চীনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটি প্রদেশের নাম হুনান। প্রাকৃতিক আর অলৌকিক সৌন্দরর্যে ভরপুর এই প্রদেশ, পাহাড়ের চূড়া, সবুজের সমারোহ, উপচে পড়া নদীর উপত্যকা এবং অসংখ্য ধানক্ষেতে ঝুলে থাকা কুয়াশায় । এই অঞ্চলের আশি ভাগই পাহাড়; এবং এসব পাহাড়ই অসংখ্য গ্রাম গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে পাহাড়ের ঢালু উপত্যকার গা বেয়ে গ্রামের অন্তরালেই নুশুর জন্ম।
নুশু চীনের একটি লিখিত ভাষা। সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ভাষা, যা নারীদের দ্বারা, নারীদের জন্য এবং নারীদের মাধ্যমেই ব্যবহৃত ও নিয়ন্ত্রিত। তাই একে গোপন ভাষা বলেও অভিহিত করা হয়। কেননা, কেবলমাত্র নুশুতে দক্ষ একজন নারীই বুঝতে পারবে নুশুর অর্থ।
জ্যাংইয়াং গ্রামেই মূলত এই ভাষার প্রসার ঘটে। এছাড়া দাওসিয়ান এবং জ্যাংঘুয়া প্রদেশেও ভাষাটি ছড়িয়ে পড়ে। তবে এটি ঠিক তখনই এটি বিশ্বের নজরে আসে যখন তা বিলুপ্তির পথে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে কিছু লিপি উদ্ধার করা হলেও ধারণা করা হয় প্রাচীনযুগ থেকেই গোপনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই ভাষা। কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, ভাষাটি নবম শতকের দিকে জন্মলাভ করে, যখন সং রাজবংশ (৯৬০-১২৭৯) চীনের শাসনে ছিল।
চিং রাজবংশের (১৬৪৪-১৯১১) এবং পরবর্তী সময়েই নুশু ভাষা এর সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করেছিল। তবে এই ভাষার বহুল ব্যবহার শুরু হয় উনিশ শতকে হুনান প্রদেশের জ্যাংইয়াংয়ের মতো গ্রামগুলোতে। ওখানকার হান, ইয়াও এবং মিয়াও গোষ্ঠীর নারীরা একে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিল।
চীনের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীরা ছিল অবহেলিত। যেকোনো বিষয়েই তাদেরকে দমিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। এমনকি বাড়ির সীমানা পার করারও অনুমতি দেয়া হতো না। শিক্ষাগত সুযোগ তো ছিল আকাশ-কুসুম কল্পনা। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে নারীদের কোনো যোগাযোগই ছিল না। তাই তারা নিজেদের মধ্যে এই গোপন ভাষার মাধ্যমে মত বিনিময় এবং কথোকপথন চালিয়ে যাওয়ার রীতি চালু করে।
নুশু ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল বিয়ে। সাধারণত চীনের রীতি অনুসারে, বিয়ের পর কনে পিতামাতার বাড়ি ছেড়ে বরের বাড়িতে চলে যায়। এই নতুন জীবনে নববধূর খানিকটা বিচ্ছিন্নতা বা একাকিত্ব অনুভব হয়। সুতরাং, দুঃখ প্রকাশ এবং বন্ধুত্ব গড়ে চাঙ্গাভাব আনার জন্য নুশুর তুলনা ছিল না।
নববধূর এই চলে আসার প্রক্রিয়ায় আরেকটি জিনিস অন্তর্ভুক্ত ছিল। শেনঝাশু বা থার্ড-ডে বুক নামে কাপড়ের তৈরি একটি বাঁধাইকৃত বই নববধূকে দেয়া হতো বিয়ের তিন দিন পর। কনের মা, ভাই-বোন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবরা তাদের দুঃখ এবং স্বজন দূরে যাবার অনুভূতিগুলো লিপিবদ্ধ করত সেই বইয়ে। একইসঙ্গে কনের ভবিষ্যতে সুখ-সমৃদ্ধির জন্যও প্রার্থনাবাণীও থাকতো। তবে এসবই বইয়ের শুরুর দিকের কয়েক পাতায় থাকতো। বাদবাকি পাতা খালি থাকতো কনের নিজের ডায়েরি হিসেবে ব্যবহারের জন্য।
নুশু ব্যবহারকারী বেশিরভাগ নারীরাই নিরক্ষর ছিলেন। অক্ষরজ্ঞান সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়নি তাদের। তাহলে তারা কী করে এই ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেছিল? ইংরেজিতে একটা প্রবাদবাক্য আছে, “Practise makes a man perfect” অর্থাৎ, চর্চাই মানুষকে দক্ষ করে তোলে। আর এই প্রবাদবাক্যের যথার্থ ব্যবহারই করেছিল নুশু ব্যবহারকারীগণ। তারা কেবল অন্ধবিশ্বাসের মতোই স্ক্রিপ্ট বা লিপি অনুলিপি করার অনুশীলন করতো। সময়ের আবর্তে তারাও একসময় এই ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠত। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে ভাষাটি লুকিয়ে থেকেও স্বতন্ত্র এক নারী সংস্কৃতির জন্ম দেয়।
নুশু আসলে একটি ধ্বনি নির্দেশক ভাষালিপি, যা ডান থেকে বামে পড়তে হয়। ধারালো বাঁশের কঞ্চি এবং রান্নার সময় পুড়ে যাওয়া ওক থেকে অস্থায়ী কালি সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এই বর্ণমালার বেশিরভাগ প্রতীকই চৈনিক ভাষার বর্ণমালা থেকে অনুপ্রাণিত। তবে এর অক্ষরশৈলী অনেক বেশি ঐতিহ্যগত, দীর্ঘায়িত আর বাঁকানো। সুতোর মতো চিকন রেখাগুলো তীর্যকভাবে নীচের দিকে নেমে আসে। আর এর সূক্ষ্ম রেখার কারণে একে মশার লিখন পদ্ধতি বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
যদিও বর্তমানে নুশু কেবলই নারীদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করা হয়, তবে প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল তখনকার পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীদের অবাধ বাকস্বাধীনতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, কয়েকশো অথবা হতে পারে হাজার বছর ধরে এই অব্যক্ত ভাষালিপি জ্যাংইয়াং প্রদেশের বাইরে অজানা ছিল। ১৯৮০ এর দশকের পর থেকেই মূলত এর চর্চার কথা বিশ্বব্যাপী প্রচার পায়। এই প্রাচীন ও সুরক্ষিত ভাষালিপিতে কথা বলা সর্বশেষ নারীর মৃত্যুর ১৭ বছর পর।
২০০০ সালে পিওয়েইতে নুশু ভাষার বিদ্যালয় চালু করা হয়। ২০০৬ সালে ভাষালিপিটি চীনের স্টেট কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজের তালিকাভুক্ত করা হয়।
নুশুর সত্যিকারের নিদর্শনের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে বিপ্লবের কারণে। তবে ইদানীং নুশুর প্রসার হচ্ছে সিনেমা, সঙ্গীত এবং সাহিত্যের মাধ্যমে। বছরের পর বছর ধরে হুনান প্রদেশে নৃতাত্ত্বিক গবেষণার পর ২০১৩ সালে অস্কার ও গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস বিজেতা চীনা সুরকার, এবং ইউনেস্কোর শুভেচ্ছদূত প্রতিনিধি ত্যাং ডান, একটা মাল্টিমিডিয়া সিম্ফোনি তৈরি করেছেন নুশু: দ্য সিক্রেট সং অফ উইমেনস শিরোনামে।
লেখক: নাজমা আহমেদ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct