ফৈয়াজ আহমেদ: গাছ কী খেয়ে বাঁচে? এর উত্তরে আমরা জানি, গাছ সূর্যের আলো এবং জলর সাহায্যে নিজের পাতায় সালোকসংশ্লেষণ নামক পদ্ধতিতে রান্নাবান্না করে গ্লুকোজ তৈরি করে। এর মাধ্যমে সে নিজের আহার সেরে নেয়। এরা আমাদের ন্যায় মাছ-মাংস খায় না। যেন নিতান্ত সাদামাটা নিরস জীবনযাপন করছে হাজার হাজার প্রজাতির গাছ। কিন্তু জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই পৃথিবীতে গাছের খাদ্যাভ্যাসে কোনো বৈচিত্র থাকবে না, তা কী করে সম্ভব? তাই পৃথিবীর আনাচে কানাচে বিভিন্ন জঙ্গল ঘেঁটে আজ পর্যন্ত প্রায় ১০০ এরও বেশি গাছের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যেগুলো গ্লুকোজের বাইরেও নানা ফাঁদের সাহায্যে পোকামাকড় ধরে এবং সেগুলো ভক্ষণ করে। এই মাংসাশী গাছগুলোর মাঝে আমাদের চেনা পরিচিত একটি শিকারি গাছের নাম হচ্ছে পিচার প্লান্ট।পিচার অর্থ ‘কলসি’। কলসির ন্যায় দেখতে বিশেষ পাতার মতো অঙ্গ আছে বলে এদেরকে পিচার প্লান্ট নাম দেয়া হয়। পিচার প্লান্ট এমন একটি শিকারি গাছ যা মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে, আবার পোকামাকড় পেলে তাদেরও সাবাড় করে ফেলে। পিচার প্লান্টের পিচারের (কলসির ন্যায় পাতা) আবার একটি ঢাকনাও রয়েছে। বৃষ্টির জল যেন কলসির ভেতর ঢুকে ভেতরের রাসায়নিক পদার্থ পাতলা করে দিতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখে এই ঢাকনা। গাছগুলো উচ্চতায় ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। একেকটি ‘পিচার’ এর উচ্চতা ১৫ সেন্টিমিটারের মতো হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়া, মাদাগাস্কার, পাপুয়া নিউ গিনি, সিসিলিস, দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের জঙ্গলে এই গাছের দেখা মেলে।
পিচার প্লান্টের পিচার দুই ধরনের হতে পারে। কিছু কিছু পিচার মাটি থেকে সামান্য উচ্চতায় গজিয়ে ওঠে। উচ্চতার বিচারে একটু খাটো হওয়ায় এদেরকে নিম্ন পিচার বলা হয়। আর যারা তুলনামূলক উচ্চতায় গজায়, সেগুলোকে উচ্চ পিচার বলা হয়। তবে একদম শুরু থেকে এই পিচারগুলো কলসির মতো থাকে না। প্রথমত এদের দেখতে লম্বা তরবারির মতো দেখায়। ধীরে ধীরে এই তরবারির মতো লম্বা পাতাটি পরিবর্তিত হয়ে পিচারে পরিণত হয়। পিচারের উপরের নরম অংশ কিছুটা ফুলে উঠে ঢাকনায় রূপান্তরিত হয়ে থাকে। পিচার প্লান্টে উচ্চ পিচার জন্মানোর পর পরই ফুল ফোটা শুরু করে। পিচার প্লান্টের ফুলে বিপুল পরিমাণে পরাগরেণু উৎপাদিত হয়। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে এই ফুল থেকে রস নির্গত হতে থাকে যা সকালের আগেই শুকিয়ে যায়। বিভিন্ন পোকামাকড় এই ফুলগুলো দেখে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এসব পোকার সাহায্যে পিচার প্লান্টের পরাগায়ন হয়ে থাকে। দেখতে দেখতে ফুলগুলো ফলে পরিণত হয়। আর এই ফলের ভেতর শত শত ক্ষুদ্র বীজের জন্ম হয়। বীজগুলো ওজনে বেশ হালকা হয়ে থাকে, যা বাতাসে ভেসে ভেসে জঙ্গলের অন্যপ্রান্তে ছড়িয়ে যেতে পারে। তবে সংখ্যায় প্রচুর বীজ উৎপন্ন করলেও, বীজ থেকে সফলভাবে চারা জন্মানোর সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। বেশিরভাগ বীজই শেষপর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। এবার জানা যাক পিচার প্লান্টরা কেন শিকারি হয়ে উঠলো। এর আগের অনুচ্ছেদে আমরা জানতে পেরেছি যে, পিচার প্লান্ট মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে। তাহলে এরা কেন ফের পোকামাকড় ভক্ষণ করার ঝামেলায় গেলো? এর কারণ, পিচার প্লান্ট যে মাটিতে জন্মায়, এর পুষ্টিগুণ নিতান্তই কম থাকে। এর ফলে পিচার প্লান্টের দেহে পুষ্টি ঘাটতি পড়ে, যা পূরণ করতে এদের অন্য উৎসের দিকে ধাবিত হতে হয়। তাই বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মাংস খেয়ে এরা দেহে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করে থাকে। আর চলমান কীটপতঙ্গকে শিকার করতে স্থির পিচার প্লান্টের ব্যবহার করতে হয় পিচার নামক অস্ত্রকে।
পতঙ্গ শিকার করার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে এদের আকৃষ্ট করে নিকটে নিয়ে আসা। পিচারের ঢাকনা থেকে তখন হালকা সুবাস নির্গত হয় যা মাছি, পিঁপড়া, গুবরে পোকা, প্রজাপতির ন্যায় পতঙ্গদের আকৃষ্ট করে থাকে। অনেক সময়ে পিচারের উজ্জ্বল রঙ দেখেও পোকারা আকৃষ্ট হয়ে থাকে। পতঙ্গরা যখন পিচারের উপর গিয়ে বসে, তখন এরা পিছলে পিচারের ভেতরে চলে যায়। আর তখন পতঙ্গগুলো পিচারের অভ্যন্তরের দেয়ালের আঠার ফাঁদে আটকে যায়। পিচারের ভেতরের অংশ বেশ পিচ্ছিল হয়ে থাকে বিধায় পতঙ্গগুলো হাজার চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারে না। উল্টো চোরাবালির ন্যায় এরা পিচারের ভেতরে তলিয়ে যেতে থাকে। তার উপর পিচারের মুখের দিকে মাঝারি আকারের লোম থাকে যা পতঙ্গকে বাইরে বের হতে বাঁধা দেয়। ধীরে ধীরে পিচারের ঢাকনা বন্ধ হয়ে গেলে এর ভেতর পাচক রস নির্গত হতে থাকে। তবে শিকারকে হত্যা করার জন্য প্রথমে এসিড ক্ষরণ হয়। পাচক রস এবং এসিডের বিক্রিয়ায় দ্রুত সেই পতঙ্গ গাছের খাদ্যে রূপান্তরিত হয়। এরপর গাছ বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই খাদ্য থেকে পুষ্টি শোষণ করে নেয়। একদম ভরপেট খেয়ে এবার পিচার প্লান্ট ক্ষান্ত হয়। ফের পুষ্টি ঘাটতি দেখা দিলে নতুন করে শিকার ধরার অভিযান শুরু হয়। এবার একটি ভিন্ন গল্প বলা যাক। একদিকে যখন পিচার প্লান্ট পতঙ্গ শিকার করে নিজের আহার সেরে নিচ্ছে, তখন এদের খাবারে এসে ভাগ বসাচ্ছে আটপেয়ে মাকড়সা। ঠিক এমন ঘটনাই দেখা যায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর অঞ্চলের জঙ্গলগুলোতে। রেড ক্র্যাব স্পাইডার নামক এই মাকড়সাগুলো পিচার প্লান্টের আশেপাশে অবস্থান করে। যখন কোনো পতঙ্গ এসে পিচার প্লান্টের ফাঁদে আটকে পড়ে, তখন এরা গাছের মুখ থেকে আহার কেড়ে নিয়ে নিজেরা ভক্ষণ করা শুরু করে। বেচারা পিচার প্লান্টের শুধু সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তবে নিশ্চয় আড়ালে এরা রাগে গজ গজ করতে থাকে।
পিচার প্লান্টরা ভালো নেই। এমনটাই বলছে IUCN (International Union for Conservation of Nature) এর বিশেষজ্ঞরা। পতঙ্গদের ত্রাশ, জঙ্গলের শিকারিরা আজ নিজেরাই শিকারে পরিণত হয়েছে। তবে এদের শিকারি কোনো পতঙ্গ বা হিংস্র প্রাণী নয়। এদের শিকারি হচ্ছে মানুষ। একদিকে মানুষ নিজের আবাসস্থল খোঁজার উদ্দেশ্যে নির্বিচারে জঙ্গল ধ্বংস করছে, অন্যদিকে মাটি দূষণ এবং পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে ধ্বংসের মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। এর ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বহু প্রজাতির পিচার প্লান্ট বিলুপ্তি মুখে পড়েছে। পিচার প্লান্টের সবচেয়ে বড় গণের নাম নেপেন্থেস। এই সংস্থার জরিপমতে, প্রায় ১০৪টি প্রজাতির নেপেন্থেসের মধ্যে প্রায় ৬৩ প্রজাতির গাছ বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৯টি প্রজাতি চরম বিপর্যয়ের মুখে আছে বলে চিহ্নিত হয়েছে। যেকোনো সম্পদ সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক এবং নীতিমালা অনুসরণ করে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা। একথা পিচার প্লান্টের ক্ষেত্রেও খাটে। প্রশ্ন উঠতে পারে, একটি শিকারি গাছ বাঁচিয়ে রেখে আমাদের কী লাভ হবে? আসলেই তো, এই গাছ না আমাদের কোনো কাজে আসে, না এর ফল আমরা খেতে পারি। তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে এই গাছের গুরুত্ব আমাদের চোখে পড়বে না। ব্যাপারটি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যাক। এই গাছ আমাদের পরিবেশের একটি অংশ। আমাদের পরিবেশে একেকটি জীব বিভিন্ন প্রকার খাদ্যগ্রহণ করার মাধ্যমে জটিল খাদ্যজাল সৃষ্টি করেছে। প্রাণীর খাদ্যজালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, যদি যেকোনো একটি খাদ্যস্তরে কোনোরকম গরমিল হয় কিংবা প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে পুরো খাদ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। আর ভারসাম্যহীন পরিবেশে ঝুঁকির মুখে পড়বে মানুষসহ প্রতিটি জীবের অস্তিত্ব। তাই প্রতিটি জীব সম্পদের যথাযথ সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct