বদলা
গোলাম মোস্তাফা মুনু
_____________
পাশের গ্রামের শাফিকা ইয়াসমিনকে তুখসেরুল হক খুব পছন্দ করে। তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে সে মনে মনে।কিন্তু মনের ইচ্ছা সে মাকে প্রকাশ করতে পারে না। লজ্জায়। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। একদিন, মা ছেলেকে বলে ফেলেন, ‘তুখসেরুল, এবার তোর বিয়ের কাজটা সেরে ফেলি বাবা।’ মায়ের মুখে এমন কথা শুনে তুখসেরুল খুব খুশি হয়। বেশ কিছুদিন থেকেই সে মনে মনে চাইছিল, মা তাকে যেন এমন কথা বলেন। মা বলতেই থাকেন, ‘তোর আব্বা বেঁচে থাকলে আমাকে বেশি ভাবতে হত না। আমাকে কোথাও ছোটাছুটিও করতে হত না। সে-ই সবকিছু দেখে নিতো। এত বড় দায়িত্বটা যে আমি কীভাবে...!’ মাকে থামিয়ে দিয়ে তুখসেরুল বলে উঠে, ‘আম্মা, না হয় আর কিছুদিন থেমে যাই? চাকরির জন্য কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে রেখেছি। চাকরিটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। না হয় চাকরিটা হয়েই যাক?’ তুখসেরুলের কথা শুনে মা নীরব থাকেন। কী যেন ভাবতে শুরু করেন। মায়ের এমন ভাব দেখে তুখসেরুলের মন খারাপ হয়ে যায়। সে মনে মনে বলতে লাগে, ‘কথাটা তো আমি অন্তর থেকে বলিনি। মা আমার বিয়ের কথা বললেন আর আমি যদি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই তাহলেও তো একটা লজ্জার ব্যাপার। মা ভাববেন যে, আমি বিয়ে করার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত রয়েছি। এমনটা যেন না ভাবেন তাই...!’ তুখসেরুল নিজের ভাবনাকে আর আগে বাড়াতে পারল না। মা হঠাৎ করে বলে ফেলেন, ‘না তুখসেরুল, চাকরির অপেক্ষায় তোর আর বিয়ের কাজ ফেলে রাখলে হবে না। চেষ্টা-চরিত্র করতে থাক, ভাগ্যে থাকলে চাকরি হবে।
‘তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো আম্মা।’ নম্র সুরে বলল তুখসেরুল। মা খাট থেকে নামতে নামতে বলেন, ‘আমি কাল থেকেই পাত্রী খুঁজতে শুরু করবো। তোর যদি কোনো ভালো মেয়ে নজরে থাকে তাহলে আমাকে বলতে পারিস।’ মায়ের একথা শুনে তুখসেরুল মনে মনে বলে, ‘এখন আর লজ্জা করলে হবে না।আম্মাকে মনের কথা বলে দেওয়াই ভালো।’ তুখসেরুল এবার মাকে প্রকাশ্যে বলে, ‘আম্মা, পাশের গ্রামের দিলবারের মেয়ে শাফিকাকে আমি পছন্দ করি। রাস্তায় কয়েকদিন কথাও বলেছি। মেয়েটা খুব ভালো আমার মনে হয়েছে।’ ‘ঠিক আছে, আমি বুঝে গেলাম। তাহলে আগামীকালকেই শাফিকাদের বাড়ি যাবো আমি তোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।’ এ বলে তিনি খাট থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে চলে যান। সেদিন রাত্রে তুখসেরুলের যেন আর ঘুম আসে না। খুশিতে। বিছানায় শুধু এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। সে মনে ভাবে, কখন যে রাতটা পার হবে! সকাল হলেই মাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে শাফিকাদের বাড়ি যেতে বলবে। শাফিকার বাবার সাথে কেমন করে কথা বলবে এবং কী কী কথা বলবে, যাওয়ার আগে মাকে সে ভালো করে শিখিয়ে দেবে। এমন সব চিন্তা-ভাবনা করতে করতে তুখসেরুলের ঘুম চলে আসে। পরেরদিন। সন্ধ্যাবেলা। মা বাড়ি ফেরেন। মুখে কোনো কথা নেই। নীরব। নিজের ঘরে খাটের উপর গিয়ে বসেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তুখসেরুল। শাফিকার বাবা কী বলেছে, তাকে তারা পছন্দ করে কি না - এসব কথা মায়ের মুখ থেকে শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে সে। কিন্তু মা কিছুই বলেন না।মুখ নীচে করে খাটে বসে থাকেন। মায়ের নীরবতার কারণ তুখসেরুল বুঝতে পারে। সে শান্ত স্বরে মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ওরা কি আমাকে পছন্দ করেনি আম্মা?’ মা কোনো কথা না বলে ছেলের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে এক নজর তাকালেন। আবার নীচে মুখ করলেন। তুখসেরুল একই রকম সুরে বলে, ‘আমি জানতাম, আমাকে ওরা পছন্দ করবে না। কারণ, আমার গায়ের রং কালো। ফিগারেও কোনো চমক নেই। তবুও তোমাকে আমি ওদের বাড়ি পাঠিয়েছিলাম, যদি আমার শিক্ষাটাকে ওরা গুরুত্ব দেয়। আমি এম.এ পাস করেছি এবং বি.এডও করেছি - এগুলো কি ওদেরকে বলেছো?’ কোমল সুরে মা বলেন, ‘তোর শিক্ষা এবং জ্ঞান-বুদ্ধিকে ওরা শ্রদ্ধা করে, কিন্তু তোকে...!’
‘থাক আম্মা, আর বলতে হবে না। তোমাকে আর বিরক্ত করবো না। তুমি এখন আরাম করো। এ বলে তুখসেরুল যেমনই ঘর থেকে বের হবে এমন সময় মা বলেন, ‘একটু দাঁড়া।’ তুখসেরুল দরজার কাছে দাঁড়াল। মা বলতে লাগলেন, ‘শাফিকাদের গ্রামেরই বাদলু মাস তিনেক পূর্বে আমাকে বলেছিল তার বড় মেয়ের কথা। ওর বড় মেয়ে রুমি শাফিকার মতো বেশি সুন্দরী নয়, তবে দেখতে খারাপও নয়। রুমিও বি.এ পাস করেছে। ওর বাবা তোকে পছন্দ করে। রুমিও। আমি রুমির সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি। রুমির কথা এর আগে তোকে এজন্য বলিনি যে, তোর যদি কাউকে পছন্দ করা থাকে। নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে ঘর সংসার করতে পেলে সংসার সুখের হয়। এমন ভেবেই আমি জানতে চেয়েছিলাম তোর পছন্দের কোনো মেয়ে আছে কি না।’ এ বলে মা ক্ষণকাল নীরব থাকেন। নীরব থাকে তুখসেরুলও। খানিক নীরবতার পর মা আবার বলতে শুরু করেন, ‘রুমিকে যদি তোর পছন্দ হয় তাহলে আগামী কালকেই আমি রুমির বাবার কাছে গিয়ে এই সুসংবাদটা দিয়ে আসবো। ওরা খুব খুশি হবে।’
‘না আম্মা, এখন আর কোথাও যেতে হবে না। কিছুদিন থেমেই যাই। তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে।’ এ বলে তুখসেরুল মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মাস ছয়েক পর। সরকারি চাকরিতে যোগ দেয় তুখসেরুল। মোটা মাইনে। ছেলের সাফল্যে মা খুবই খুশি হন। ইতিমধ্যে নিজের গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে ছেলের বিয়ের জন্য বহু প্রস্তাবও চলে আসে। বিয়ের প্রস্তাব আসে দূরের গ্রামগুলো থেকেও। যেসব মেয়েকে ছেলের বউ করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তুখসেরুলের মা, সেসব মেয়ের বাবারা তাদের বাড়ি বারবার লোক পাঠাচ্ছে তুখসেরুলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য। এসব দেখে তুখসেরুলের মায়ের হৃদয়ে যেন আনন্দের স্রোত বইছে। তুখসেরুল প্রতিদিনই এশার নামাজের পরেই শুয়ে যায়।সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তাই বেশি রাত জাগতে পারে না। প্রয়োজনও হয় না। আজও এশার নামাজের পরেই শোয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময় শাফিকার বাবা-মা তাদের বাড়ি প্রবেশ করেন। তাদেরকে দেখে তুখসেরুল খানিক অবাক হয় এবং মনে মনে খুশিও হয়। তাদেরকে বসিয়ে তুখসেরুল চা বানাতে যায় রান্নাঘরে। তুখসেরুলের মা শাফিকার বাবা-মায়ের সাথে নানা রকম গল্প করতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর তুখসেরুল চা বানিয়ে এনে তাদের সামনে দেয়। পান করার অনুরোধও করে। তারা চা পান করতে শুরু করেন। চা পানের শেষে শাফিকার বাবা তুখসেরুলের মায়ের দিকে দেখে বলতে শুরু করেন, ‘সেদিন তুমি আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে আমার মেয়ে শাফিকাকে পুত্রবধূ করার উদ্দেশ্যে। সেদিন আমরা পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। পরে আমরা অনেক চিন্তাভাবনা করে ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম, এই খুশির সংবাদটা তোমাদের দিয়ে আসি, তাই রাত্রেই ছুটে এলাম। আগামীকাল রবিবার। তুখসেরুলের অফিস ছুটি। কালকেই তুখসেরুলকে সঙ্গে করে আমাদের বাড়ি এসো। যদি মনে করো, তাহলে বিয়ের দিন-তারিখ কালকেই ধার্য করে নেবো।’
শাফিকার বাবার কথা শুনে তুখসেরুলের মা কী জবাব দেবেন ভেবে পান না। নীরবে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তুখসেরুল বলতে শুরু করে, ‘শাফিকাকে আমি খুবই পছন্দ করতাম। তার সাথে ঘর-সংসার করতে পেলে আমার জীবন সার্থক হবে - এমনও ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার যে রূপ নেই, আমি যে কুৎসিত - এটা শাফিকাদের পক্ষ থেকেই আমাকে শুনতে হয়েছে। কাকু, আমি যেমন ছিলাম তেমনই তো আছি। এই ছয় মাসের মধ্যে তো আমার গায়ের কিছুই বদলায়নি। আপনাদের মন-মানসিকতাও বদলাইনি। বদলাতে বাধ্য করেছেন বিশেষ উদ্দেশ্যে। কাউকে দুঃখ দেওয়ার মতো অহংকার আমার নেই কাকু, আমি কাউকে দুঃখ দিতেও চাই না। তবে আমি বলছিলাম যে, আমার অর্থের গন্ধকে ভালো না বেসে যারা আমাকে ভালোবাসে তাদের সাথেই আমি সম্পর্ক গড়তে চাই।’
‘ঠিক আছে বাবা, তোমার সব রকম শর্তে আমরা রাজি আছি। তুমি আর একবার ভেবে দেখো। আজ আমরা উঠি।’ এ বলে তারা মাথা নীচু করে তুখসেরুলের বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান। তুখসেরুল তার মাকে বলে, ‘এখন যত মেয়ের বাবা আসছে তারা কেউই আমাকে ভালোবাসে না ; আমার চাকরিকে ভালোবাসে। একমাত্র রুমির পরিবারই আমাকে বোঝে। আম্মা, কাল সকালেই তুমি রুমিদের বাড়ি যাবে। আর দেরি নয়।’ মা আশ্চর্য হয়ে ছেলের মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct