ভারতীয় আরবী সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র (‘আলী মিয়া’)
আব্দুল মাতিন
গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
ভারতীয় আরবী সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী। তিনি ছিলেন বিশ্বময় রোশনি বিকিরণকারী এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা ও বিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ইসলামিক চিন্তাবিদ, ঐতিহাসিক, লেখক এবং পন্ডিত ব্যক্তিত্ব। তিনি বিভিন্ন ভাষায় দুই শ’রও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যিনি “আলী মিয়াঁ” নামেও পরিচিত। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও আধ্যাত্মিকতার অগ্রপথিক ছিলেন তিনি। ইতিহাস দর্শন মনীষা, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, সাহিত্যসাধনা, চিত্ত-শুচিতা, তার নান্দনিক ও সপ্রতিভ জীবন-অভিধানের অনুসঙ্গ। বিদ্বান ও বিদগ্ধজনের কাছে তার পরিচয় নতুন নয়। অভিজ্ঞান, চোতনাপোলব্ধি, বোধ, দূরদর্শীতা দিয়ে তিনি উপমহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আরব, ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দিক-দিগন্ত বর্ণোজ্জ্বল করেছেন। বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক প্রতিভা ওবং প্রানার্দ্রতার কারণে সর্ব শ্রেণীর কাছে তিনি স্থায়ী আসন পেয়েছেন। বিরলজ এই মহান ব্যাক্তি ছিলেন শিক্ষা-আদর্শ, ঐতিহ্য-সভ্যতা ও মুসলিম জাগরণের পার্থসারথি। পুর্ববর্তী সাধক ও তাপস-সম্রাটদের সতত প্রতিচ্ছবি। আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য আন্দোলনের স্বকৃত স্থপতি ও পথিকৃৎ। ১৯১৩ খ্রীস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর ভারতের রায়বেরেলি নামক স্থানে তিন জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আবদুল হাই এবং মাতার নাম খায়রুন্নেসা। মাত্র ১০ বছরেরও কম বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। এমতাবস্থায় বড় দাদা মাওলানা আব্দুল আলী আল হাসানী এবং মা খাইরুন নিসা তাঁর শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শৈশবে মায়ের কাছেই আলী মিয়াঁ আরবি ও উর্দূ ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দে শায়খ খলীল বিন মুহাম্মদ আল আনসারীর কাছে আরবি ভাষা শেখা শুরু করেন এবং এই ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে নদওয়াতুল উলামাতে ড: তাকীউদ্দীন হেলালীর কাছে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ শিক্ষা সমাপন করেন। ১৯২৬ সনে তিনি কানপুরের নদওয়াতুল উলামাতে ভর্তি হন। এ সময়ে আরবি ভাষায় পারদর্শিতার কারণে তিনি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। এবং আরবদেশ থেকে আগত অতিথিদের সাথে দোভাষী হিসেবে তিনি বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন। ১৯২৭ সালে তিনি লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে উর্দূ ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৮সাল থেকে ১৯৩০সাল পর্যন্ত তিনি ইংরেজি ভাষা অধ্যয়ন করেন। যা ইসলাম সম্পর্কে লিখিত ইংরেজি বই থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহে তাঁর সহায়ক হয়।
১৯৩৪ সালে তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং তাফসীর, হাদীস, যুক্তিবিদ্যা, আরবি সাহিত্য ও ইতিহাসের পাঠদান করতে থাকেন। ১৯৩৯ সালে তিনি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন। এই সফরের মাঝেই তিনি মাওলানা শায়খ আবদুল কাদির রায়পুরী এবং বিশিষ্ট ইসলাম প্রচারক মাওলানা মুহাম্মাদ ইলয়াস কান্ধলভীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে নিজের কর্মজীবনের পরামর্শদাতারূপে গ্রহণ করেন। প্রথমোক্ত ব্যক্তির কাছে তিনি তাযকিয়াহ তথা আত্মশুদ্ধি বিষয়ক পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে তিনি ধর্মপ্রচার ও সমাজ-সংস্কার বিষয়ক পরামর্শ গ্রহণ করতেন। সারা জীবন তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর অনেক দেশে ভ্রমন করেন। ১৯৪৩ সালে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য তিনি “আন্জুমানে তা’লীমাতে দীন” নামক একটি এ্যসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি কোরআন ও হাদিসের ওপর বেশকিছু বক্তৃতা প্রদান করেন, যা আধুনিক শিক্ষিত সমাজে সাড়া ফেলে। ১৯৪৫ সালে তিনি নদওয়াতুল উলামার প্রশাসনিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে নদওয়াতুল উলামার তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের পরিচালক সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভীর অণুরোধে তিনি শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালকের পদ গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৪ সালে সুলাইমান নদভীর ইন্তেকালের পর তিনি শিক্ষা বিভাগের পরিচালক নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালেই তিনি তাঁর বিখ্যাত আন্দোলন “পায়ামে ইনসানিয়্যাত” শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আরবি পত্রিকা “আল-বাস” এবং ১৯৫৯ সালে “আর-রায়ীদ”এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে আলী মিয়াঁ দামেশকে ‘আরবি ভাষা ইনস্টিটিউট’এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে তিনি লখনৌতে “ইসলামিক গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থা” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬২ সালে মক্কায় সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবরাহীমের অণুপস্থিতিতে আলী মিয়াঁ “রাবেতাতুল ইসলাম”এর উদ্বোধনী অণুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এই অণুষ্ঠানেই তিনি “ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ইসলাম” শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শ কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। ১৯৬৮ সালে সৌদী শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়াহ বিভাগের পাঠ্যসূচী প্রণয়নে পরামর্শ দেয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৮০ সালে জর্দান আরবি একাডেমির একজন সদস্য নির্বাচিত হন। এই বছরই তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি নির্বাচিত হন।
ভারত উপমহাদেশ পেরিয়ে আরব আজমের মনীষিদের কাতারে তিনি ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ঠের একজন মুসলিম মনীষী। দ্বীনের জন্য গভীর দরদ আর ভালবাসায় হৃদয় সিক্ত এই মহান মনীষী তার দাওয়াহ ও গবেষনাধর্মী লেখনীর মাধ্যমে যে কালজয়ী জ্ঞানের ভান্ডার মুসলিম জাতিসত্বার জন্য রেখে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে মানুষকে আলোর পথ দেখাবে। বলা চলে তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দিতে মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মধ্যে অন্যতম একজন। আল্লামা নদভীর খ্যাতির সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে “সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ” রচনার মাধ্যমে। গ্রন্থটি গোটা ভারতবর্ষে তাকে পরিচিত করে তুলে। এরপর তিনি রচনা করেন ‘মা যা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমিন’ (মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল) নামক কালজয়ী গ্রন্থ। যা তাকে প্রথমত আরববিশ্বে ও পরবর্তীতে বৈশ্বিক সুখ্যাতি এনে দেয়। এ পর্যন্ত গ্রন্থটির ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় শতশত সংস্করণ বের হয়েছে। আধুনিক বিশ্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সভ্য পৃথিবী গড়ার পেছনে ইসলামের অবদান। দেখিয়ে দিয়েছেন মুসলিমদের নেতৃত্বের পতনে বিশ্ব সভ্যতার পরিণতি। বিগত প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে তার কলম অবিশ্রান্তভাবে লিখেছে মুসলিম ইতিহাসের গৌরবদীপ্ত অধ্যায়গুলোর ইতিবৃত্ত। সীরাত থেকে ইতিহাস, ইতিহাস থেকে দর্শন ও সাহিত্য পর্যন্ত সর্বত্রই তার অবাধ বিচরণ। উর্দুর চেয়ে তার আরবী রচনা অধিকতর অনবদ্য। তিনি তার লিখনীর মাধ্যমে যে ভাবে আত্মভোলা জাতির গর্বিত আত্মপরিচয় তুলে ধরেছেন, পথভোলা জাতিকে পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে সত্যসন্ধানী মানুষকে সুপথ দেখাবে। তিনি তার কর্মের মাধ্যমে মরেও আজ অমর হয়ে আছেন। তার লিখে যাওয়া অনবদ্য গ্রন্থগুলো মানুষকে পথের দিশা দিয়ে যাবে চিরকাল।
তার লিখিত ছোট-বড়ো গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধীক। আরবী সাহিত্যে তার উচ্চ মার্গীয় পাণ্ডিত্যে বড় বড় আরব-সাহিত্যিকরা রীতিমত বিস্ময় প্রকাশ করতেন। তার এসব পুস্তক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু ভাযায় অনুদিত হয়েছে। বাদশা ফায়সাল পুরস্কার বিজয়ী শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ জ্ঞানতাপসের রচনাশৈলী, নান্দনিক কাব্যবিন্যাস, বর্ণনার সৌকর্য, দৃষ্টিভঙ্গির নিরম্বু গভীরতী ও বিষয়বস্তুর নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মুসলিমদের প্রাণে নতুন স্পন্দন সৃষ্টি করে। মুসলিমদের হারানো প্রাচীন গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনয়নে তার কলম ছিল সদা সোচ্চার। আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থারূপে ইসলামী চিন্তা-চেতনার অন্তর্নিহিত প্রতিপত্তি তাঁর বই ‘ইলাল ইসলাম মিন জাদিদ’। ইসলামের দেড় হাজার বছরের ধর্মীয় সংস্কার ও জাগৃতি আন্দোলনের নির্বাচিত মনীষীদের জীবনচরিত পাঁচ খণ্ড-বিশিষ্ট ‘রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দাওয়াহ’ গ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেন। নিজের জীবনবৃত্তান্ত ও অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞান লিখে গেছেন ‘ফি মাসিরাতিল হায়াত’-এ। আল্লামা নদভী জীবনে যেমন পরিশ্রম করেছেন, তেমনি তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের নোবেল হিসেবে খ্যাত বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুবাইয়ে তিনি বর্ষসেরা আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের পক্ষ থেকে আলী নদভীকে সুলতান ব্রুনাই এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। তিনি আন্তর্জাতিক বহু ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সদস্য ছিলেন। তিনি একাধারে রাবেতায়ে আলমে ইসলামী এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি ছিলেন। লাখনৌর বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম নাদওয়াতুল-উলামা’ এর রেকটর ও ভারতীয় মুসলনমানদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম মুসলিম পারসোন্যাল ল’ বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। মহান এই ব্যক্তি ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর, পরপারে পারি জমান, এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct