নদী ভাঙনের রাত্রে
অশোক কুমার হালদার
ছোটন বর্মনের বাড়ি এক অজপাড়া গাঁয়ে, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী, আর নদীর ওপার থেকে বাংলাদেশ শুরু হয়ে গেল। এই পদ্মা নদীর সীমানা নির্দেশ করে দিয়েছে এপার বাংলা আর ওপার বাংলা। ছোটন বর্মন বিশেষ লেখাপড়া জানে না। ছোটন বর্মনের পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী স্বপ্না বর্মন এবং ছেলে চীনু বর্মন আর এক মেয়ে রাখী বর্মন। বাবা ও মা অনেক দিন আগেই দেহ রেখেছেন। পরম্পরা কর্ম সূত্রে ছোটন বর্মন ছোটবেলা থেকেই কৃষিকার্যে তার বাবার সহায়তা করতেন। কারণ পড়াশোনার প্রতি অত মন ছিল না। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগে তার বাবা দেহ রেখেছিলেন। আর স্কুলটা বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ছিল। বাবার মৃত্যুর পরে সংসারে আর কেউ অভিভাবক ছিলেন না। যার কারণে পরামর্শ বা বুদ্ধিদাতা বা সুনিপুন ব্যক্তির অভাবে জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। মানুষের মস্তিষ্ক বুদ্ধি ও জ্ঞানের আঁধার যেমন, তেমন আবার বাল্যকালে বা বালক সুলভ অবস্থায় সংসারে একজন সুপরামর্শদাতার প্রয়োজন। যার পরামর্শ এবং প্রেরণায় বাল্যকালে সঠিক পথে চালনা করা নির্দেশক হতে পারেন। কারণ বালক অবস্থায় অভিভাবকের খুবই দরকার। কারণ বালক জানে না যে কোন পথটা ভালো আর কোন পথ জীবনের পক্ষে নয়। কারণ সমাজ দর্শন বয়সের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম হয়। একজন প্রবীন ব্যক্তি সমাজের বিভিন্ন পথে চলার পরে বিভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। ঘর তৈরি যেমন ভিত্তি বা বনিয়াদের উপরে তৈরি হয়। তেমনি মানুষ অভিজ্ঞতার মূল তত্বের উপরে দাঁড়িয়ে অত্যাবশ্যক পথের সন্ধান করতে সমর্থ হন। ছোটন বর্মন জীবনের সবুজ বর্ণের দিনগুলি অর্থাৎ যুবক বয়স অতিবাহিত করে ধূসর বর্ণের জীবনে পা রেখেছেন। আর জীবনের চলার পথের গুরুত্ব উপলদ্ধি করছেন। এই ধূসর জীবনে প্রবেশ করে বর্তমানে অবস্থানকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কারণ তিনি বাল্য এবং যুবক বয়সের সমাজ দর্শনের গুরুত্ব বুঝতে পারেননি।
কারণ একদিকে অভিভাবকহীন ভাবে বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছে আর যুবক বয়সটা সমাজের নানা রকমের আকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকর্ষিত হয়ে বিমোহিত হয়েছিলেন। তখন মাঠে চাষবাস করা খাদ্যের জোগনোর জন্য এবং কোন ঘটনা প্রবাহের গুরুত্ব না বুঝে সেই ঘটনাকে সত্য বলে ধরার চেষ্টা করা বা আঁকপাঁক করে ধরতে যাওয়ার চেষ্টা। ছোটন বর্মন আজ এই বয়সে প্রবেশ করে ছেলেবেলার এবং যুবক বয়সের অতিবাহিত দিনগুলি যে কঠিন এবং জটিল ছিল কৌশলক্রমে পলায়ন করলো আমারই এই জীবন থেকে। সেটা ঠিক যেন মনে হয় জীবনের হিমবাহ গরমের কারণে গলে গিয়ে জল হয়ে বয়ে যাবার মতো ঘটনা প্রবাহ মাত্র। এযেন জীবনের এক ক্ষণিক দৃষ্টিপাতের মতোই এক অবস্থা মাত্র। মানুষের জীবন এই পৃথিবীতে আসে নানা রকম প্রতিভা দীপ্ত চোখ ঝলসানো নানা রঙের সৌন্দর্য্য নিয়ে ঠিক যেন প্রজাপতির পাখনার রঙের মতো রঙ নিয়ে। ছোটন বাবু নিজেই এই নিজের জীবনের অতিবাহিত দিনগুলি কোন কোন পথ বেয়ে এসেছিল আবার কোন পথ ধরে চলে গিয়েছে কে তার হিসাব রাখে। মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের হিসাব মাপিবার আদর্শ বা নমুনা সব কিছুই মন নামক যন্ত্রের কাছে লিপিবদ্ধ থাকে। মানুষের মন যন্ত্রের কাছে রয়েছে স্মৃতিশক্তি বা স্মরণ। মোবাইলে যেমন স্মৃতিশক্তি থাকে যেমন দুই জিবি, তিন জিবি, চার জিবি বা পাঁচ জিবি ইত্যাদি। আর একজন মানুষের মনের মধ্যে যে কত স্মৃতিশক্তি রয়েছে তার হিসাব এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। আর ভবিষ্যতের আবিষ্কারের আশায় রইলাম। আর নদী ভাঙ্গনের রাত্রে দাওয়ায় বসে ছোটন বর্মন স্মৃতিচারণ করছেন। আর সময়টা বর্ষাকাল। চারিদিকে মাঠ ঘাটে যেমন জল কাদা রয়েছে, তেমনি ওদিকে আবার পদ্মা নদীতে জলের পরিমাণ হুহু করে বেড়ে চলেছে। আর গ্রামের সমস্ত বাড়ির লোকজনই নিদ্রাহীন অবস্থায় যে যার বাড়িতে বসে বীনিদ্র রজনী নিশীযাপন করেছেন। কারণ নদীর জল ভেতরের মাটি কেটে দেওয়ার ফলে নদীর পাড় ভেঙে পরছে। নদীর পাড় ভাঙা খুব বিপদজনক অবস্থা যারা নদীর পাশ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস করেন তাদের জন্য।
এইভাবে নদী ভাঙ্গনের রাত কাটছে। এমত অবস্থায় ছোটন দাদা বাড়িতে জেগে আছেন এই কথা বলতে বলতে চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি এবং ভয় মিশ্রিত কণ্ঠস্বর নিয়ে নিশীত, ঐ পাড়ার ছেলে ছোটন বাবুর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। নিশীত ছোটন বাবু এবং তার পরিবারের সদস্যদের উদ্দশ্যে সতর্ক বাণী করে বললো আপনারা এবং বাড়ির ছেলে মেয়ে বা সকলে যেন সজাগ থাকে এই আসন্ন বিপদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। এই সময় ছোটন বাবু নিশীতকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে ভাই তুমি এখন কোথা থেকে আসছ, বাড়ি থেকে নাকি নদী ভাঙ্গনের পার থেকে। তখন নিশীত বললেন দাদা আমি নদী ভাঙ্গনের পার থেকেই সোজা আপানার বাড়ি এসে, ঢুকে পরলাম যে আপনারা সতর্ক রয়েছেন কী, না ঘুমিয়ে পরেছেন? গ্রাম অঞ্চলের মানুষজন খুব ভোরবেলায়, ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তারপর আপন আপন কাজে বেড়িয়ে পরে। যেমন খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে, তেমনি আবার সন্ধ্যার পরে পরেই যে যার মতো বিছানায় চলে যায়। এটাই গ্রামের মানুষের নিত্যদিনের কর্মসূচি। নিশীত বলছেন দাদা নদীর পাড়ে আমাদের গ্রামের অনেক মানুষজন রয়েছেন এবং বর্তমান পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছেন যে আমাদের গ্রামে ভাঙ্গনের প্রভাব পড়বে কী পড়বে না তার উপরে দেখভাল করে চলেছেন। যদি আমাদের এই গ্রামে ভাঙ্গনের প্রভাব পরে বা প্রভাব পরতে পারে। তাহলে গ্রামের মানুষজন সজাগ থাকলে মানুষজনের প্রাণ বাঁচানো তো সম্ভবপর হবে। এবার ছোটন বাবুর স্ত্রী স্বপ্না দেবী বলছেন যে আমি তো এই গ্রামে বহুদিন ধরে অর্থাৎ আমার বিয়ের পর থেকেই রয়েছি। আমি কিন্তু এই রকম ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন আগে কখন দেখিনি।স্বপ্না দেবীর এই কথা শুনে নিশীথ বলছেন যে এই বৎসর পাশ্ববর্তী জলাধার থেকে বেশী পরিমাণে জল ছেড়েছে তার উপর, বৃষ্টির পরিমাণও সর্বাধিক যার কারণে পদ্মা নদীতে এত জলের প্রাচুর্য্য। পদ্মা নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে তলার মাটি জলের স্রোতে ভেতরে ভেতরে কেটে যায়। তারপরে মাটির উপরিভাগে ফাটল দেখা দেয় আর ফাটল হওয়ার পরেই মাটির উপরিভাগে যে সমস্ত ঘর, বাড়ি, গাছপালা থাকে সবকিছুই নদী গর্ভে ভেসে চলে যায় সঙ্গে থাকে বিশাল তরঙ্গ এবং প্রচন্ড বেগের শব্দ। আর ঐ মুহুর্তে নদীর ঢেউয়ের ধাক্কা রক্ষা করার জন্য বা নিমিত্তে নদী বক্ষের উপরে বাঁধ নির্মাণ করলে, তবেই নদীর ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু আমাদের মতো কৃষিজীবী মানুষ যাদের নদীর পাশ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস, জীবন জীবিকার সাহারার কারণে। তাদের মাঝে মধ্যে বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয়, তখন নদী পারের মানুষজনদের নদীর হাত থেকে সাহস পূর্বক বাঁচার সাহস প্রদর্শন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। কিন্তু এই বিপদময় পরিস্থিতি সর্বক্ষণের জন্য থাকে না শুধুমাত্র বর্ষাকালের কয়েকটা দিন বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রত্যেকেই মানসিক সাহস প্রদর্শন করে বেঁচে থাকতে হবে। প্রকৃতির এই ভাঙ্গনের পরে আসে আবার নতূন সকাল নতূন আলোর শক্তি নিয়ে। কারণ প্লাবনের পরে জমির উর্বরতা বেড়ে যায়। ফসল ভালো হয়। পক্ষান্তরে একটা রাত্রি নদী ভাঙ্গনের জন্য বিনিদ্র কাটাতে হবে। ইহাই নীতি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct