সম্প্রীতি মোল্লা, কলকাতা, আপনজন: উত্তরবঙ্গের সার্কিট বেঞ্চে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একের পর এক নজিরবিহীন নির্দেশ দিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই এক শিক্ষিকার রহস্যজনক বদলিতে সিবিআই তদন্ত এর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি, পাশাপাশি জল্পেশ মন্দিরের গর্ভগৃহে ভক্তদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন প্রাণহানি রুখতে। ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে শিলিগুড়ির এক ঘটনায় মিথ্যে পুলিশ কেস দেওয়ার মামলায় এক পুলিশ অফিসার কে অনিদিষ্টকালের জন্য সাসপেন্ড করেছেন বিচারপতি। আদালতের নির্দেশ ছাড়া ওই পুলিশ অফিসারকে চাকরিতে পুনবহাল করা সম্ভব নয়,তার উল্লেখও রয়েছে। সেইসাথে এই মামলার যাবতীয় শুনানি তাঁর এজলাসেই হবে তাও উল্লেখ করেছেন আদেশনামায়।উল্লেখ্য, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে রয়েছেন। এই মুহূর্তে তিনি উত্তরবঙ্গের সার্কিট বেঞ্চে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে উত্তরবঙ্গের সার্কিট বেঞ্চে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাশে এই নির্দেশ জারি করা হয়েছে। আদালত সুত্রে প্রকাশ, শিলিগুড়ির মাটিগাড়ার একটি নামি আইটি সংস্থার চারজন মেয়ে তাদের সহকর্মীর সাথে একটি অফিসের ক্যাবে গত ৮ই জুন রাত্রি ২ টো নাগাদ তাদের কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরছিল ,তখন চার জন স্থানীয় যুবক তাদের অফিসের ক্যাবকে বেআইনিভাবে আটকে রাখে এবং চালককে মারধর করে এবং অফিসের ক্যাব থেকে মেয়েদের বের করে দেয় এবং তাদের শ্লীলতাহানিও করে বলে অভিযোগ । ক্যাব ড্রাইভার স্থানীয় পুলিশকে ডেকেছিলেন এবং মেয়েরা তাদের সংস্থার ম্যানেজার অনুজ সুরিকে ফোন করেছিল। অনুজ সুরি ও তার তিন সহকর্মী ঘটনাস্থলে আসেন এবং পুলিশও আসে। কিন্তু পুলিশ শুধুমাত্র একজন শ্লীলতাহানিকারীকে গ্রেপ্তার করে ও বাকিদের সাথে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে বলে দাবি। এতে আক্রান্ত মেয়েরা আপত্তি তোলে। স্থানীয় থানার পুলিশ এসআই কৃষ্ণ পারজা মেয়েদের সাথে খারাপ আচরণ করে বলে অভিযোগ।
অনুজ সুরি পুলিশ অফিসারকে জানান তাঁরা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পুলিশ কমিশনার কাছে অভিযোগ করবেন। একথা শোনার পরেই তখন সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার তাদের থানায় আসার নির্দেশ দেন। অনুজ সুরি শ্লীলতাহানির এফআইআর করতে থানায় গিয়েছিলেন এবং মেয়ে এবং অন্য তিন সহকর্মীও থানায় গিয়েছিলেন। তবে পুলিশ এফআইআর দায়ের করার পরিবর্তে তাদের অবৈধভাবে অনুজ সুরিকে গ্রেপ্তার করে এবং তাকে লাঞ্ছিত করে থাকে। অনুজ সুরি ও তার সংস্থার তিন কর্মচারী বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে অভিযোগ করে যে, তারা পুলিশকে লাঞ্ছিত করেছে এবং পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেছে। তারপরে নির্যাতিতা মেয়েরা শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ কমিশনার সংশ্লিষ্ট ডিসিপিকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দেন এবং তিনি প্রধাননগর থানার সিসিটিভি ফুটেজ দেখেন বলে জানা গেছে।
সিসিটিভিতে দেখা গেছে যে অনুজ সুরি নিজে থেকেই সুস্থ অবস্থায় থানায় ভিতরে প্রবেশ করেছেন। তবে তদন্তকারী আধিকারিক আদালতের সামনে সিসিটিভি ফুটেজ আনেননি এবং অনুজ সুরি অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে ২৪ দিনের জন্য হেফাজতে ছিলেন। অবশেষে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বৈদুর্য ঘোষাল ও রিমা সরকার হাইকোর্টে অনুজ সুরির জামিনের আবেদন করেন। সেখানে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ অনুজ বাবুর জামিন মঞ্জুর করে। জামিনে মুক্তি পেয়ে অনুজ সুরি জলপাইগুড়িতে কলকাতা হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চে একটি পুলিশি অত্যাচার ,জুলুমবাজি এবং সাধারণ নাগরিক কে হেনস্থা এই সমস্ত অভিযোগ নিয়ে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। সম্প্রতি মামলাটি বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এজলাসে ওঠে।মামলাকারীর আইনজীবী বৈদুর্য ঘোষাল , রিমা সরকার ও সিদ্ধি সেঠিয়া শুনানির প্রথম দিন পুলিশি অত্যাচারের কথা জানালে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় রাজ্য সরকারকে থানার সিসিটিভি রেকর্ডিংয়ের ফুটেজ জমা দিতে বলেছিলেন। পরবর্তী বিচারের দিন অর্থাৎ গত ৪ টা অগাস্ট সেই ভিডিও রেকর্ডিং দেখেন এবং সেখানে ৪মিনিটের ভিডিও ফুটেজ মিসিং দেখা যায়। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন - ‘ ঐ পুলিশ অফিসার কৃষ্ণ পরজা কে কোর্টের আদেশ ছাড়া পুনরায় চাকরিতে যোগদান করতে পারবেনা,এর মধ্যে যদি তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলে সেটার জন্য আদালতের অনুমতি লাগবে না’।বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি এজলাসে আরো জানান -’ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে পুলিশি নৃশংসতার ঘটনা ঘটছে যার মধ্যে একটি এই আদালতের আলোকে এসেছে, যে পুলিশ অফিসার এই আদালতের নির্দেশ অনুসারে প্রাসঙ্গিক সময় এবং তারিখের ঘটনার সম্পূর্ণ ভিডিও নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে বর্তমান মামলায় আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং আইনরক্ষাকারী হয়ে ঐ পুলিশ অফিস আবেদনকারীর মৌলিক অধিকার হস্তক্ষেপ করেছেন তাই এই আদালতের অনুমতি ব্যতীত ঐ পুলিশ অফিসার কে পুনর্বহাল না করার আদেশটি স্পষ্টভাবে করা হয়েছে’। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারকে এই বিষয়ে আরও সুষ্ঠু তদন্ত করতে এবং গত ৪ আগস্ট তারিখ থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে এই আদালতে রিপোর্ট পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আদালতের তরফে।পরবর্তী শুনানি বিচারপতি অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে হবে। আগামী ২৩ শে নভেম্বর এই মামলার পরবর্তী দিন ধার্য হয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct