সৌরভ মন্ডল: মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা। বাঙালির সাথে বাংলা ভাষার নাড়ির টান নিবিড়। মাতৃ জঠরেই মাতৃভাষার সাথে পরিচয় শিশুর। মায়ের সাথে শিশু যেমন চিরবন্ধন, তেমই মাতৃভাষার সঙ্গেও সেই বন্ধন অটুট। বাংলা ভাষা মায়ের ভাষা। এই ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও রয়েছে। বাঙালি এখন বিশ্ব নাগরিক।কিন্তু কতজন বাঙালির মুখে শোভা পায় মধুর বাংলা ভাষা, তা আজ হাতেগুনে বলা যায়। বাংলা ভাষাকে প্রায় ভুলেই যেতে বসেছে বাঙালি। অন্য কোন জাতির মধ্যে নিজের মাতৃভাষা অস্বীকার করার প্রবণতা কতটা রয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু বাঙালির মধ্যে যেন এই প্রবণতা একটু বেশিই বলা যায়। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।বাহান্নর একুশের চেতনায় বিশ্বজুড়ে ভাষা শহীদ আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালামকে বিনম্র চিত্তে স্মরণ করা হচ্ছে। মাতৃভাষার অস্তিত্ব বাঁচাতে ভাষা আন্দোলন এবং তাতে হেলায় প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মতো অহমিকার ইতিহাস একমাত্র যে জাতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেই বাঙালি জাতির জন্যই তার মাতৃভাষা নিজ ভূমে পরবাস! ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু তা বলে নিজের মাতৃভাষা জানবো না ? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন---- ইংরেজি হল জ্ঞানের ভাষা আর বাংলা হলো ভাষা। আর সেই ভাবের ঘরেই প্রতিনিয়ত হচ্ছে চুরি। বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। বাঙালি বরাবরই আত্মবিস্মৃত জাতি। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার অজুহাত দেখিয়ে বাঙালি আজ মাতৃভাষাকেই ভুলতে বসেছে। সন্তানের দুধে-ভাতে থাকার রাস্তা প্রশস্ত করবে শুধুমাত্র ইংরেজি শিক্ষা—এই বদ্ধমূল ধারণা থেকেই বাবা মায়েরা আজকাল “অ- এ অজগর আসছে তেড়ে আ- এ আমটি খাব পেড়ে” এর বদলে A তে Apple, B তে Ball, C তে Cat- কেই বেছে নিয়েছেন। অর্থাৎ যেন তেন প্রকারেণ ইংরেজি শিখতেই হবে। তাহলেই কেল্লাফতে। তাতে করে যদি মাতৃভাষা বাংলা না শেখা যায়, তা যথেষ্ট। আধুনিক বাবা মায়েরা এতে অবশ্য গর্বই বোধ করেন। তারা তো রীতিমত তাল ঠুকে, বুক বাজিয়ে বলছেন ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না ‘। বর্তমান সমাজে কালচারটাই হলো এমন যেখানে ইংরেজি জানাকেই শিক্ষার মানদণ্ড ধরা হয়। তাই মাতৃভাষাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ইংরেজি ভাষা শেখার গড্ডালিকা প্রবাহেই গা ভাসাচ্ছে আধুনিক প্রজন্ম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে মাতৃভাষাকে আত্মস্থ করতে পারে না, অন্য ভাষার উপর সত্যিই কি তার দখল তৈরি হয় ? ভাষার গভীরতা কি বুঝতে পারে সে ? একে ইংরেজি হানাদার, তার ওপর আজকাল হিন্দি, ইংরেজি এবং সামান্য বাংলা শব্দ মিশ্রিত যে বুলি আউড়াতে শোনা যাচ্ছে নতুন প্রজন্মকে, তাতে বাংলা ভাষা তার কৌলিন্য হারাচ্ছে। তাছাড়া টিভি, রেডিও, সিনেমা, সিরিয়ালে যে বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রতিনিয়ত হয়ে থাকে, তা বাংলা ভাষার দীনতাকেই আরও প্রকট করছে বলে মত ভাষা বিশেষজ্ঞদের।
অথচ এমন বাঙালির উদাহরণ ভুড়ি ভুড়ি রয়েছে যারা বাংলা ভাষাতে যেমন পারদর্শী ছিলেন ঠিক তেমনই পারদর্শী ছিলেন ইংরেজিতেও। এক্ষেত্রে যার নাম সবার প্রথমে আসে, তিনি হলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা ভাষাতে গান, কবিতা গল্প, উপন্যাস লিখেই জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন তিনি। গীতাঞ্জলি বাংলাতে লিখেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। তা বলে কি তার ইংরেজি ভাষাতে সমান বিচরণ ছিল না ? নেতাজি সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামীজি, বিদ্যাসাগর, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়ের মতো বিদগ্ধজনেরা তো বাঙালি হিসেবেই বিশ্বের দরবারে পূজিত। বাংলা ভাষাতে লেখালেখি করেই তারা জগত বিখ্যাত। তাই বলে কি তারা ইংরেজি ভাষা জানতেন না ? সবচেয়ে বড় কথা দেশের জাতীয় সংগীত জনগণমন কিংবা বন্দেমাতরম বাংলা ভাষাতেই লেখা। পরে অন্য ভাষাতে অনুবাদ করা হয়। মাতৃভাষাকে অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। মাতৃভাষাকে অবহেলা করে কখনোই কোনও জাতি উন্নতি করতে পারে না। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় তা উপলব্ধি করেছিলেন মধুকবি। প্রথম জীবনে ইংরেজিতে অগাধ দক্ষতা ও আকর্ষণ থেকে ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা শুরু করেও পরবর্তীতে বাংলা ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করতে শুরু করেন তিনি। আর তাতেই মেলে স্বীকৃতি। ইউরোপ ছেড়ে বাংলায় থিতু হওয়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত বুঝেছিলেন “মাতৃভাষা রূপে খনি পূর্ণ মণিজালে “। আক্ষেপ করে মধু কবির স্বীকারোক্তি-----‘ হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন, / তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি, / পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ / পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষনে আচরি, / কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।সম্প্রতি আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা অনুষ্ঠিত হলো সেন্ট্রাল পার্ক মেলা ময়দানে। এখানে নব্য বাঙালি যে বই কেনেনি, তা ঘোর নিন্দুকেরাও বলতে পারবেন না। তবে পরিসংখ্যান বলছে বাংলায় লেখা বই এর থেকে ইংরেজি বই বা ইংরেজিতে অনুবাদ করা বাংলা বই-ই সবথেকে বেশি বিক্রি হয়েছে। সত্যজিতের ফেলুদা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা, শরদিন্দুর ব্যোমকেশ, এমনকি নন্টে ফন্টের ইংরেজি অনুবাদ কিনে মাতৃভাষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গর্বের সঙ্গে বাড়ি ফিরেছে বাঙালি। উপরন্তু বাংলায় লেখা বই যারা কিনেছেন, তাদের দেখে তাচ্ছিল্য বা বিদ্রূপের বাঁকা হাসিও উড়ে এসেছে।প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি এখনো পর্যন্ত ধুমধামের সঙ্গেই ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ পালন করে আসছে বাঙালি। নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্মরণও করা হয় ভাষা- শহীদদের। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তারপর যে কে সেই। এখানেই প্রশ্ন ওঠে বরকত, সালাম জাব্বারদের আত্মবলিদানের মূল উদ্দেশ্য কি মনে রেখেছে আত্মবিস্মৃত বাঙালি? নিজের মাকে ভুলে, মাতৃভাষাকে ভুলে কখনোই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি কোন জাতিরই। তাই হে বাঙালি, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ তে আসুন শপথ করি, বাংলা ভাষাকে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করি। বাংলাতেই বাঁচবো, বাংলাতেই মরবো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct