আর্জেন্টিনা ৪ (লাভেজ্জি, মেসি, হিগুয়াইন-২)ইউএসএ ০ এক দিকে ইউরোর আকাশে অংসখ্য নক্ষত্রের ছটা। অন্য দিকে, কোপার আকাশে একক সূর্যের মতো তিনি, একা। একাই বটে! প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে, প্রতিপক্ষের সমস্ত রক্ষণকে মুছে দিয়ে তাঁর বাঁ পায়ের যে শট জালের বুকে জড়িয়ে গেল, তাকে স্বপ্নে ভাবতেও কষ্ট হবে। অথচ তিনি, কী অবলিলায় সেই কাজটি করে গোটা টুর্নামেন্টের সমস্ত স্পট লাইট নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। একটি গোল যেন অসংখ্য বিস্মিত মুহূর্তের জন্ম দিল! ফিরিয়ে দিল অনেক জবাব। একটি গোল তাঁকে পৌঁছে দিল দেশের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার চরিত্রে! এবং এই একটি গোলই যেন মুখে লাগাম পরিয়ে দিল ফুটবল রাজপুত্র মারাদোনার। আসলে এই গোলের পর মেসি-আলোর গভীরে যে সকল নক্ষত্রই কেমন টিমটিমে হয়ে গেল! অথচ কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে ওই শটটা নেওয়ার আগে দু’বার জার্সি দিয়ে শুধু মুখের ঘাম মুছে ছিলেন। দু’বার মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন নিজেকে তৈরিও করে নিচ্ছিলেন। আর তার পরই চোখ ধাঁধাঁনো সেই ফ্রি কিক। ঠিক সেই মুহূর্তে যেন হাউস্টনের এনআরজি-র ওই মাঠে স্বয়ং ফুটবলের ঈশ্বর নেমে এসেছিলেন। এর পরেই ইতিহাস তৈরি হওয়ার পালা। বাতিস্তুতাকে পিছনে ফেলে ছুঁয়ে ফেলা আর্জেন্তিনার সর্বোচ্চ গোলদাতার মাইলস্টোনটি। সেমিফাইনালে ইউএসএ-এর বিরুদ্ধে শুরুতেই গোল করে আর্জেন্তিনার এগিয়ে যাওয়া আগের রাতের ইউরোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। ৭ মিনিটেই গোল করে এগিয়ে গিয়েও কী ভাবে হারের মুখ দেখতে হল স্পেনকে! ক্রোয়েশিয়ার কাছে ২-১ গোলে হেরে রীতিমতো সমস্যায় ইনিয়য়েস্তারা। একই অবস্থা হবে না তো? ভাবতে ভাবতেই ৩২ মিনিটের মাথায় মেসি ম্যাজিক সেট পিসে। মেসিকে নিয়ে গোটা দুনিয়া যখন লাফালাফিতে ব্যস্ত তখন দু’জন নিশ্চয়ই মনে মনে আফশোস করছেন। প্রথম জন, ক্রিস ওন্দোলোস্কি। তিনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, ফাউলটা না করলেই হত! সেটা নিশ্চয়ই রিজার্ভ বেঞ্চে বসে টের পেয়েছিলেন ইউএসএ কোচ ক্লিনসম্যান। হতাশায় মাথা নাড়ছিলেন তিনি। এ ভাবে কেউ সিংহের সামনে মাংসের টুকরো তুলে ধরে? দ্বিতীয়ার্ধে ওন্দোলস্কিকে তাই তুলেই নিলেন হতাশায়! দ্বিতীয় জন অবশ্যই দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা। নেতৃত্ব দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই নেই বলে যাঁর বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছিলেন তিনি, সেই মেসিই তো দেখিয়ে দিলেন ফুটবল কাকে বলে! এবং বড়ই নিঃশব্দে! প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে মেসির বাঁ পায়ের শটটা যখন ইউএসএ-ওয়ালের মাথার উপর দিয়ে বাঁক খেয়ে ক্রসপিসের কোণায় লেগে যখন তিন-কাঠির সীমানা পেরিয়ে জালে জড়িয়ে গেল, তখন কী ভাবছিলেন ফুটবলের রাজপুত্র? ঠিক তখন, যখন গোটা ফুটবল বিশ্বের ঘোর কাটতে চাইছে না! কী মাপা শট! কী একাগ্রতা! শট নেওয়ার আগে যেন শান দিয়ে নিলেন চেনা সেই বাঁ পায়ে। বুটের ফিতেটা খুলে আবার শক্ত করে বেঁধে নিলেন। যেন শিল্পীর তুলি! আর সেই তুলির আলতো আঁচড়ে আঁকা হল নতুন ছবি। ওই পা দিয়েই তো বিশ্ব ফুটবলের ক্যানভাসে এত দিন ধরে একের পর এক ছবি এঁকে চলেছেন তিনি। মেসির ওই গোলের আগে অবশ্য ম্যাচ শুরুর তিন মিনিটের মধ্যে আর্জেন্তিনাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন লাভেজ্জি। বলটা সাজিয়ে দিয়েছিলেন সেই মেসিই। গোটা প্রথমার্ধ গোলের সামনে লাভেজ্জির ছটফটানি ব্যস্ত রাখল ইউএসএ ডিফেন্সকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ভয়ঙ্কর চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হলেন তিনি। প্রথমার্ধ যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে আর্জেন্তিনা। ম্যাচ শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ৩-০ করলেন গোঞ্জালো হিগুয়াইন। ইউএসএ ডিফেন্সকে পিছনে ফেলে বক্সে ঢুকে পড়া হিগুয়াইনের শট গোলকিপার প্রথমে আটকে দিলেও ফিরতি বলে গোল করেন তিনি। গোল পেতে ফর্মেশন বদলে ৩-৪-৩-এ আক্রমণে লোক বাড়ালেও কাজের কাজ কিছু হয়নি হোম টিমের। শেষের দিকে আবারও প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন মেসি। কর্নারের বিনিময়ে কোনও রকমে তা বাঁচিয়ে দেন ইউএসএ গোলকিপার গুজান। ৮৬ মিনিটে সেই মেসিই আরও একবার দেখালেন তিনি স্বার্থপরের মতো ফুটবল খেলেন না। বক্সের মধ্যে পাওয়া বলটাকে গোলে পাঠাতে পারতেন তিনিই। কিন্তু, তাঁকে ঘিরে থাকা রক্ষণের ফাঁক দিয়ে আরও সহজ জায়গায় পৌঁছে যাওয়া হিগুয়াইনকে সেই বল সাজিয়ে দিলেন মেসি। ভুল করেননি হিগুয়াইনও। ৪-০ গোলে ইউএসএ-কে হারিয়ে কোপা আমেরিকার ফাইনালে পৌঁছে গেল আর্জেন্তিনা।
আরও পড়ুন: