ফৈয়াজ আহমেদ: ১৯৮৭ সালের ৭ই এপ্রিল প্রতমবারের জন্য ওয়ার্ল্ড হেল্থ অগানাইজেশনের সদস্য দেশ গুলি মিলে কিছুক্ষনের জন্য তামাক বর্জন করার ডাক দেয়। পরে বছর ১৯৮৮ সালে রেজুলিউশন করে ‘হু’ ৩১মে প্রতিবছর ‘তামাক বর্জন দিবস’ পালন করার অঙ্হীকার করে। গতকাল ছিল ৩১শে মে। আজ আমরা জানব তামাকের ইতিবৃত্ত।
প্রায় ৮০০০ বছর আগে পৃথিবীতে তামাকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর ৬০০০ বছর আগে থেকে মধ্য আমেরিকায় তামাকের চাষ শুরু হয়। প্রথমদিকে মূলত ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হতো তামাক। তামাকের শুকনো পাতাকে তামাক বলে। এর পাতা সাধারণত ১২-১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। তামাক থেকে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা ইত্যদি তৈরি হয়।
প্রাচীন কালেই ব্যবিলনীয় ও মিশরীয়দের মধ্যে ধূমপানের প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে প্রাচীন মিশরীয়রা ‘কানাবিস’ নামক ধূমপানের প্রচলন করেছিল। যা ছিল আদতে আমাদের দেশের হুক্কার একটি রূপ। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ শতাব্দীর দিকে মায়া সভ্যতার মানুষেরা ধূমপান এবং তামাক পাতা চিবানো শুরু করে। মায়ানরা তামাক পাতার সাথে বিভিন্ন ভেষজ এবং গাছগাছড়া যোগ করে অসুস্থ্য এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করতো। প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে জানা যায় মায়ান পুরোহিতরা ধূমপান করতো এবং এটা তাদের কাছে বিশেষ অর্থ বহন করতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো ধূমপানের মাধ্যমে আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়। পরবর্তীতে মায়ানরা পুরা আমেরিকায় ছড়িয়ে যায় এবং সেই সাথে তামাক গাছকে ও ছড়িয়ে দেয় আমেরিকা জুড়ে।
ইউরোপিয়ানদের মধ্যে বিখ্যাত নাবিক এবং আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম তামাক গাছ দেখেন ১৪৪২ সালে কলম্বাস যখন সান সাল্ভাদরে গিয়ে পৌঁছান তখন সেখানকার আদিবাসীরা মনে করেছিল কলম্বাস ঈশ্বর প্রেরিত স্বর্গীয় জীব। তারা কলম্বাসকে উপহার স্বরূপ কাঠের তৈরি যুদ্ধাস্ত্র, বন্য ফলমূল এবং শুকনো তামাক পাতা দিয়েছিল। অন্যান্য উপহারগুলো নিলেও কলম্বাস তামাক পাতাগুলো ফেলে দিয়েছিলেন।
ইউরোপিয়ানদের মধ্যে প্রথম ধূমপান করে রদ্রিগো ডি যেরেয। তিনি ছিলেন স্পেনের নাগরিক। ১৪৪২ সালে রদ্রিগো ডি কিউবায় যান। পরবর্তীতে স্পেনে ফিরে গিয়ে তিনি জনসম্মুখে ধূমপান করে মানুষকে চমকে দিতেন। একজন মানুষের নাক এবং মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে এটা দেখে সাধারণ মানুষ ভড়কে যেত। অনেকেই ভাবতে শুরু করে যে রদ্রিগো ডি যেরেযর উপর শয়তান ভর করেছে। তাই রদ্রিগোকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মনাদেস নামের একজন স্প্যানিশ ডাক্তার বিশ্বাস করতেন যে ধূমপান ৩৬ ধরনের অসুখ নিরাময় করে। যেমনঃ দাঁতের ব্যথা, নখের প্রদাহ, জ্বর এমনকি ক্যান্সার। যদিও এটা শুধুই ছিল তার একান্ত বিশ্বাস।
১৮৬৫ সালে ওয়াশিংটন ডিউক নামে আমেরিকার এক ব্যক্তি প্রথম হাতে তৈরি সিগারেট উদ্ভাবন করে। পরে ১৮৮৩ সালে জেমস বনস্যাক নামে আর এক আমেরিকান সিগারেট তৈরির যন্ত্র উদ্ভাবন করে। যা থেকে দিনে প্রায় এক হাজার সিগারেট তৈরি করা যেত। মোগল চিত্রকলা অনুয়াযী ভারতীয় উপমহাদেশে ধূমপানের প্রচলন ঘটান মোগলরা । উপমহাদেশে নবাবি ঘরনার আভিজ্যাতের প্রতীক হয়ে উটেছিল সুগন্ধি তামাক সেবন । পরবর্তী সময় হুক্কা ও ছিলিমের সাহায্যেও ধূমপান করা হত। তামাকের সাহায্যে ধূমপানকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয় ইউরোপিয়ানরা।
প্রথম দিকে শুধু পুরুষরাই ধূমপান করলেও ধীরে ধীরে নারীরা ও আকৃষ্ট হয়। ১৯২৫ সালের দিকে সিগারেট প্রস্তুতকারকরা ব্যবসা বাড়ানোর জন্য নতুন ভোক্তা খুঁজতে শুরু করে। বিজ্ঞাপন ও হলিউডের সিনেমার মাধ্যমে তারা নারীদেরকে সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট করে। জনপ্রিয়তা বাড়ায় সাথে সাথে একটা প্রজন্ম সিগারেটে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুধের সময় সৈন্যরা এত বেশি ধূমপান করতো যে যুক্তরাষ্ট্রে এবং ব্রিটেনে তামাক সংকট দেখা দিয়েছিলো। এজন্য ঐ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তামাককে সংরক্ষিত শস্য ঘোষণা করেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন সিগারেটের উপর ৪৩% ট্যাক্স বৃদ্ধি করে। ফলে ১৪% ব্রিটিশ নাগরিক ধূমপান ছেড়ে দেয়। ১৯৫০ সালের দিকে প্রথম সিগারেটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে প্রচারনা শুরু হয়। ডঃ ওয়ান্ডার ও ডঃ গ্রাহাম একটি গবেষণায় দেখান যে, ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত ৯৫% মানুষই ২৫ বছর বা তার বেশি সময় ধরে ধূমপানে আসক্ত। প্রথম ধূমপান আসক্তি দূর করার জন্য ক্লিনিক খোলেন স্যালফোড নামের এক ব্যাক্তি (১৯৫৮ সালে)। ১৯৬৪ সালে রেডিও টিভি তে সিগারেটর প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে সচেতনতামূলক কথা লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৭১ সালে ইউরোপ ও আমেরিকায় গণপরিবহন এবং সিনেমা হলে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ধূমপান রোধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। আমাদের দেশেও প্রকাশ্য ধূমপান না করার জন্য আইন আছে। কিন্তু সেই আইন এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct