অবশেষে
সনাতন পাল
_____________
ত্রিশ বছর বয়স হলো, কোনো দিন কোনো বড়লোকের মেয়ের মুখের দিকে ভালো করে চোখ মেলে দেখিনি। মা ছোটো বেলা থেকেই একটা কথা পৈঁই পৈঁই করে বলতেন, “ দ্যাখ বাবা, কখনও কোনো বড়লোকের মেয়ের মুখের দিকে তাকাবি না, সহজে কথাও বলবি না “। একবার মা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন মা ? কিন্তু মা সেই কথার পুরো ব্যাখ্যা দেননি, শুধু বলেছিলেন, “ যা করলে তোর ভালো হবে,সেটাই করতে বলেছি, আর একটু বড় হলে নিজেই সব বুঝতে পারবি”। সত্যি কথা বলতে সেদিন কিন্তু মায়ের এমন বলার কারণ খুঁজতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি, শুধু মনে হয়েছিল, মা যখন বলছেন, তখন ভালোর জন্য ভাবনা চিন্তা করেই বলছেন, মায়ের কথা না শুনলে খারাপ হতে পারে। তাই তো পড়ার ব্যাচের শর্মিষ্ঠাকে ভীষণ ভালো লাগলেও তার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে খুব ইচ্ছে করলেও কখনও চোখ মেলে ভালো করে মুখ খানা দেখা হয়নি। বয়স তখন সবে ষোল, কিন্তু মনের সেই ইচ্ছে কে মায়ের কথাকে মান্যতা দিতে গিয়ে অসহায়ের মতো হত্যা করার চেষ্টা করেছি । কিন্তু ভাবনা কে কি আর কখনও চাপা দেওয়া যায়! বারে বারে মনের মাঝে উঁকি মারতেই থাকে । তখন আমাদের শহরের সিনেমা হলে উত্তম কুমার- সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমা- ‘ সাগরিকা’ মহা সমারোহে চলছে। বন্ধুরা সিনেমা দেখার কথা বলতেই রাজি হয়ে গেলাম। সেদিন ইভিনিং শো সিনেমা দেখে বাড়ী ফিরে এসে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল! মা খাবার দিলেন, আমিও হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে গেলাম, কিন্তু খাবার কিছুতেই গলা দিয়ে নামল না। ঐ ভাবেই খাবার পাত ছেড়ে উঠে গেলাম। ঐ দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে, খেলি না যে, কি হয়েছে ? “ বললাম ,”আমার খিদে নেই, এখন ঘুমাবো। এবার বিছানায় গিয়ে আর কিছুতেই ঘুম আসছে না। শুধু পাশ ফিরছি আর বারে বারে পড়ার ব্যাচের শর্মিষ্ঠার মুখ খানা ভেসে উঠছে সাথে ‘সাগরিকা’ সিনেমার কিছু কথাও মনে পড়ছে। ভাবতে ভাবতে যখন রাত গভীর হলো, তখন বুঝলাম ,মন নিরিবিলিতে বসে শর্মিষ্ঠার কথা ভাবতে চাইছিল, মনের তাড়াহুড়োতে আমার ঐ খাবার ছেড়ে ওঠে আসা । বেশ কিছুক্ষণ পরে কোকিলের ডাক কানে এলো। জানালাটা খুলে দেখি রাতের অন্ধকার কেটে গেছে ,দিনের আলো ধীরে ধীরে ফুটছে। বিছানা ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি সবাই এসেছে, শুধু শর্মিষ্ঠা আসেনি, কেউ যদি কিছু ভাবে ! সেই ভয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না, অথচ মনটা খুব ছটফট করছে । কোথাও দেখা না পেয়ে সেদিন বিকেলে শর্মিষ্ঠাদের বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে ঘোরা ফেরা করতেই খানিকটা দূর থেকেই দেখলাম, চুল ছেড়ে দিয়ে সে বাইরের বারান্দায় বসে আছে। বাড়ীর পাশ দিয়েই গেলাম, খুব তাকাতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু খুব কষ্ট করেই ইচ্ছে টাকে দমিয়ে পাশ কাটিয়ে ওর দিকে না তাকিয়েই চলে গেলাম। সে হয়তো ঐদিক দিয়ে তখন আমার যাবার কারণটাও বুঝতে পারল না। যদি তেমন চাউনিতে তার দিকে তাকাতে পারতাম এবং যদি চোখে চোখ পড়ত তাহলে আমার ঐ দিক দিয়ে যাবার কারণটা সে নিশ্চই অনুমান করতে পারত।
এমনি ভাবেই চলতে চলতে স্কুল ছেড়ে একটা সময়ে কলেজে এলাম, তারপরে কিছুদিন বাদে পড়াটাও শেষ হয়ে গেল । কাজের সন্ধান করতে করতে কবে ছাব্বিশ পেরিয়ে গেছি ,বুঝতেই পারিনি। কিছু দিন পরে হঠাৎ করেই আমার প্রিয় বন্ধু পল্টু এসে বলল, “ আঠাশে ফাল্গুন শর্মিষ্ঠার বিয়ে” । শর্মিষ্ঠার উপরে আমার দুর্বলতাটা পল্টু বেশ ভালো করেই জানত। পাত্র প্রাইভেট ফার্মে মোটা মাইনের চাকরি করে, বাড়ীতে মা, বাবা এবং এক অবিবাহিত দিদি রয়েছেন। অবশেষে এলো সেই আঠাশে ফাল্গুন, পল্টু কে বললাম, “সাতপাকের সময়ে আমাকে একটু শর্মিষ্ঠা দের বাড়ীতে নিয়ে যাবি?” পল্টু বলল, “আমি ওসব ঝামেলায় জড়াতে পারবো না, বাপু”। আমি বললাম, “দ্যাখ ভাই, আমি ওর দিকে সরাসরি তাকাবো না, শুধু দূর থেকে একটু শেষ বারের মত দেখেই চলে আসবো । আর কেউ না জানুক, তুই তো জানিস, আমি বড়লোকের মেয়ের মুখের দিকে সরাসরি তাকাই না!” অনেক অনুরোধ করার পরে পল্টু বলল,” দ্যাখ সাগর, যেতে পারি কিন্তু ওখানে গিয়ে একদম সিনক্রিয়েট করবি না “। আমি বললাম- “একদম নয়”। অবশেষে শর্মিষ্ঠার সাতপাকের ঠিক আগের মুহূর্তে গিয়ে পৌঁছালাম। খানিকটা দূর থেকেই দেখলাম সেই লাল টুকটুকে বেনারসী পড়ে পান দিয়ে মুখ আড়াল করে পিঁড়িতে বসে চার জনের হাতের উপর করে বিয়ের কনে বেরিয়ে এলো। কি অপরূপ সুন্দর লাগছিল, আমি যে একটু চিৎকার করে বলবো-” দারুন লাগছে “ এটা বলার কোনো উপায় ছিল না। সেই দিন মনে যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম ইতিপূর্বে কখনও তেমন পরিস্থিতি হয়নি। চোখ দুটো ছল ছল করা দেখেই পল্টু বলল, “ চল্, বাড়ী যাই”। খানিকটা জোর করেই হাত ধরে টানতে টানতে পল্টু আমাকে নিয়ে চলে এলো। সাগরের চোখের সামনে দিয়ে শর্মিষ্ঠা পরের ঘরে চলে গেল।
বছর চারেক পর পাড়াতে লোক মুখে শুনলাম- শর্মিষ্ঠা শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একবারে বাপের বাড়িতে চলে এসেছে। পরের দিন বিকেলে শর্মিষ্ঠা দের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেই দেখি সে বাইরের বারান্দায় বসে আছে । কাছে গিয়ে এই প্রথম সরাসরি মুখের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, তার ডান গালটা ক্ষতবিক্ষত। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলল , “অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়েছে “। দেখে সেই বিয়ের রাতের মতোই মনে কষ্ট লাগল। শর্মিষ্ঠার মুখে শুনলাম- ও আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরবে না। বাড়ীতে এসে মায়ের সঙ্গে ভীষণ রাগারাগি হলো। বললাম , “ তোমার জন্যই শর্মিষ্ঠার এই দূরাবস্থা। তুমি যদি আমাকে বার বার করে বড়লোকের মেয়েদের থেকে সাবধান না করতে, তাহলে আমি শর্মিষ্ঠার এই বিয়ে হতেই দিতাম না, একটা কিছু কাজের ব্যবস্থা করে আমিই ওকে বিয়ে করতাম।” মা শুনে বললেন- “যদি শর্মিষ্ঠা বিয়ে না করতে চাইতো, তাহলে কি করতিস?” আমি বললাম,” সে না হয় তখন ভাবা যেত”। ছেলের অবস্থা দেখে মা বললেন, “বেশ তো, এখন শর্মিষ্ঠাকে গিয়ে মনের কথা বল। তুই যদি ওকে বিয়ে করিস, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।” মনে মনে ভাবলাম যাক, এতোদিনে মা আমার মনের কথাটা বুঝেছে। তারপরে শর্মিষ্ঠাকে গিয়ে সরাসরি বললাম, “ আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং বিয়ে করতে চাই, রাজি আছো কি না বলো? একথা আমি আগে মনে মনে বহুবার ভেবেছি কিন্তু বলতে চেয়েও বলতে পারিনি।” কথা শুনে শর্মিষ্ঠা বলল-” বাবা, মা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন, তবে এ বিষয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি এ বিষয়ে আগে না বলে ভালোই করেছো। কারণ আমি তখন আপত্তি করতাম। তখন দেখতে সুন্দর ছিলাম, বাবারও টাকার তেমন অভাব ছিল না। ভালো ঘর-বর কে চায় না বলো! এখন আপত্তি করবো না, এখন মুখটাও ঝলসে গেছে- ক্ষতবিক্ষত। আবার বাবারও বয়স হয়েছে। এখন একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করতেই হবে। কিন্তু স্বামীর ঘর ছেড়ে এসেছি, আমাকে আর কে বিয়ে করতে রাজি হবে?” শর্মিষ্ঠার কথা শুনে মনে মনে ভাবলাম এই জন্যই মা হয়তো বড় লোকের মেয়েদের দিকে তাকাতে এবং কথা বলতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু ও সত্যি টাকে স্বীকার করেছে। শর্মিষ্ঠা মুখে যেটাই বলুক না কেন, তার কথা শুনে আমার কোনো রাগ হয়নি- কারণ আমি ওকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসি। এখন আমার সাথে বিয়েতে আপত্তি নেই বলেছে, সেটুকুতেই শান্তি। বাড়ি এসে মাকে বললাম ওর বাবার সাথে কথা বলতে । পরের দিন মা ওর বাবাকে বলতেই রাজি হয়ে গেল। তারপরে আইনি মতে বিবাহ বিচ্ছেদ হতেই আমাদের বিয়ে হলো। দিন বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ করে শর্মিষ্ঠা একদিন জ্ঞান হারালো। ডাক্তার বাবু রক্ত পরীক্ষার রির্পোট দেখে বললেন-” ওর লিউকোমিয়া হয়েছে, মাত্র কিছু দিনের অতিথি, সে।” শুনে চোখে জল এলো। তার কিছুদিন পরে একদিন ডাকছি,” শর্মিষ্ঠা শুনছো! এই শর্মিষ্ঠা, শর্মিষ্ঠা... !” কিন্তু কথার উত্তর এলো না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct