বামুন পুকুর পাড়
আব্দুস সামাদ আনসারী
বর্ষা এসে গেছে। মস্ত চাচা প্রতিদিন ভোরবেলা আমাদের ঘরের সব কাজকর্ম সেরে বামুনপুকুর পাড়ে গিয়ে চালা তৈরির কাজ করে। আবার সন্ধ্যায় চলে আসে।বাকি সব কাজকর্ম সেরে দলিজের একপাশে শুয়ে পড়ে। একদিন দেখি আমার ছোট বোন মুনমুন একটা বর্ণপরিচয় বই নিয়ে মস্ত চাচার কাছে গিয়ে হাজির। ও মসত চাচা, ও মসত চাচা আমাকে একটু পড়িয়ে দাও না ! ---- আমাদের পড়া তোর কি পছন্দ হবে মুনু ,এই কথা বলে চাচা পড়ানো শুরু করে। বলো অ , মুনু ও বলছে - বল অ, আমি চুপচাপ ওদের পড়াশুনা শুনছি।
হঠাৎ যখন আমার কানে ভেসে এলো বল ঠ্যাং ভাঙা দ, বল অড়, বল আড্ড তখন আমি আর না হেসে থাকতে পারলাম না। আমাদের পাড়ার ইদরিশ দাদু ছোটদের বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ পড়ায়।মুনমুন এখন ইদরিশ দাদুর কাছেই পড়ে। মগরিবের আজান হলে হ্যারিকেন নিয়ে পড়তে যায় । আর ইশা আজানের পর ছুটি হয়। আমি ওকে প্রায় দিনই আনতে যাই । এতদিনে বোনের অক্ষর পরিচয় হয়েছে। এমনি একদিন আমি বোনকে আনতে গেছি। তখনও ওদের পড়া শেষ হয় নি। ইদরিশ দাদু পড়া ধরছে- বলতো রুনু কাগজি বানান কি?--- ক এ আকার অঁ অঁ অঁ --- রুনু বলতে পারে না। ইদরিশ দাদু জিঞ্জাসা করে --- কে বলতে পারবে হাত তোল ? হঠাৎ দেখি আমার ছোট্ট বোন মুনমুন হাত তুলেছে । তা দেখে আমিতো অবাক! এই সবে যার অক্ষর পরিচয় হয়েছে সে কি করে যুক্তক্ষর বলতে পারবে! আর কারও হাত দেখতে না পেয়ে ইদরিশ দাদু বলে ----- আচ্ছা মুনমুন তুই ই বল দেখি...... কিন্তু তোকে তো এখনও যুক্তক্ষর পড়াইনি। আমার ছোট্ট বোন মুনমুন উঠে দাঁড়িয়ে বলে...... কয়ে আকার গিজ্জা গিজাং ই—কাগজি । যেই বলা সেই সবাই যারা বাচ্চাদের আনতে গেছে, হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছে । সবাইকে হাসতে দেখে মুনমুন একদম চুপ ।ও কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। কিন্তু আমার ব্যাপারটা বুঝতে এতটুকুও অসুবিধা হয় নি। নিশ্চয়ই মস্ত চাচা মজার ছলে মুনমুনকে এসব শিখিয়েছে। বাড়ি যাবার সময় বোনকে জিঞ্জাসা করলাম ---- তুই আর কি কি বানান জানিস? মুনমুন বলে..... মটর – ম হট্ট পট র, কুমড়া – ই মূড়া ঊ মূড়া... আমারা দুই ভাই বোন খুব হেসেছিলাম।
ইতিমধ্যে মস্ত চাচা বামুন পুকুর পাড়ের উত্তর পূর্ব কোনে কয়েকদিন ধরে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে বাঁশ, কঞ্চি জোগাড় করেছে । তারপর সেখানে একটা ছিটেবেড়া ঘর বানিয়েছে। আর তার ঘরের পাশে খেপা দার ছিটেবেড়া। খেপাখূডার তিন ছেলে বও এবছর কাজ করতে আসছে। মস্ত চাচার চার ভাই আজই এসেছে। ওরা ঘরটা দেখে খুব খুশি। মাঝে পুকুর আর চারপাশে চওড়া পাড় সেই পাড়েই আরও কয়েকজন মুনিশ পশ্চিম থেকে এসে ঝুপড়ি করেছে। এ বছর বর্ষা এখনো ঠিক মতো না পড়ায় চাষের কাজ পুরোদমে শুরু হয় নি।খেপা খূড়ার ছেলে বিজুর সাথে আমার খেলা করতে খুব ভালো লাগে । একবার দুজনে মিলে ফুটবল খেলছি,ও আমাকে অনেক গোল দিয়েছে।আমি একটা ও গোল করতে পারিন। দুই চালার মাঝে রাস্তা আর সেই রাস্তাতেই চলতো ফুটবল খেলা ।প্লাস্টিককে সুতলি দিয়ে বেঁধে ফুটবল বানিয়ে খেলতাম । গোল দিতে না পেরে আমি খুব কাঁদছি।বিজু দৌড়ে আমার কাছে এসে আমাকে জিঞ্জাসা করছে-- তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? পায়ে লেগেছে? আমি কেঁদে কেঁদে বললাম না, আমি গোল করতে পারছি না । বিজু বলল - আয় এবার তুই গোল দিবি আয়। আমি আর আটকাবো না। তারপর আমিও ওকে অনেক গোল দিলাম। বামুনপুকুর আগে খুদকুড়ো গ্রামের ব্রাহ্মণদের ছিল। পরবর্তীতে আমাদের বাড়ির কাজীরা ও গ্রামের মীর, মল্লিক পরিবাররা এই পুকুর কিনে নেয়। এইসব পরিবারের পশ্চিম থেকে আগত মুনিশরা এখন এই পুকুর পাড়ে বাসা বেঁধেছে । সাঁওতাল, কুড়মি, সর্দার, মাহাতো, জোলা সবাই একসঙ্গে আছে। তাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। এ যেন পূবের সাথে পশ্চিমের মিলন।শান্তির নীড়। আমার পড়া শেষ হলে আমি বামুনপুকুর দৌড়াতাম বিজু মাহাতো, রথ মাঝি, সামু জোলা, বাপি সর্দারদের সাথে খেলতে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct