ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ একটি বহু আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ,বেশির ভাগ আলোচনা বা বর্ণনা পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের কলমে এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই লেখা, সেগুলি যে নিরপেক্ষ নয় এরকম বলার সাহস না দেখানোই ভাল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্থিত জনৈক চর্চাকারী ঐতিহাসিকের এ বিষয়ে লেখা বই ‘The Crusades Thrugh Arab Eyes’ উল্লেখ্যযোগ্য। বইটির লেখক Amin Malouf জর্ডনের লোক। এখন থাকেন প্যারিসে। এবিষয়ে দু চার কথা বলা দরকার। লেখক নিজেই epilogou হিসেবে লিখেছেন। তার বঙ্গানুবাদ করেছেন আব্দুস শুকুর।
প্রকৃতপক্ষে যুবেরের প্রতিক্রয়া আরও মনোযোগের সাথে পরীক্ষার যোগ্য ছিল যদিও বিদেশী ‘অভিশপ্ত শত্রুদের’ মধ্যেও ও অনেক ভাল/positive/ গুনগুলির কথা স্বীকার করার সাহস দেখিয়েছেন, এবং এ ব্যাপারে শপথ করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন কারন তিনি বিশ্বাস করতেন ফরাসীদের এই সাম্যভাবনা সুন্দর প্রশাসনিক দক্ষতা মুসলমানদের নৈতিকতার উপর মারাত্মক বিপদ হিসেবেই দেখা হবে, এমন কি তারা স্বধর্মীয়দের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পার এবং নিজ ধর্মের থেকেও যদি ফরাসী সমজের ভাল গুনগুলি তারা দেখতে পায়। বিখ্যাত ভ্রমনকারীর এই দৃষ্টিভঙ্গী এখন যতই বোধগম্য হোক ,ক্রুসেডের সমস্ত সময়কালধরে তার সমমনস্কদের ইহা সাংকেতিক আক্ষেপ বলেই ধরতে হয়। এই কষ্ট তাদের ছিল; ধর্মযুদ্ধের সমস্ত সময় জুড়ে আরবরা তাদের হৃদয় ও মন পশ্চিমের ধারনাগুলির কাছে উন্মুক্ত করেনি,সম্ভবতঃ তাদের উপর ফরাসী আক্রমনের ইহাই ছিল সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব, ইহার শিকার আরবরাই হয়েছিল। আক্রমনকারীরা আক্রান্তদের ভাষা শিখেছিল কিন্তু আরবরা ফরাসীদের ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ দেখায়নি,বরং শেখাটা অপমানজনক ভেবেছিল বিশ্বাসঘাতকতা ভাবতো। বহু ফরাসী আরবি শিখেছিল,কিন্তু গুটি কয়েক খ্রীষ্টান ছাড়া কেউ আগ্রহ দেখায়নি।
অনেক উদাহরন দেওয়া যায়,সর্ব ক্ষেত্রেই ফরাসীরা আরবদের কাছে বহু কিছু শিখেছিল। সিরিয়া, স্পেন, সিসিলির স্কুলগুলিতে তারা যাহা শিখেছিলো পরবর্তী জীবন যাপনে সেগুলির অবশম্ভাবী বিশাল ভূমিকা ছিল, আরবদের মাধ্যমেই প্রাচীন গ্রীসের জ্ঞানভান্ডার তাদের কাছে পৌছেছিল। অনুবাদক,উন্নয়ক ও উদ্ভাবক,সব হিসেবেই। মেডিসিন,জোতির্বিদ্যা,রসায়ন,ভুবিদ্যা,গনিত এবং স্পাথ্য/architecture/ এর জ্ঞান আরবী বই থেকেই নিয়েছিল। শিখেছিল এবং উন্নত করেছিল। বহু শব্দ যেমন—নাদির,জেনিথ,আজমুৎ আ্যলজেব্রা,এলগারিদম,সাইফার প্রভৃতি। কাগজ তৈরি চাড়ার কাজ,কপড় সূতা,চিনি ও এলকোহল পদ্ধতি ফরাসীরা শিখলো এবং উন্নত করল , কৃষির ব্যাপক উন্নতি ফরাসীরা মধ্যপ্রাচ্য থেকেই অর্জন করেছিল। আখরোট aubergines,scallions,কমলা তরমুজ,বহুবিধ শব্দ আরবী থেকেই ইঊরোপে পৌঁছেছে। ক্রসেড পরবর্তী পশ্চিম ইউরোপে প্রকৃত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্থান হয়েছিল কিন্তু প্রাচ্যে এই ধর্মযুদ্ধে উল্টো ফল হয়েছিল,দীর্ঘকালীন অবক্ষয়,অস্পষ্টতা/obscurantism/ ঘনিয়ে এসেছিল,সব দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে ইসলামী জগৎ পিছু হঠতে শুরু করে বহির্জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে,পিছু হঠতে শুরুকরে। মুসলিম জগৎ বিছিন্ন হতে শুরু করে।মুসলমানদের কাছে উন্নতির চিহ্ন হয় অন্য লোকদের,মুসলমানদের ছাড়া। আধুনিকতা মুসলিমদের কাছে অপরিচিত শব্দ হয়ে যায়। আধুনিকতা বাদ দিয়ে কি ধর্মীয় ও সাস্কৃতিক পররচিতি বাঁচানো যায়,আধুনিকতা পশ্চিমাদের সাথেই মানায়,মুসলমানদের সাথে বেমানান এরকম ধারনা তৈরী হয়ে যাতে ক্ষতিই হল ইসলামী সভ্যতার।
বিপরীতে Identity বা পরিচিতি হারাবার ভয়কে বাজী রেখে দৃঢ়তার সাথে আধুনিকতার বাজী ধরলে ভালই হত সম্ভবতঃ।ইরান সহ সমস্ত আরব জগৎ এই সঙ্কটের সমাধান করতে পারেনি। এমনকি এখনও পাশ্চ্যাত্যের চাপিয়ে দেওয়া অতি আধুনিকতা নাকি অতি সংস্কার বিমুখ মানসিকতার দোলাচল কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছেনা। আরব জগৎ ফরাসী আক্রমনে বিব্রত ও সন্ত্রস্ত হয়ে, তাদেরকে বর্বর হিসৈবে মোকাবিলা করেছিল ও পরাজিত করেছিল,কিন্তু কিন্তু পরে পরেই পরাজিতরাই জগতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, ক্রুসেড কালকে অতীত বলে ছেড়ে দিয়েছিল। বিপরীতে,সাতশ বছর পরেও এই ঘটনার প্রতি মুসমানদের প্রতিক্রিয়া অবাক করার মত । তৃতীয় সহস্রাব্দের মুখেও মুসলিম নেতারা ,অনেক সাধারন মানুষও জেরুজালেমের জয় পরাজয়, সালাদিনের বীরগাথা এখনও স্মরন করে, ইস্রাইল এখন নুতন আক্রমন কারী,প্যালেষ্টাইন লিবারেশন আর্মির তিন বৃতান্ত একটি র নাম হিততিন, অন্য আইন জালুত, মিশরের নাসেরকে একসময় সালাদিনের সাথে তুলনা করা হচ্ছিল,ইস্রয়েলের সাথে যুদ্ধের সময় নাসেরই সিরিয়া ,মিশরকে একত্রিত করেছিলেন সালাদিনের মতই, এবং ইয়েমেন। ১৯৬৫ সালে ফ্রান্স ইল্যান্ডের যৌথ সুয়েজ আক্রমনকেও ১১৯১ এর ক্রসেড মনে করা হচ্ছিল স্বীকার করা দরকার এইসব তুলনা অনেক সময় এ গোলমেলে, বর্তমানের ঘটনা.মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের কথা না ভাবা আশ্চর্যের যখন ইবন আল জাউজি দামাস্কাসের লোকদেরকে কায়রোর মেয়র আল কামিলির বেইমানি নিয়ে আলোচনা করতে দেখি,কামিলি পবিত্র নগরীতেও শত্রদের অধিকারকেও স্বীকৃতি দেবার স্বাধীনতা দেখায়। বর্তমান ও অতীতের তুলনাও লোভনীয় হয় যখন গোলান হাইটস বা বেকা উপতক্যার অধিকার নিয়ে জেরুজালেম ও দামাস্কাসের মধ্যে ঝগড়া দেখি।আক্রমনকারীদের সামরিক শক্তির প্রধান্য নিয়ে ঊসামার চিন্তাকে দিবা স্বপ্ন নাভাবা শক্ত। মুসলিমরা এখন যখন প্রায়ই আক্রমনের শিকার, ‘আমরা আক্রমনের লক্ষ’ এ ভাবনা আটকানো অসম্ভব। এ ভাবনাই কিছু কট্টর মনে বিকৃত ধারনার জন্ম দেয়,তুর্কী মোহম্মদ আলি আগা ১৯৮১ সনে পোপকে গুলি করার চেষ্টা করেন।আগাএকটি চিঠিতে আগা বলেন আমি পোপ জন পল ২কে মারতে চেয়েছিলাম ক্রুসেডের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে এই চিঠিই স্বাভাবিক শত্র্রতার ইঙ্গিত দেয়,শত্রর বিরদ্ধে রাজনৈতিক, সামরিক, তেল সংক্রন্ত বিবাদ স্বাভাবিক প্রতিশোধ স্পৃহার থেকেও বেশী তীব্র হয়। কারণ লুকিয়ে আছে ক্রসেডের মধ্যেই। এমনকি এখনও। আফগানিস্থান আক্রমণের আগে প্রেসিডেন্ট বুশের একটি অসতর্ক উচ্চারন এ ধারনার সমর্থন দেয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct