক দেখেছেন, গান শুনেছেন। এই মানুষই তাঁদেরকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে গেছেন। বর্তমানে যখন সেই সাধারণ মানুষের ওপর সরকার অমানুষিক নির্যাতন করে, গলার উপর দিয়ে রেলগাড়ির চাকা চলে যায়, কখনও নদীর চড়ে,কখনও জঙ্গলের ধারে সাধারণ ঘরের মহিলারা ধর্ষিতা হয়ে খুন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন, মাঝরাতে অহসিং আন্দোলনের উপরে রাষ্ট্রীয় মদতে পুলিশের নির্যাতন চলে, যত্রতত্র ১৪৪ ধারা জারি করে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করা হয় ,তখন ঐ সুনীলবাবুরা নিজেদের কায়েমি স্বার্থে চুপ করে থাকেন। শাসকের বিরুদ্ধে বলতে কলমের কালি শুকিয়ে যায়, ভোকাল কর্ড অকেজো হয়ে যায়। তবুও সাধারণ মানুষের মন এতোটাই উদার যে,পরে আবার এঁদের দেখতেই ভিড় জমান,এখানে কোনো ব্যক্তি স্বার্থ কাজ করে না। তাই আসলে এই সাধারণ মানুষই হলো আসল সুশীল, যাঁদের দিকে ক্যামেরার লাইট পড়ে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct