ছেলের মুখে চিনি
গোলাম মোস্তাফা মুনু
‘ছেলেটার বয়স পাঁচ মাস হয়ে গেল। বুকের দুধে তার আর পেট ভরে না। এখন সে খাবার খেতে চায়ছে; আমি তা বুঝতে পারছি।’ একথা বলে বিজলী বিবি ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়াতে শুরু করে। অদূরে বসে ছাতু খাচ্ছিল বিজলীর স্বামী আবরার শেখ। সে স্ত্রীর কথা শুনে বলে ওঠে, ‘ছেলের মুখে খাবার দিচ্ছো না কেন? নরম ভাত একটু একটু করে দিতে হবে।’ বিজলী বিবি বিস্ময়ের সুরে বলে, ‘ওর মুখে চিনি না দিয়েই ভাত খাওয়াতে শুরু করবো! তা কী করে হয়!’ আবরার শেখ আর কোনো কথা বলে না। নীরব থাকে। বিজলী বিবি ছেলেকে দোলনায় রেখে ঝোলাতে ঝোলাতে বলে, ‘ওয়াসিমের আব্বা, তুমি আর এমন কথা বলবে না।আমাদের তো একটিই মাত্র ছেলে। আমার মনে অনেক শখ আছে। খাসি নিয়ে দরগা যাবো। ওখানে গিয়েই ছেলের মুখে চিনি দেবো। তারপর ভাত খাওয়াতে শুরু করবো। এতে ছেলের মঙ্গল হবে।’
ছাতু খাওয়ার কাজ শেষ করে হাত ধুতে ধুতে আবরার বলে, ‘দেখো বিজলী, এতে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হবে। এত টাকা আমি পাবো কোথায়?’ ‘কেন? তোমার সেই বিশ হাজার টাকা ব্যাংকে নেই?’ ‘তাতে কি হবে? আরও প্রায় দশ হাজার টাকা লাগবে।’ ‘আমি স্বয়ং সহায় দল থেকে ধার নিয়ে নেবো। পরে তুমি দাদন খেটে শোধ দিয়ে দেবে। ব্যাংক থেকে তুমি আজকেই টাকাটা তুলে আনো। আজকে হাটের দিন। খাসিটা আজকেই কিনে ফেলো।’ আবরার শেখ আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে, কাপড়ের একটা ছেঁড়া-ফাটা ব্যাগ থেকে ব্যাংকের পাসবইটা বের করে, জামার বুক পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে ব্যাংকের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর বিজলী বিবি খাতা-কলম নিয়ে মনের আনন্দে লিখতে বসে দরগার শিরনি তৈরির জন্য কী কী লাগবে সেগুলির নাম। সঙ্গে যাদেরকে দরগা নিয়ে যাবে তাদের নামও সে লিখতে থাকে।’ ঘন্টা তিনেক পর। আবরার শেখ বাড়ি ফিরে। স্বামীকে দরজার কাছে দেখেই বিজলী বলতে শুরু করে, ‘এত দেরি হল কেন? হাট যাবে কখন?’ পড়ে থাকা জামার বোতাম খুলতে খুলতে আবরার শেখ মৃদুস্বরে বলে, ‘হাট আর যাওয়া হবে না।’ বিস্ময়ের সুরে বিজলী বলে, ‘আজকে হাট না গেলে পরশুদিন দরগা যাবে কী করে!’ একই রকম সুরে আবরার বলে, ‘এখন আর দরগা যাওয়া হবে না।’
স্বামীর কথা শুনে বিজলী যেন আকাশ থেকে পড়ে যায়। স্বামীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কেন যাওয়া হবে না?’ শান্ত স্বরে আবরার বলে, ‘দেখো বিজলী, দশ বছর ধরে তোমার সাথে আমি ঘর-সংসার করছি। এ দশ বছরের মধ্যে একটা কাজও আমি তোমার কথার বাইরে করিনি। তোমার কথা মত মা-বাবাকে ছেড়ে পাশের গ্রামে বসবাস করছি। ছ’মাস পরেও একবার মা-বাবাকে দেখতে যাই না। ছোট ভাই আমার চেয়েও গরিব, তবুও সে মা-বাবাকে দেখাশোনা করছে। এতদিন মা-বাবার পিছনে এক টাকাও আমরা খরচ করিনি। আর মা-বাবাও আমাদের কাছে কিছু চায়নি। আজ ব্যাংক থেকে ফেরার পথে বাবার সাথে সাক্ষাৎ হয়। মা খুব অসুস্থ। পেটের কী যেন অপারেশন করাতে হবে। এতে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হবে। ছোট ভাই বিশ হাজার টাকা জোগাড় করেছে। বাকি পনেরো হাজার টাকার জন্য বাবা এবং ছোট ভাই পাগলের মত ছোটাছুটি করছে, তা আমি বুঝতে পারলাম। আমার পকেটে বিশ হাজার টাকা ছিল। সেখান থেকে পনেরো হাজার টাকা বাবার হাতে দিয়ে দিলাম।’ ‘দরগা যাওয়ার কথা কি তুমি একেবারে ভুলে গিয়েছিলে?’ বিজলী বিবি হতাশ সুরে প্রশ্ন করল স্বামীকে। আবরার শেখ পূর্বের ন্যায় সুরে বলতে শুরু করে, ‘বাবা-মাকে সন্তুষ্ট না রেখে দরগা গেলে, দরকার পীর হুজুরও অভিশাপ দেবে।খানিক নীরব থাকার পর আবরার আবার বলতে শুরু করে, ‘আমরা যখন আগামী পরশুদিনই ছেলের মুখে চিনি দেওয়ার দিন স্থির করেছি তখন আর দিন বদলাবো না, সেদিনই দেবো - তবে দরগায় গিয়ে নয়; আমার মা-বাবার কাছে গিয়ে। এতে আল্লাহ, আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং পীর হুজুরও খুশি হবেন।’ স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে বিজলী বিবি চোখ মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে খাতার সেই পাতা ছিঁড়ে ফেলে। আবরার শেখ সেই ছেঁড়া পাতার দিকে চেয়ে থাকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct