ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পরিসমাপ্তি কিভাবে ঘটবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এ ঘটনায় বিশ্বরাজনীতিতে যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশিয়া ও এর পেছনে চিন সহ মিত্র আরো কিছু দেশ বর্তমানে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন একটি ব্যবস্থাকে অনিবার্য করে তুলতে চাইছে বলে মনে হয়। সেটি রাশিয়া-মার্কিন দ্বিমেরুর বিভাজনকেন্দ্রিক ব্যবস্থা না-ও হতে পারে। তা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
এ ধরনের অবরোধ আরোপের দুই প্রধান অস্ত্র হল বৈশ্বিক বাণিজ্য লেনদেনের তথ্য জোগান নেটওয়ার্ক সুইফট এবং বৈশ্বিক লেনদেনে মার্কিন ডলার-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও ব্যাংকব্যবস্থা। দুই ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হাতে। রাশিয়া ও চীন বহু দিন ধরে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণের এই দুই প্রধান অস্ত্রকে অকার্যকর করার জন্য কাজ করে আসছে। এজন্য রাশিয়া ও চীন সুইফটের দু’টি বিকল্প লেনদেন তথ্য নেটওয়ার্ক সিস্টেম চালু করেছে। কিন্তু এই নেটওয়ার্কের আওতা সীমিত থাকায় বৈশ্বিক বাণিজ্যে তা তেমন প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি। তবে এর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমে। অন্য দিকে বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে জাতীয় মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেনের একটি প্রক্রিয়া তৈরির চেষ্টা করছে চীন-রাশিয়া বলয়ের দেশগুলো। জাতীয় ও বৈশ্বিক লেনদেনের অভিন্ন বৈশ্বিক ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলনের ওপরও কাজ করছে চীন। এই দু’টি উদ্যোগ সফল হওয়ার অর্থ হল আমেরিকান বা পশ্চিমা নিয়ন্ত্রক আধিপত্য ব্রেটন-উড চুক্তির মাধ্যমে সূচিত বিশ্বব্যবস্থায় গৌণ হয়ে পড়া। এই উদ্যোগ সমাপনীর দিকে যাওয়ার আগে তাতে বাধা তৈরিতে ইউক্রেন যুদ্ধ হয়তোবা একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। সুইফট বা ডলারের কার্যক্ষমতা ভোঁতা হওয়ার আগেই সেটিকে চূড়ান্তভাবে প্রয়োগের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা জাতীয় পর্যায়ের যুদ্ধ যখন বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন মহাযুদ্ধ শুরুর একটি পরিবেশ তৈরি হয়। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা সেটিই তৈরি করছে বলে মনে হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও বাদশাহ ফয়সল যখন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবে ক্ষমতায় ছিলেন তখন দু’দেশের মধ্যে এই মর্মে চুক্তি হয় যে আমেরিকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সৌদি আরব আর জ্বালানি তেল বিক্রি করা হবে কেবল মার্কিন ডলারে। এর বিনিময়ে আমেরিকা সৌদি রাষ্ট্র ও রাজপরিবারের ক্ষমতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে।
আরব বসন্তের সময় দেশে দেশে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে জনবিদ্রোহ দেখা দেয় তার পেছনে য্ক্তুরাষ্ট্রের ইন্ধন সক্রিয় ছিল বলে সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলোর ধারণা ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান ও মুহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসেবে উত্থান ঘটে। আমেরিকায় ক্ষমতায় আসা রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ট ট্র্যাম্পের সাথে বিশেষ সমীকরণ তৈরির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একনায়কত্ব বা রাজতন্ত্রের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জকে শিকড়হীন করার প্রচেষ্টা তারা ক্ষমতার দুর্দমনীয় প্রয়োগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান দল ও ট্রাম্পের শাসনের পরাজয়ের পর জো বাইডেনের নতুন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের দুই ক্রাউন প্রিন্সের কর্তৃত্বকে মেনে নিতে চাইছেন বলে মনে হয় না। এতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিন সালমান ও বিন জায়েদ দু’জনই বিকল্প বৈশ্বিক শক্তি চীন রাশিয়ার সাথে তৈরি করেন বিশেষ সমীকরণ। সৌদি আরব আমেরিকার বিকল্প তেলের বাজার হিসেবে চীনকে ব্যবহার করে আর সেই সাথে সৌদি আরব নতুন নির্মাণাধীন কৌশলগত নিওম নগরীসহ নানা ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। রাশিয়ার কাছ থেকে সমরাস্ত্র কিনে একটি বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করে রিয়াদ। একই পথে হাঁটে আমিরাত মিসরসহ আরো কিছু মিত্র দেশ। ইউক্রেন সঙ্ঘাতে আমেরিকার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের এই রাজতান্ত্রিক শাসকদের দূরত্ব তীব্রভাবে প্রকাশ হয়। রাশিয়ার ওপর তেল গ্যাসে আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাজার ঠিক রাখতে জো বাইডেন তেল উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ জানানোর জন্য দুই ক্রাউন প্রিন্সকে টেলিফোন করেছিলেন। বলা হচ্ছে, তাদের দু’জনের কেউই সেই ফোনে সাড়া দেননি; বরং এরপরই মুহাম্মদ বিন সালমান ঘোষণা করেন, সৌদি আরব এখন এককভাবে মার্কিন ডলারে তেল বিক্রির নীতি থেকে সরে আসবে এবং চীনকে তার জাতীয় মুদ্রা ইয়েনে তেল সরবরাহ করবে। এর প্রভাব যে মার্কিন ডলারে কতটা পড়বে তা বোঝা যায় তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের রিপাবলিকান গার্ডের ওপর আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার ঘোষণায়। এই রিপাবলিকান গার্ডই ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া ইরাক লেবানন পর্যন্ত সর্বত্র ইরানি প্রক্সির সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ছাড়াও ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি পুনর্বহাল এবং দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটন নিতে যাচ্ছে বলে আভাস দেয়া হচ্ছে। এর সরল অর্থ হলো বৈশ্বিক সংঘাতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তার মিত্ররা চীন রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ার সাথে সাথে বাইডেন প্রশাসন ইরানকে সর্বোতভাবে মদদ দেয়া শুরু করবে। সৌদি আরব ৮১ জনের শিরচ্ছেদের রায় কার্যকর করার পর ইরানের সাথে এর মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা এসব ব্যক্তির অর্ধেকই হল ইরানপন্থী ও শিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে একধরনের সমঝোতায় যাবে বলে মনে হচ্ছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct