ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এবং ক্লাসের ভূগোল বইয়েও পড়েছি, ভারতবর্ষের ম্যাপে ও দেখেছি আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। শুধু ভূগোল বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম না। ইতিহাসেও পড়েছি। ছোটবেলা থেকে বড়দের মুখে শুনে এসেছি রবি রামের দ্বীপ চালান আর ক্ষুদিরামের ফাঁসি। কথাগুলো শুনে মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন জেগে উঠতো। শুধু রবিরাম কেন? রবি রামের মতো আমাদের এই জন্মভূমি ভারতবর্ষের শতশত স্বাধীনতা সংগ্রামীকে দানব ব্রিটিশ ইংরেজ দ্বীপ চালান বা দ্বীপান্তর পাঠিয়ে দিতো আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। অনেকে আবার আন্দামান কে কালাপানির দেশও বলে থাকে। সেই আন্দামান-নিকোবর সম্পর্কে জানার কৌতূহল অনেকদিনের। সরেজমিনে দেখার সেই সৌভাগ্য এসেই গেল। লিখেছেন মোঃ ইসরাইল সেখ
একদিন সেই আন্দামান যাওয়ার সুযোগ আসলো ভারত সরকারের জলশক্তি মন্ত্রকের অধীনে জল জীবন মিশনের কাজে। আর এই কাজটি পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রাইভেট কোম্পানি। আমি কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে কাজের সুযোগ পাই। আর সেই সুযোগ হাতে আসমানের চাঁদ পাওয়ার মতো। তাই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। কাজের অফিস হতে ফ্লাইট এর টিকিট করে দিয়েছিল মোট 14 জনের। এই 14 জনকে দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল অফিস থেকে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সদস্যের যেহেতু বাড়ি। তাই একদিন আগে গিয়ে ফুলবাগান থানার কাছে বন্ধন লজে রাত্রিযাপন করি সকলে। আর সকলে তো আনন্দে আত্মহারা। কারণ দুজন ছাড়া টিমের বাকি সদস্যদের কেউ ফ্লাইটে চাপিনি। আর না চড়ার দলে আমিও একজন।
16/ 03/ 2022 রবিবার সকাল আটটা চল্লিশে ফ্লাইটের টিকিট। তাই লজ হতে সকাল পাঁচটায় এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম ট্যাক্সি করে। কারণ অনেক কাজ এয়ারপোর্টে। যেমন ল্যাগেজের ওজন ও চেকিং, প্রত্যেক যাত্রীর দেহ চেকিং এমন কি চেকিং এর সময় ছেলেদের কোমরের বেল্ট, মানি ব্যাগ পর্যন্ত চেকিং হয়। সবকিছু চেকিং করার পর উড়ার পালা। 184 সিটের গো ফাস্ট ফ্লাইট দমদম এয়ারপোর্ট থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের উদ্দেশে আকাশ ভেদ করে ছুটতে লাগলো। জানালার পাশে বসে দৃশ্য উপলব্ধি করি আর আনন্দে মন ভরে ওঠে। জানালার পাশে বসে মনে হচ্ছে আকাশ মেঘ যেন ফ্লাইটের কানে কানে কথা বলে যাচ্ছে আর যাত্রীদের স্বাগত জানাচ্ছে। জানলার দিয়ে নিচে তাকালে মনে হচ্ছে আকাশ নিচে আর আমরা উপরে। যাই হোক 1305 কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সময় লাগল দু’ঘন্টা 15 মিনিট। এরপর এয়ারপোর্ট থেকে টাটা সুমো করে চাতুরা নেস্ট হোটেলে গিয়ে উঠে। তারপর খাবার-দাবার খেয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করি স্থানীয় মানুষদের কাছ হতে। জানতে পারি আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মোট 572 টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত । আর এই কেন্দ্র শাসিত রাজ্যের জেলা সংখ্যা 3 টি। যথা দক্ষিণা আন্দামান, উত্তর ও মধ্য আন্দামান এবং নিকোবর। এরপর জিজ্ঞাসা করি এয়ারপোর্ট এর নাম পোর্ট ব্লেয়ার হল কেন? উত্তরে জানায় যে ব্রিটিশ নৌ সেনা অফিসার আচিবাল্ড প্লেয়ারের নাম অনুসারে নাম হয় পোর্ট ব্লেয়ার। এই এয়ারপোর্টের আরেকটি নাম বীর সাবারকর।
এবার জিজ্ঞাসা করি কেন বীর সাবারকর নাম করণ?
উত্তর স্থানীয় মানুষ জানায় বীর সাবারকর একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। যিনি জেল হতে পালিয়ে এসে বর্তমান এয়ারপোর্টের স্থানে আশ্রয় নেন। তাই তাঁর নাম অনুসারে নাম হয় বীর সাবারকর। পরের দিন বাহির হলাম কাজে। কাজে গিয়ে কাজের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে তথ্য শুরু করি। স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে জানতে পারি এই কেন্দ্রশাসিত আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের 60 থেকে 70 % মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।
এবার প্রশ্ন করি এত বাঙালি কোথা থেকে আসলো?
আমায় জানায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশ থেকে অনেক বাঙালিকে এই দ্বীপপুঞ্জের নিয়ে এসেছিলেন। যারা এখানে এসেছিল প্রত্যেককে সরকার বাহাদুরের পক্ষ থেকে বাড়ির জায়গার পাশাপাশি জমি দিয়েছিল আরো দিয়েছিলে চাষের নানান সরঞ্জাম। এখানে বাঙালির পাশাপাশি হিন্দি, তামেলি, সহ আরো অনেক ভাষাভাষীর মানুষ করে। এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা সুপারি ও নারকেল চাষ। এ ছাড়া অন্যান্য চাষ হয় না বললেই চলে। আর উত্তর ও মধ্য আন্দামান জেলায় সুপারির নারকেলের পাশাপাশি ধান ও সবজি চাষ হয় নামমাত্র । এই জন্য এখানকার মানুষ খাদ্যের ব্যাপারে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের উপর নির্ভরশীল। আন্দামানের আরো কিছু তথ্য উল্লেখ করছি, যেগুলো কোন পর্যটক ঠিকমতো নজর দেন না। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ প্রধান শহর ও রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। এই পোর্ট ব্লেয়ার শহরটি দক্ষিণ আন্দামান জেলায় অবস্থিত । এই শহরের সরকারির বাস স্ট্যান্ডের নাম মোহনপুরা।এই বাস স্ট্যান্ড থেকে মূলত দক্ষিণ আন্দামান এবং উত্তর মধ্য আন্দামান গামী AC / NON AC বাস পাওয়া যায়। সরকারি বাস স্ট্যান্ড ছাড়াও বেসরকারির বাস স্ট্যান্ড রয়েছে । সরকারি বাস স্ট্যান্ডিটি মূলত AC বাস স্ট্যান্ড। বাস স্ট্যান্ডের সামনে তেমাথা মোড়ে মাহত্মা গান্ধীর মূর্তি আর মূর্তির কাছে অটো স্ট্যান্ড। এখান কার অটোর ন্যূনতম ভাড়া ত্রিশ টাকা। আর একটি জিনিস দেখে খুব ভালো লেগেছিল, সেটি হলো বাস, অটো, লড়ি, কিংবা ট্যাক্সীর চালকদের পোশাক একই রকম। পোশাকের রঙ স্থানীয় পুলিশের পোশাকের মতো। এখানকার স্থানীয় মানুষের কাছ হতে জানতে পারি এখানে প্রাকৃর্তির কারণে চুরি ডাকাতি নেই বললেই চলে। আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করি যে আমাদের পশ্চিম বঙ্গে রাস্তাঘাটে ক্ষ্যাপা, পাগল, ফকির দেখা মামুলি ব্যপার। কিন্তু আন্দামানে এই সব কিছু দেখতে পাওয়া যায়নি। এখানে রাস্তাঘাট বেশ উন্নত মানের। এখানকার মানুষ প্রায় চাকুরি কিংবা ব্যবসা করে। কিন্তু এখানে প্রত্যেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া।
এবার আসা যাক কোথায় কি দেখেছি। পোর্ট ব্লেয়ারে পা দেওয়ার প্রথম দিনেই পোর্ট ব্লেয়ার শহরের কাছে কারবিন বীচে পৌছালাম অটোতে করে। সকলে আনন্দে আত্মহারা। কারণ সমুদ্রের উতাল পাতাল ঢেউ আর জলের কল কল শব্দে মন ভরে ওঠে। চোখের নজর যতদূর যায় ততদূর জল আর জল। জলের ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে পর্যটকদের স্পিড বোর্ড, কেউ আবার গাড়ি টিউব নিয়ে সমুদ্রের জলে খেলায় মেতেছে, কেউ কেউ গা ধুতে ব্যস্ত সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে। সমুদ্রের বালুচরের বালি সমুদ্রের ঢেউ যেন পর্যটকদের পা ধুয়ে দিতে ব্যস্ত। এরকম অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে আসি। পরেরদিন রওনা হলাম তেলোরাবাদের অভিমুখে। গ্রামটিতে যাওয়ার জন্য বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে করে গেরাচারমা মোড়ে নেমে অটোতে করে পৌঁছাই। স্থানীয় মানুষদের কাছে জল ট্যাঙ্ক বা পাম্প ম্যানের খোঁজ করে জল ট্যাঙ্কে পৌঁছাই। জল ট্যাঙ্ক দেখে প্রথমে অবাক হয়ে যাই। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মত উচু জলের ট্যাঙ্ক নয়। এখানে জলের ট্যাঙ্ক চারকোনা ইটের তৈরি যাকে সাধারণত সাম বলা হয়। এই গ্রামের বাংলা ভাষা কম জনই জানে, তামিল ভাষায় কথা বলে বেশি। রাস্তাঘাট বন্ধুর প্রকৃতির। এই জন্য এক বাড়ি হতে অন্য বাড়ি যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আর জল ট্যাঙ্কের উপরে উঠে দূরে তাকালে যে কোন পর্যটকের নয়ন জুড়িয়ে যাবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct