বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম দেশগুলোর জোরালো উপস্থিতি নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মুসলিম দেশগুলো মূলত দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। বিশ্বের সব মুসলিম দেশ ওআইসির সদস্য হিসাবে একধরনের ঐক্যের সুতায় বাঁধা থাকলেও ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এমনই বিভাজন রেখা টেনে গেছে যাতে এক অপর দেশের শত্রুতার বীজ বপন হয়ে আছে। তাই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অনাগ্রাসন চুক্তির প্রস্তাব স্মরণীয় হয়ে উঠছে। এ িনয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
বর্তমানে বিশ্বব্যবস্থা এক নতুন ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠাণ্ডাযুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার পর, তার প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়নি। পেশা, আয় বণ্টনে বৈষম্য ও বাস্তুচ্যুত মানব প্রবাহে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের পরিস্থিতি মনে করিয়ে দেয়। বিদ্যমান একমেরু ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমের যে একতরফা আধিপত্য রয়েছে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে চীন ও রাশিয়া। এই চ্যালেঞ্জ শুধু সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বা আধিপত্যের ক্ষেত্রে সীমিত নেই। চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেটি শুরু হয়েছিল এবং যার পথ ধরে বৈশ্বিক বিনিময় মুদ্রা হিসাবে ডলারের একচ্ছত্র প্রাধান্য ও বাণিজ্য লেনদেনে তথ্য পরিষেবা ব্যবস্থা সুইফটের নিয়ন্ত্রক ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৩ সালে ব্রিকসের যাত্রার পরবর্তী দশক থেকে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণের উদ্যোগ গতি লাভ করে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার উপর পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার পর এই রূপান্তর প্রক্রিয়া দ্রুততা লাভ করে এবং রাশিয়া ও চীনের মধ্যে কৌশলগত মৈত্রী দৃঢ়তা পায়। রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো চরম অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর সুস্পষ্ট বিভাজন ও মেরুকরণ হয়। ৫ মাস ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির কোনো লক্ষণ এখনও নেই। তবে বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় একটি ফাটল ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম দেশগুলোর জোরালো উপস্থিতি নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মুসলিম দেশগুলো মূলত দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উদ্যোগ ছিল ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি গঠন এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। বিশ্বের সব মুসলিম দেশ ওআইসির সদস্য হিসাবে একধরনের ঐক্যের সুতায় বাঁধা থাকলেও ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এমনই বিভাজন রেখা টেনে গেছে যাতে এক দেশের সাথে আরেক দেশের শত্রুতার বীজ বপন হয়ে আছে। জাতিরাষ্ট্র হিসাবে অধিকাংশ দেশই উম্মাহর স্বার্থকে জাতি স্বার্থের পরে স্থান দেয়। এতে এক দেশের সাথে আরেক দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা, নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস এবং জাতিগত ধারণা ও বিশ্বাসের সূত্রে বিরোধ আরো গভীরে শিকড় ছড়ায়। এই বিভাজন এমনভাবে বজায় রাখা হয়েছে যাতে বৈরিতা মাঝে মধ্যে বৈশ্বিক সমরাস্ত্রশিল্প চাঙ্গা থাকার মতো যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়। আর জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশের পরিবর্তে এসব দেশ পশ্চিমের উপর নির্ভরশীল থেকে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকান ও এশীয় দেশগুলোর স্বাধীনতা লাভের সুযোগ ছিল, কারণ ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স দুর্বল হয়ে ঔপনিবেশিক শক্তি হারিয়েছিল। এসব অঞ্চলে পশ্চিমা প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। উপনিবেশবাদীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব দুর্বল। পশ্চিমের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে দেশেই হস্তক্ষেপ করেছে সেখানেই কখনো শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি। সঠিকভাবে কোনো কর্মসূচিও পরিচালনা করতে পারেনি। আফগানিস্তান বা ইরাকের অভিজ্ঞতা ছিল বিপর্যয়কর।
ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবিরোধ এসব দেশে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব ও দখল সহজতর করে। বর্তমানে সৌদি আরব ও ইরান পরস্পরকে হুমকি হিসেবে দেখছে। ইরান এবং তুরস্কের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হলেও তাদের মধ্যে আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার লড়াই সবসময় চলে। পাকিস্তানের সমস্যা ভারত থেকে উদ্ভূত। উপসাগরীয় দেশগুলো রয়েছে সৌদি আরবের অন্তস্তলে। কয়েক বছর আগে কাতার সঙ্কটে তারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। কুয়েতে ইরাকের আক্রমণ ও মার্কিন দখলদারিত্ব তাদের কারো পক্ষেই যায়নি। আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশে স্থিতিশীলতার সমস্যা আছে, প্রশাসনে রয়েছে দুর্বলতা। ইসলামী বিশ্বের জন্য দু’টি অস্তিত্বগত বিপদ অপেক্ষা করছে। প্রথমটি হলো ইসলামী বিশ্বের অভ্যন্তরীণ পতন। দ্বিতীয়টি হল ইসলামের অভ্যন্তরীণ ‘পতন’। এর সাথে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা উৎস, যেমন কুরআন এবং নবী মুহাম্মদ সা:-এর ঐতিহ্যের সাথে সংযোগ দুর্বল করা এবং সময়ের সাথে সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন করা জড়িত। অভ্যন্তরীণভাবে ইসলামিক বিশ্বকে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে নেয়া প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো সুন্নিবিশ্ব এবং শিয়াবিশ্বকে একে অপরের বিরুদ্ধে নিয়ে আসা। দেশগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করানো। ইসলামের মূল বিশ্বাস আদর্শের সুতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেয়া। এই ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অনাগ্রাসন চুক্তির প্রস্তাব স্মরণীয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct