কর্মসূত্রে মুম্বাইপ্রবাসী, আমার বাড়ি হুগলী জিলাতে। করোনা প্রাদূর্ভাবে প্রায় দুমাস মুম্বাই তে ফ্ল্যাটবন্দী অবস্থায় থাকলেও বাড়ীতে একা বয়স্ক বাবা মা এইসময়, এই অবস্থায় কিভাবে থাকবো!! এই চিন্তা বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করলো। তখন ট্রেন, ফ্লাইট কিছুই চলছিল না। ‘মুম্বাই বাঙালী এসোসিয়েশনের’ সাহায্যে এক সঙ্গীও পেলাম। কলকাতা নিবাসী একজন মুম্বাইতে চিকিতসার কারণে এসে প্রায় দুমাসের উপর আটকা। গাড়ী ঠিক করেও একা ফেরার ভরসা পায়নি সে। সঙ্গীও জু্টলো, গাড়ী তো ঠিক করাই ছিলো। মুম্বাই ও বাংলা পুলিশের কাছ থেকে পাস করিয়ে পাঠানো হলো সেই গাড়ী চালক কে। তিনি পাস নিয়ে রওয়ানা হলেন কলকাতা থেকে মুম্বাই। আর সেখান থেকেই “এই মুম্বাই প্রবাসী বাঙালীর লকডাউন ভ্রমণ কাহিনী শুরু”।
গাড়ীবাবু কলকাতা পেরিয়ে ঝাড়খন্ড সীমানায় আসতেই পুলিশ হাতে ধৃত হলেন, অপরাধ?!! এই চারচাকাটির কাছে বাঙলা ও মুম্বাইএর ছাড়পত্র থাকলেও তাতে ঝাড়খন্ডের উল্লেখ তো নেই!! বেচারা আটক রইলো প্রায় ৪ ঘন্টার উপর। তারমধ্যে পাওয়া গেল ঝাড়খন্ডের পাস। প্রথম বাধা পেরিয়ে পরদিন রাতে গাড়ী পৌছালো মুম্বাই। জানা গেল চালকমহাশয় অত্যন্ত ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং সেই বিশ্বাসের ভরে তিনি মাঝরাস্তায় টায়ার পাংচার হতে তাতে তাপ্পি মেরে নিয়ে চলে এসেছেন মুম্বাই, ফিরবেন সওয়ারী নিয়ে কোলকাতা। কিছু বলার ভাষা খুজে না পেয়ে আমিও “দূর্গা” নাম নিয়ে চেপে বসলাম তার গাড়ীতে, ঘড়ি সময় জানাচ্ছে ভোর সাড়ে ৪টে, আমার সঙ্গী চেপেছে তারও আধঘন্টা আগে। সঙ্গীকে প্রথম দেখেই মন ভরসার চেয়ে আশঙ্কাতে কাঁপলো বেশি, অত্যন্ত ক্ষীণদেহী তার চোখে মুখে অসুস্থতার কারণে দূর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। ভাবনা ছিন্ন হলো ঈশ্বরবিশ্বাসী চালকমহাশয়ের কথায় “দাদা, আপনার ফোনে গুগল নেভিগেশনটা অন করে রাখুন।“ সকাল হতেই দেখা গেল হাইওয়েতে অন্য কোনো যান চলাচল না করলেও মাঝেমাঝেই লোকবোঝাই লরী চলছে। মুখোশ বা সামাজিক দূরত্ব কোনোটারই বালাই নেই এই লরীগুলিতে। পশু বোঝাই এর মতো মানুষ বোঝাই করে সারে সারে চলছে তারা, গাদাগাদি করে থাকা মানুশগুলো নিঃশব্দ, কেবল উদ্গ্রীব চিন্তিত চোখেমুখে নিরাপদে ঘরে ফেরার আকুতি। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মননিবেশ করলাম চালকমহাশয়ের একটানা বলে চলা ধর্মজ্ঞানের ভান্ডারে। একবার সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করায় সে আরও বেশি বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েকজনকে পরপর ফোন করে জানালো তার এক আস্তিক সওয়ারী জুটেছে কপালের ফেরে। এইভাবে প্রায় গোরুর গাড়ীর গতিতে গাড়ী চালিয়ে তিনি থামলেন এক ধাবায় প্রাতরাশের উদ্দ্যেশ্যে। প্রাতরাশ হাতে নিতেই এক বিশাল ষন্ড আবির্ভূত হলো আমারই প্রাতরাশ লক্ষ্য করে, খাবার এবং নিজেকে বাঁচাতে আমি ও সে বেশ কয়েকবার চরকি পাক খেতে লাগলাম। চালকমহাশয় নির্বিকার চিত্তে তা উপভোগ করতে করতে ধীরে সুস্থে খাওয়া শেষ করে গাড়ী থেকে একটি বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে তাকে দিতে সে আমাকে ছেড়ে প্যাকেটে মন দিলো। কেমন একটা খটকা রয়েই গেলো, একান্ত ভক্তের এ হেন নাস্তিক সওয়ারীকে জব্দ করতে বাবাই কি তবে...!! সঙ্গী বহু অনুরোধেও কিছু খেলেন না বা নামলেন না।
গাড়ী এবং ঈশ্বরভক্তিগাঁথা আবার একই সাথে চলতে লাগলো, আমিও পুনরায় বাবার বাহনের সাথে দেখা হওয়ার ভয়ে নীরবে তা শুনতে লাগলাম। পথে একবার দুপুরে খেতে দাঁড়ানো ও লরির ভীড় উত্তরোত্তর বাড়ার ফলে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৪ ঘন্টা পিছনে চলা ছাড়া আর কোনো ঘটনা ঘটেনি।
লরীর ভীড় কাটিয়ে চলতে হঠাত একজায়গায় গুগল নেভিগেশন বাঁদিকে একটি ‘সর্ট কাট’ রাস্তা নির্দেশ করতে লাগলো, চালকমহাশয় রাস্তা ও সময় কম লাগবে বলায় আর প্রচন্ড লরীর ভীড় থেকে বাঁচতে গাড়ী চললো বাঁদিকের সরু পথ ধরে। বেশ খানিকদুর চলার পর রাস্তা ক্রমশই দখল নিতে লাগলো মহীরুহ সারি। মন সায় না দিলেও গুগল বাবার উপর আগাধ আস্থা কুচিন্তা কাছে আসতে দিলো না। গাড়ী চলতে লাগলো। আরো কিছুসময় পর বুঝলাম আমরা বেশ গভীর জঙ্গলে তার চেয়েও গভীর সমস্যার মধ্যে পরেছি। কারণ রাস্তা হিসাবে যাকে ধরে আমরা চলছিলাম তিনি আমাদের সাথ ছেড়েছেন, সবচেয়ে বড় কথা যার নির্দেশে এই পথ নেওয়া তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা, কারণ মুঠোফোনটি ‘নেটওয়ার্কের’ বাইরে। সামনে শুধুই জঙ্গল । পথিককে পথ হারিয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করার মতো কাউকে যে এই জঙ্গলে পাওয়া যাবে না তা বুঝতেই আমি ও আমার সঙ্গী আসহায় বোধ করতে লাগলাম। গাড়ী ছেড়ে একটু এগিয়ে দেখতে গিয়ে একটি বোর্ড পেলাম যাতে লেখা ‘Yawal Wildlife Sanctuary’। সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে কিছুটা সামলে নিয়েছে। দুজনে পরামর্শ করে গাড়ী ঘোরাতে বলতেই চালকমহাশয় অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করলেন, আমার মতো নাস্তিক সওয়ারীর হাতে পড়েই যে তাকে এই সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাও জানাতে ভুললেন না। সঙ্গীর ভরসা ও চালকমহাশয়ের বিরক্তির একটানা প্রকাশকে সাথে করে গাড়ী ঘুরলো অচেনা পথে। এর মধ্যে মুঠোফোন নেটওয়ার্ক ফিরে পেলেও গুগল আমার ভরসা হারিয়েছে, গাড়ী চললো আমার ও সঙ্গীর আন্দাজে। চালকমহাশয় ততোক্ষণে মুঠোফোনকে হাতিয়ার করে তার পরিচিতদের জানতে লাগলেন আমা হেন মানুষ তাকে কিভাবে নাজেহাল করে ছাড়ছে।
অবশেষে চওড়া রাস্তা পাওয়া গেলো, আরো এগিয়ে অল্প সল্প মানুষজন চোখে পড়তে লাগলো। তাদের জিজ্ঞাসা করতে করতে রাত ১২ টা নাগাদ এক স্টেশন পেলাম, নাম ‘খান্ডোয়া’ । গুগল বলছে আমরা রাস্তা হারানোয় প্রায় ১০০ কিমি ইন্ডোর দিকে গিয়ে আবার ফেরত এসেছি।
খান্ডোয়া স্টেশনে গাড়ী থামানো হলো, জি আর পি কে অনুরোধ করে সেখানের ওয়েটিং রুমে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়লাম। সেই রাত আমার সঙ্গী একটা চেয়ারে বসে পুরো জেগে কাটালো, ঘুমিয়ে পড়লে পাছে সকালে বেরোতে দেরী হয়ে যায়!
সামনের রাস্তা অত্যন্ত খারাপ, কিন্তু আমাদের যে ভাবে হোক আজ সম্বলপুর পৌছাতেই হবে নাহলে পাসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পঃবঃ ঢুকতে পারবোনা। রাস্তা যতো এগোতে থাকলো চালকমহাশয় ঘুমে প্রায় ঢুলতে লাগলেন। কখনো একটু দাঁড়িয়ে, একটু কথা বলে তাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করতে করতে গাড়ী চললো। রাত ১ টা তেও সম্বলপুর পৌছানো সম্ভব হলো না। এক পেট্রোল পাম্পে গাড়ী রাখা হলো। পাম্পমালিক বারণ করলেও চালকমহাশয়ের তখন এক পাও চলার ক্ষমতা নেই। কোনোমতে তিন জনে গাড়ীর মধ্যে আধশোয়া হয়ে রইলাম। আমার সারারাত কুকুর আর পোকা তাড়িয়ে দিব্যি কেটে গেলো।
পরদিন সকালে ফের যাত্রা শুরু। হিসাব করে দেখলাম এখনো অব্দি ২২ টা টোল পেরিয়েছি। সামনে আবার একটা দেখে মোট টাকার অংকটা মনে করে একটু যেন টলে গেলাম, তাই পাশের এক দোকানে দাড়ালাম হাতও স্যানিটাইজ করবো আর একটু জলও কিনবো। জল কিনে গাড়ীতে ফিরতে যেতেই কিছু স্থানীয় লোক ঘিরে ধরলো, অপরাধ- বাইরের রাজ্য থেকে এসে গাড়ী থেকে নামা!! বহুকষ্টে বুঝিয়ে তাদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা সময় নষ্ট হলো। মারমুখী জনতার হাতে পড়া ও তার থেকে রেহাই পাওয়ার আভিজ্ঞতা যে কি হতে পারে!! সেদিন অনুভব করলাম।
অবশেষে গাড়ী পঃবঃ সীমানায় চাকা রাখলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই সেই নিঃশ্বাস যেন আবার ভিতরে ঢুকে গেল। সামনে পাশে অসংখ্য লরি আর রাস্তার দুপাশে শুধু মানুষের সারি- কেউ বসে কেউ শুয়ে, একজনের ঘাড়ে অন্যজনের মাথা তো তার গায়ে আর একজনের পা। সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং!! মনে হয় আমিই সংজ্ঞাটা ভুল শিখেছিলাম। ১৩০ কোটির গরীব অর্ধভূক্ত দেশে আমার শেখা সংজ্ঞা মিললো না, মিলবে না। সেখানেই আমাদের নামতে হলো। আমার সঙ্গী ও আমি প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে আসার পর একটি লাইনের দেখা পেলাম। তার শেষে দাঁড়িয়ে জানলাম সামনে অগুনতি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ মুখোশ, বারবার হাত ধোয়া, গাড়ী থেকে যতটা সম্ভব কম নামা, রাস্তায় প্রায় কিছু না খাওয়া, স্যানিটাইজারকে সর্বক্ষণ নিয়ে চলা আমার সঙ্গী সব ভুলে ওখানেই রাস্তার উপর বসে পড়লো। আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। শুধু প্রার্থণা করলাম সে যেন সুস্থ থাকে। রাত হতে একবার লাইন রেখে গিয়ে গাড়ী থেকে কিছু খাবার নিয়ে এলাম, সরকার থেকে ডিম ভাতের ব্যবস্থাও করা আছে, কিন্তু সেখানে সবসময় ২৫০০ লোকের লাইন। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল রাস্তার দুপাশে বসে থাকা কাতারে কাতারে শ্রমিক যে যার নিজের জেলার বাসের অপেক্ষায়, সাথী শুধু খোলা আকাশ আর খিদে।
ভোরের আলো ফোটার পর আমাদের সুযোগ এলো ভিতরে যাওয়ার। আমার সঙ্গীর তখন এতটুকুও দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। অবস্থা বুঝতে পেরে আমাদের একটু এগিয়ে দেওয়া হলো। টেস্ট করাতে ঢুকলাম একটি ঘরে, ঘড়ি জানান দিলো সময় সকাল ৭টা। টেস্ট করানোর পর আবারও আপেক্ষা শংসাপত্রটি পাওয়ার। না, সেটি কোনো রিপোর্ট না। তাতে শুধু লেখা থাকবে ‘আমি বাইরে থেকে এসেছি এবং আমার লালারস টেস্টের জন্য সংগ্রহ কর হয়েছে, এখন আমি ১৪ দিন গৃহবন্দী থাকবো।‘ পরের দিন যদি আমার রিপোর্ট পজিটিভ আসে তাহলে আমার দেওয়া ঠিকানায় সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে আমার কাছে গাড়ী পৌছে যাবে। আমাকে যেটা অবাক করলো সেটা এত মানুষের শংসাপত্র দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত কেবলমাত্র একজন কর্মী।
শংসাপত্র হাতে পেয়ে শরীর বেয়ে যেন একটা মুক্তির অনুভব খেলে গেলো। গাড়ীতে উঠে নিজেকে প্রায় ১০-১২ দিন ধরে যুদ্ধ করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে ফিরে নিজের রাজ্যের সীমানায় রাস্তায় বসে থাকা ওই অভুক্ত মানুষগুলোর একজন হিসাবে কল্পনা করতে গিয়ে দেখলাম- পারছি না। বুঝলাম বাস্তব কখনো কল্পনার চেয়েও কঠিন। বাড়ির সামনে নেমে সঙ্গীকে বিদায় জানালাম।
ওর নাম পূজা, কিন্তু এই ৫ দিন আপাতশান্ত, ক্ষীণকায়া, অত্যন্ত কম কথা বলা মেয়েটির যে মনের শক্তি আমি দেখেছি তাকে কুর্ণিশ জানাতে গিয়ে বুঝলাম ছায়ার মতো নিঃশব্দ এক সাথী এই ৫দিন আমাকে একবারও একা ছাড়ে নি, একার অনুভূতি আসতে দেয় নি, এমনকি এটাও কখনো বুঝতে দেয়নি আমার সাথে যে ফিরছে সে একটি মেয়ে। তাই আমার পুরো ফেরার পথে ওর একটাই পরিচয়- আমার যাত্রাসঙ্গী।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct