ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পরিসমাপ্তি কিভাবে ঘটবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এ ঘটনায় বিশ্বরাজনীতিতে যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশিয়া ও এর পেছনে চিন সহ মিত্র আরো কিছু দেশ বর্তমানে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন একটি ব্যবস্থাকে অনিবার্য করে তুলতে চাইছে বলে মনে হয়। সেটি রাশিয়া-মার্কিন দ্বিমেরুর বিভাজনকেন্দ্রিক ব্যবস্থা না-ও হতে পারে। তা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার পরিচালিত সামরিক অভিযানের পরিসমাপ্তি কিভাবে ঘটবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এ ঘটনায় বিশ্বরাজনীতিতে যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশিয়া এবং এর পেছনে চীন ও মিত্র আরো কিছু দেশ বর্তমানে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন একটি ব্যবস্থাকে অনিবার্য করে তুলতে চাইছে বলে মনে হয়। এর মধ্য দিয়ে আবার দ্বিমেরুর বিশ্বব্যবস্থার সূত্রপাত হলেও সেটি সোভিয়েত-আমেরিকার দ্বিমেরুর বিভাজনকেন্দ্রিক ব্যবস্থা না-ও হতে পারে। এটি যদি ইউক্রেনকেন্দ্রিক সঙ্ঘাতের সমঝোতামূলক পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে ঘটে সেটি হবে একরকম। আর ইউক্রেন যুদ্ধের পথ ধরে যুদ্ধ বিগ্রহ ছড়িয়ে পড়ে তৃতীয় মহাযুদ্ধের মতো কিছু ঘটলে সেটি হবে ভিন্ন রকম। তুরস্ক বা জার্মানির নেতারা শেষোক্ত অবস্থা কাটাতে সমঝোতা বা শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের অবসান ঘটাতে চাইছেন বলে মনে হয়। কিন্তু চীন বা আমেরিকা কতটা সেটি কামনা করছে অথবা ভ্লাদিমির পুতিন সমঝোতার পথে কতটা হাঁটবেন তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে বলে মনে হয়।
সর্বাত্মক বিজয় চাইছেন পুতিন? ইউক্রেনের চার পাশে সেনা সমাবেশ ঘটানোর পর থেকেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একধরনের কট্টর স্বর ধ্বনিত হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোকে তিনি তখন বলেন, ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ বন্ধ রাখা এবং এর আগে ১৯৯৭ সালের পর যে সম্প্রসারণ করা হয়েছে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেবার অঙ্গীকার করতে হবে। পুতিন ভালো করে জানতেন এটি যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর পক্ষে করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাস্তবে ঘটেছেও সেটিই। এরপর বেলারুশকে সাথে নিয়ে ইউক্রেনের ওপর সর্বাত্মক সামরিক অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া তিন দফা সমঝোতার জন্য শান্তি আলোচনায় মিলিতও হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই তাদের স্বর ও শর্ত আরো চড়া হয়েছে। ইউক্রেনকে অসম্ভব সব শর্ত মেনে নেয়ার জন্য চাপ দিয়েছে আর সে সাথে যুদ্ধের বিধ্বংসী তৎপরতা বাড়িয়েছে ক্রেমলিন। সর্বশেষ তাদের দুই স্তরে যেসব শর্তের কথা প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ইউক্রেনকে সুইডেন অস্ট্রিয়ার মতো নিরপেক্ষ থাকার অঙ্গীকার করতে হবে, ন্যাটো বা ইউরো জোনে না যাওয়ার বিষয়টি সংবিধান সংশোধন করে নিশ্চিত করতে হবে, ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর নিরস্ত্রীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে, রাশিয়ার স্বীকৃতি অনুযায়ী ডনবাসের দু’টি অঞ্চলের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে হবে, ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে আর সংশ্লিষ্ট সমুদ্রাঞ্চলে রুশ নিয়ন্ত্রণের স্বীকৃতি দিতে হবে আর সে সাথে ক্রিমিয়ার জন্য মিষ্টি জলের সরবরাহের নিশ্চয়তাও বিধান করতে হবে। এ ছাড়া রাশিয়ার ‘নব্য নাৎসি’ হিসেবে চিহ্নিত রুশবিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে।ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পক্ষে তার দেশকে নিরপেক্ষ রাখা বা ন্যাটো-ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান না করার অঙ্গীকারের বাইরে অন্য কোনো দাবি মেনে নেয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রাশিয়াও তার আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করবে আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ গোপনে অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবে। সেই প্রচেষ্টা যতটা তীব্রতা পাবে যুদ্ধের শাখা-প্রশাখা ততটা নানা স্থানে বিস্তৃতি পাবে। কেন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে? যুদ্ধ উত্তেজনা ইউক্রেন অঞ্চল থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তার পেছনের মূল কারণই হলো বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানো। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়া আর ট্রাম্প জমানায় চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ইউক্রেন অভিযান শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধকে তীব্র আকার দেয়া হয়েছে। একই সাথে রাশিয়াকে সমর্থন দেয়া হলে চীনের ওপর একই ধরনের অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে জো বাইডেন সরাসরি শি জিন পিনের সাথে কথাও বলেছেন। (ক্রমশ..)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct