নো ডলার। নো ডিজেল। নো ইলেকট্রিসিটি। নো ফুড। শ্রীলঙ্কার একজন প্রাক্তন ডিপ্লোম্যাটের কাছে বর্তমানে তার দেশের পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি ওপরের কথাগুলোই বললেন। আর এই ডলার, ডিজেল, ইলেকট্রিসিটি ও ফুড না থাকার ফলে আজ দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছে— প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনের বিক্ষোভ ঠেকাতে। পরিবারতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিণাম ভুগতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে। সেই পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন স্বদেশ রায়। আজ প্রথম কিস্তি।
নো ডলার। নো ডিজেল। নো ইলেকট্রিসিটি। নো ফুড। শ্রীলঙ্কার একজন প্রাক্তন ডিপ্লোম্যাটের কাছে বর্তমানে তার দেশের পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি ওপরের কথাগুলোই বললেন। আর এই ডলার, ডিজেল, ইলেকট্রিসিটি ও ফুড না থাকার ফলে আজ দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছে— প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনের বিক্ষোভ ঠেকাতে। পূর্ব এশিয়ার একটি দেশে কর্মরত একজন ডিপ্লোম্যাট নাম প্রকাশ না করার শর্তে (যেহেতু তিনি সরকারি চাকরিতে আছেন) বললেন, আসলে জরুরি অবস্থা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে যা ঘটেছে তাকে কেবল আরব স্পি্রংয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আর মানুষ সংগঠিত হয়েছে মূলত টুইটারসহ সব সোশ্যাল ফোরামের মাধ্যমে। তাও বিদু্যতের অভাবে অধিকাংশের সেল ফোন অকার্যকর হয়ে যাওয়া, ইন্টারনেট কাট হয়ে যাওয়া হয় বলে কিছুটা লোক কম হয়েছে। নইলে সেখানে আরো মানুষ হতো। তার পরও মানুষের মুখে মুখে ও সোশ্যাল ফোরামে ঐ এক স্লোগান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ের বিরুদ্ধে— ‘গো হোম গোটাবায়ে, অ্যান্ড ফ্যামিলি রুল।’ (গোটাবায়ে বাড়ি যাও, পরিবারতন্ত্র শেষ হোক) শ্রীলঙ্কার সিংহলি, তামিল, মুসলিম সবাই এখন গোটাবায়ের এই পরিবারতন্ত্রের, অর্থাৎ এক ভাই প্রেসিডেন্ট, এক ভাই প্রধানমন্ত্রী, এর অবসান চায়। এমনকি তাদের দলের নতুন জেনারেশান শিক্ষিত নেতারাও অবসান চায় এই পরিবারতন্ত্রের। তাদের বক্তব্য হলে, এই পরিবারতন্ত্রের কারণে, কেবলই অযোগ্যদেরকে জোগাড় করা হয়েছে রাজনীতিতে।
শ্রীলঙ্কার একজন তরুণ রাজনীতিবিদ ও থিংকট্যাংক মি. শচিন্তা আবেসুরিয়া, যিনি রাজনীতির ওপর উচ্চতর গবেষণা করছেন এখন অস্ট্রেলিয়াতে, তার বক্তব্য হলো, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিটাই চলে গেছে অযোগ্য ও অশিক্ষিতদের হাতে। তার দল যদিও এই সরকারের কোয়ালিশনে আছে, তার পরেও তিনি মনে করেন এই সরকার বা পার্লামেন্টে এমন একজনও নেই, যিনি প্রকৃত বিশ্লেষণ করে বিদেশি ঋণ ও প্রজেক্ট গ্রহণ করতে পারেন। তার বক্তব্য হলো, আমাকে দেখতে হবে প্রথমে কোন প্রজেক্ট থেকে সত্যি সত্যি আয় হবে দেশের। যার ভেতর দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অর্থের জোগান বাড়বে। সেই ধরনের প্রজেক্টই একটি দেশ গ্রহণ করবে এবং তার বিপরীতে ঋণ নেবে। কিন্তু তার বদলে শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটা পোর্ট, মাট্টালা এয়ারপোর্ট, লোটাস টাওয়ার, স্টেডিয়াম প্রভৃতি যে প্রজেক্টগুলো চায়নার কাছ থেকে উচ্চ ঋণ নিয়ে করা হয়েছে, এগুলোর কোনোটাই অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে কোনো অর্থের জোগান দিতে পারছে না। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি অনেক দিন থেকে ভালো যাচ্ছিল না। তাদের ফরেন রিজার্ভ-সংকট মূল সমস্যা। যখন তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঋণ নেয় ফরেন রিজার্ভের জন্য, তখনই গোটা পৃথিবী বুঝতে পেরেছিল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দ্রুত খারাপের দিকে যাবে। তার পরও এ মুহূর্তে কেন এই অবস্থা ঘটল? এ প্রসঙ্গে আবেসুরিয়া ও শ্রীলঙ্কায় কর্মরত একজন পশ্চিমা ডিপ্লোম্যাটের বক্তব্য মোটামুটি একই রকম। শ্রীলঙ্কার এক্সপোর্ট থেকে মোট আয় বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার। তাদের ডিজেলসহ অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করতে হয় বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ তাদের প্রতি বছর আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার ঘাটতি ১০ বিলিয়ন ডলার। আবেসুরিয়ার মতে, এই ১০ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি মূলত পূরণ হয় পর্যটনের আয় ও প্রবাসী শ্রমিক ও অনান্য শ্রীলঙ্কানের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। পর্যটন থেকে আসে ৩ বিলিয়ন ডলার এবং রেমিট্যান্স থেকে আসে ৬ বিলিয়ন থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। এবার কোভিডে ইতালি ও অস্ট্রেলিয়াসহ যেসব দেশে শ্রীলঙ্কানরা বেশি কাজ করে, তাদের প্রায় সবাইকে ফিরে আসতে হয়েছে। সরকার তাদের অন্য কোথাও পাঠাতে পারেনি এবং উদ্যোগও নেয়নি। অন্যদিকে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, যেখানে শ্রীলঙ্কায় পর্যটনে বছরে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন মানুষ আসে সেখানে গত বছর এসেছে মাত্র ৮০ হাজার। তাই একদিকে যেমন রেমিট্যান্সও নেই, অন্যদিকে পর্যটন থেকেও আয় নেই। আর এর ভেতরই সময় হয়ে গেছে ঋণের কিস্তি দেওয়ার। কারণ, শর্তানুযায়ী যে কয় বছর পর থেকে এসব ঋণের কিস্তি দেওয়া শুরু করতে হবে, সে সময় পার হয়ে গেছে। আর এই ঋণের কিস্তি দিতে গিয়ে একেবারেই ফাঁকা হয়ে গেছে তাদের রিজার্ভ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct