মোবাইলের গেমসের আসক্তিতে হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল শৈশব
“বাবা, ভাত দিয়েছি- খেয়ে নে “ ছেলে শুনে উত্তরে শুধু বলছে -’ হু ‘। মা অনেক ক’বার বলে যখন দেখছে বারে বারে ছেলের কাছ থেকে একই রকম উত্তর আসছে। তারপরে ছেলের দিকে লক্ষ্য করে দেখছেন যে,তাঁর ছেলে মাথা নিচু করে এক মনে মোবাইলে গেম খেলে চলেছে। বার বার বলার পরে ছেলে যখন কথা শুনল না,মা তখন বাধ্য হয়ে মোবাইলটা কেড়ে নিলেন। ফলে ছেলে রেগে গিয়ে জিনিস পত্র ছুঁড়তে শুরু করে দিল। এই লক্ষণ দেখে বলাই যায় যে,ছেলে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে খুব সহজে হাতের নাগালে পাওয়া স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রযুক্তির এক অদ্ভুত চক্রের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। যুদ্ধ, ধংস্ব, অস্বাভাবিক গতি নির্ভর গেমস গুলো তাদের মনে জগতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সেই কারণেই শিশুদের নানা রকম ঝুঁকি প্রবণ আচরণের প্রবণতা বাড়ছে। আজকাল অনেক বাড়ীতেই শিশুরা রাত জেগে মোবাইলের গেমস খেলতে ব্যস্ত থাকছে। অনেকটা সময় ধরে গেমস খেলার ফলে শিশুদের উপরে নানা রকম কুপ্রভাব পড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল শৈশব। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিশুদের মনোসংযোগ। অস্বাভাবিক দ্রুত গতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মস্তিষ্ক এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে শিশুরা সহিংস এবং ঝুঁকি পূর্ণ আচরণের প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই সমস্যা গুরুতর তার মধ্যে কোভিডের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের সময় কাটছে না। এক ঘেঁয়েমিতে হাঁপিয়ে উঠছে। বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ দিন দেখা নেই। একসাথে খেলা নেই।প্রাণ খুলে গল্প নেই। মানসিক একটা অস্বস্তি রয়েইছে। ফলে আরও বেশি করে গেমসের প্রতি শিশুদের আসক্তি বাড়ছে। অনেক সময় বাবা মায়েরাও শিশুদের বিরক্তির হাত থেকে বাঁচতে মোবাইল দিয়ে বাচ্চাদের বসিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকছেন অথবা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকছেন। তবে সব বাবা মা যে এমনটা করেন, সেটাও নয়। মোবাইলে গেমস খেলার কারণে শিশুদের শুধু যে মনোসংযোগ নষ্ট হচ্ছে এমনটাও নয়। এছাড়া আরও নানাবিধ সমস্যা মাকরসার জালের মত ঘিরে ধরছে শৈশব কে। সারা দেশে কচ্ছ থেকে কোহিমা, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা ছবিটা প্রায় একই রকম। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। সেই ভবিষ্যত যদি এমন করে প্রযুক্তির অন্ধকারে তলিয়ে যায়, তাহলে দেশের ভবিষ্যতে র কি হবে ? আবার যে বাবা মায়েরা শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছেন,সেই স্বপ্নেরই বা কি হবে ?
শিশুদের অধিকাংশ সময় ধরে গেমস খেললে চোখের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলের স্কিনের দিকে অধিকাংশ সময় তাকিয়ে থাকার ফলে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা তৈরী হতে পারে। আবার রাত জেগে অধিক সময় ধরে গেমস খেললে ঘুমের অনিয়ম হয়। ফলে অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ,মাথা ব্যথা,ঘাড় ব্যথা ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও অনিদ্রা সহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার গেমস নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে শিশুরা অন্যদের সাথে কথা বলার সময় পায় না এবং খেলাধূলা করার তার কোনো সময় হয় না। এই কারণে আজকাল শিশুদের সামাজিক দক্ষতা কমে যাচ্ছে এবং সে ধিরে ধিরে অসামাজিক হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতে সমাজের পক্ষে অপ্রীতিকর। অপর দিকে যে বয়সে বাচ্চাদের হেসেখেলে ছুটে বেরিয়ে খেলাধূলা করার কথা সেই বয়সে তারা বসে বসে গেমস খেলার কারণে শিশুদের শরীরে মেদ জমে সে স্থূলকায় হয়ে উঠছে। ফলে নানা রকম রোগব্যাধি শিশুর শরীরে বাসা বাঁধছে। এখানে মোবাইল গেমসের দ্বারা সৃষ্ট শিশুদের জীবনে নানা ধরণের সমস্যার কথা আলোচিত হলো। কিন্তু সমস্যা যখন আছে তার সমাধানও নিশ্চই আছে। শুধু সময় থাকতে একটু আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করতে হবে। প্রথমত শিশুরা যাতে অধিক ক্ষণ গেমস খেলতে খেলতে আসক্ত হতে না পারে সে দিকে বাচ্চাদের বাবা এবং মাকে কড়া নজর রাখা দরকার। তবে একথাও মাথায় রাখতে হবে যে,এক্ষেত্রে শাসনের ফল ভালো নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কতগুলি ছোটো ছোটো পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমস্যা সমাধানের দিকে যাওয়াটা উচিত বলেই মনে হয়। আজকাল যান্ত্রিক নাগরিকতার দরুন আমরা সবাই ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছি। সন্তান কি করছে, আমরা এটা খেয়াল রাখছি না। খেয়াল রাখতে হবে শিশুর হাতে কতক্ষণ মোবাইল রয়েছে। কিছুক্ষণ হলেই তার মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এসব কাজের জন্য আমাদের সবার প্রথমে বাচ্চাকে দেবার জন্য সময় বের করতে হবে। পাশাপাশি বাবা- মাকে দায়িত্ব নিয়ে বাচ্চাদের বই পড়ার দিকে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি বয়সের সাথে সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন রকম বই কিনে দিতে হবে। এর সঙ্গে শিশুদের বিভিন্ন মহাপুরুষের জীবনী গল্পের আকারে শোনাতে হবে।
শিশুদের সময়ের মূল্য বোঝানোর চেষ্টা করাটাও ভীষণ ভাবে জরুরি। তাদের বোঝাতে হবে যে সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। মনোগ্রাহী করে এটাও বলতে হবে যে, সময় এমন একটা জিনিস সে একবার চলে গেলে আর কোনোদিন ফিরে আসে না- আর সেই কারণে সময় নষ্ট করে গেমস খেলা উচিত নয়। একদিনেই গেমসের প্রতি আসক্তি কখনই দূর করা সম্ভব নয়। তবে এক্ষেত্রে ধৈর্য হারালে চলবে না। প্রথমে তাদের সময় গেমস খেলার সময় বেঁধে দিতে হবে। তারপরে ধিরে ধিরে সময়টাকে কমিয়ে আনতে হবে। শিশুদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে হবে। এমন টাও বলতে হতে পারে-” তুমি সারাদিনে এক ঘন্টা গেমস খেলতে পারবে “। এই ভাবে ধিরে ধিরে সময়টা কমিয়ে আনতে হবে। ছুটির দিন গুলিতে বাচ্চাকে ফাঁকা ছেড়ে না দিয়ে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। মুক্ত বাতাস ও খোলা আকাশের নিচে তাদের হৈহুল্লুর করে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। শুধু এই টুকুই যথেষ্ট নয়। শিশুর মধ্যে সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য তাকে ছবি আঁকা,গান,আবৃত্তি প্রভৃতি শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও তাদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হাতের কাছে যে সকল বিজ্ঞানের পরীক্ষা গুলি সম্ভব সেদিকে উৎসাহিত করতে হবে। মোবাইলের বদলে যথা সম্ভব বিজ্ঞানের বাক্স শিশুদের হাতে তুলে দিতে হবে। এখন কোভিডের কারণে বাইরে না গিয়ে ঘরেই বসেই যথা সম্ভব চেষ্টা করতে হবে। কোভিড চলে গেলে বাইরের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সকল সময়ে একটা কথা মনে রাখা অবশ্যই দরকার যে, অতি শাসন নয় -ভয় দেখিয়েও নয়, ভালো ভাবে বুঝিয়ে শিশুকে মোবাইল গেমসের আসক্তি থেকে রক্ষা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা শিশুদের সাথে খোলামেলা ভাবে মিশতে গেলে আমাদেরকেও প্রথমে শিশুর মত হতে হবে। শিশুরা যেন আমাদের ভয় না পেয়ে বন্ধু ভাবে। এই ভাবে শিশুর আত্মার সাথে সম্পর্ক গড়ে হতে হবে তার পরম আত্মীয়। যদি এই সমস্ত কাজ করা যায় তাহলে শিশুর শৈশব যেমন ফিরে পাবে তেমনি তারা ধিরে ধিরে দেশের সম্পদ হিসেবেও গড়ে উঠবে। এতে শুধু আমরা নিজেরাই না গোটা দেশ সমগ্র জাতি উপকৃত হবে।
শিক্ষক এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক: সনাতন পাল
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct