যে ছায়ায় আলোর মায়া
আহমদ রাজু
তানিয়ার চোখে জলের বান উছলিয়ে উঠেছে ততক্ষণে। সে নিজেকে আর ঠেকাতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ক্ষণেক পরে নিজেকে সামলে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ ও নাকের পানি মুছে বলল, ‘সন্ধ্যার পর তারা কাকলির নিথর দেহ জঙ্গলের ভেতরে ফেলে দিয়ে এসে পরেরদিন মিথ্যা গল্প প্রচার করে- আমার ভাই ইমরান দলবল নিয়ে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে! তারা মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের করে। যে মামলায় আমাদের পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। কেউ কেউ আজও জেলে পঁচে মরছে।’ কথাটা শেষ করতে গত তেইশ বছর জমে থাকা কান্না আবারো বানের জলের মতো উছলিয়ে ওঠে। তার হৃদয় নিংড়ানো কান্নায় উপস্থিত অনেকের চোখে জল এসে যায়। হামিদ গাজীর উকিল যেন সব কথা ফুরিয়ে ফেলেছে। সে ভেবে পায়না কী বলবে। হঠাৎ মনে আসায় সে বলল, ‘আপনার গল্প যুক্তির খাতিরে না হয় মানলাম। তাহলে বলুন, আপনি নিজেইতো সেদিন সাক্ষী দিয়েছিলেন পিতা- ভাইদের বিরুদ্ধে। তাহলে আজ এতবছর পর কী এমন ঘটলো যার জন্যে বয়ান একেবারে উল্টে দিলেন?’‘আমাকে হত্যা করার হুমকি দিয়ে- প্রতিনিয়ত নির্যাতন করে আমাকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করেছিল সেদিন।’‘আমার জানামতে ঘটনার সময় আপনার শাশুড়ী তো বেঁচে ছিলেন। তাহলে তিনি কিছু বলেননি কেন? তিনিও কী তাহলে...!’‘না; একদম না। আমার শাশুড়ী খুব ভাল মানুষ ছিলেন। ঘটনার দিন তিনি দুপুরে ঘুমিয়েছিলেন। উঠেছিলেন পরেরদিন সকালে।’‘এমনটা কী হতে পারে?’‘কিন্তু হয়েছিল সেদিন। শাশুড়ী নিজেই বলেছিল তাকে হয়তো কোনভাবে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। যারা কাকলিকে হত্যা করেছিল তারা সব বলতে পারবে।’বহু যুক্তিতর্কের পরে আদালতের নির্দেশে পুলিশ হামিদ গাজী, হাবলু, ময়েন আর রশিদকে আটক করে। রিমান্ডে নিতেই তারা হড়হড় করে বলে দেয় চাপা পড়ে থাকা সব ঘটনা। তাদের নামে হত্যা মামলা দায়ের হলে তানিয়ার বাবা-ভাই ছাড়া পেয়ে যায়। হয়তো তানিয়াও মুক্তি পেয়ে যাবে এ সংসার থেকে। অবশ্য এখানে আর থাকার ইচ্ছাও তার নেই। সুযোগ থাকলে বহু আগেই চলে যেতো- শুধু মৃত্যুভয়ে আর দুই ছেলের কথা ভেবে সে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। ছেলেরা এখন বড় হয়েছে বলে কোন সিদ্ধান্ত নিতে সে পিছুপা হবে না।এক মহেন্দ্রক্ষণে আদালত চার জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলে কোন পিছুটান তানিয়াকে আটকিয়ে রাখতে পারে না। সে দুই ছেলেকে নিয়ে মেঠোপথ ধরে যখন বাবার বাড়ির দিকে রওনা হয় তখন হঠাৎই কাকলি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। আজ আর কাকলিকে দেখে তানিয়া চমকায় না। যেন সে তারই অপেক্ষায় ছিল। ‘আমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তুমিই আমার হত্যাকারীদের ধরিয়ে দিতে পারবে।’ ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও। এতবছর কিছু না করতে পারার জন্যে।’ বলল তানিয়া।‘তোমাকে ধন্যবাদ ভাবী, তোমার কাছ থেকে আমি এটাই আশা করেছিলাম।’তানিয়ার দুই ছেলে হতবাক। হঠাৎ তার মায়ের কী হলো! এই ফাঁকা রাস্তায় সে কার সাথে কথা বলে? সামনে তো কেউই নেই! বড় ছেলে বলল, ‘তুমি কার সাথে কথা বলছো মা? পাগল হয়ে গেলে নাকি?’‘তোর ফুফুর সাথে।’‘ফুফু! কোন ফুফু?’‘তোর কাকলি ফুফু।’‘তোমার ভুল হচ্ছে, এখানে কেউ নেই।’তানিয়া সামনে তাকিয়ে দেখে সত্যিইতো সামনে কেউ নেই। সে চারিদিক তাকায়। না কেউ নেই। সে মনে মনে ভাবে, কাকলি হয়তো তাকে ধন্যবাদ দেবার জন্যে অবচেতন মনে ফিরে এসেছিল।হামিদ গাজীদের বিচার চলাকালীণ সময়ে কারো কারো সামনে কাকলি পড়লেও যেদিন জজ তাদের সাজার রায় দেন সেদিনের পর কাকলিকে আর গ্রামে দেখা যায়নি। কাকলির ফিরে আসার গল্প যত দিন যায় তত ফুলে ফেঁপে বিস্তর আকার ধারণ করে। হয়তো কাকলি এসেছিল- হয়তো আসেনি। হয়তো হঠাৎই সকল গ্রামবাসীর আত্মচেতন মনে বসত গড়েছিল সে! যাই হোক না কেন, বহু বছর পরে হলেও এক অন্যরকম শক্তি অতীব মিথ্যাকে সত্যের কাছে পরাজিত করে। তানিয়ার হয়তো সত্যকে অনুধাবন করে রুখে দাঁড়াতে বহু বছর লেগেছিল, পারিপার্শ্বিক চাপ- মৃত্যুভয় আর দুই সন্তানের কথা চিন্তা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে যে ঘুরে দাঁড়িয়ে সত্যকে সম্মুখে আনতে পেরেছিল সেজন্যে কাকলি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিয়েছিল চিরতরে- আর ফিরে আসেনি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct