আরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই উপমহাদেশের মুসলমান সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ ধসে পড়ে। হর স্তরের মুসলমানদের পতন শুরু হয় শাহ ওয়ালিউল্লাহ আপন সমাজের এই পতন রোধ করবার জন্য বিশেষ তৎপর হন এবং তৎকালীন বিচারে একটি নূতন চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন। মাওলানা শাহ ওয়ালিউল্লাহ উপমহাদেশের মুসলমান সমাজের অন্যতম খ্যাতনামা ধর্মবেত্তা দার্শনিক। ইসলামের অসামান্য এক ব্যাখ্যা কর্তা। ইসলামের নীতি ও বিধানগুলোকে যুক্তি ও বিচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার কৃতিত্ব বিষয়। তথাকথিত ওয়াহাবি আন্দোলনের আদি পুরুষ ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ। মুসলমানদের মনোভাবকে বহু ক্ষেত্রেই বিপ্লবীর সাহস নিয়ে আঘাত করেছেন তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ। এই উপমহাদেশে মুসলিম মানুষের সৃজন ও বিকাশ উপর আলোকপাত করলেন খাজিম আহমেদ।
আরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭) পর এই উপমহাদেশের মুসলমান সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ ধসে পড়ে। হর স্তরের মুসলমানদের পতন শুরু হয় শাহ ওয়ালিউল্লাহ আপন সমাজের এই পতন রোধ করবার জন্য বিশেষ তৎপর হন এবং তৎকালীন বিচারে একটি নূতন চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন। মাওলানা শাহ ওয়ালিউল্লাহ উপমহাদেশের মুসলমান সমাজের অন্যতম খ্যাতনামা ধর্মবেত্তা দার্শনিক। ইসলামের অসামান্য এক ব্যাখ্যা কর্তা। (মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির ‘শাহ ওয়ালিউল্লাহ আউর উনকি সিয়াসী তাহরিক’ নামক গ্রন্থের নুরুদ্দিন কৃত বঙ্গানুবাদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা গ্রন্থের ভূমিকা বাংলা একাডেমীর প্রাক্তন পরিচালক কবীর চৌধুরীর মন্তব্য)। ইসলামের নীতি ও বিধানগুলোকে যুক্তি ও বিচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার কৃতিত্ব বিষয়। তথাকথিত ওয়াহাবি আন্দোলনের আদি পুরুষ ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ। মুসলমানদের মনোভাবকে বহু ক্ষেত্রেই বিপ্লবীর সাহস নিয়ে আঘাত করেছেন। (আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাস পৃষ্ঠা ১২১-১২২)। এই সময়ে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক ঐতিহাসিক ড. ইশতিয়াক হোসেন কুরেশি যথার্থই লিখেছেন, ‘মুসলমান সম্প্রদায়ে বহু আগাছার জন্ম হয়েছিল, ধর্মের স্থান দখল করেছিল কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় আনুগত্য স্বার্থপরতার নিকট আত্মসমর্পণ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলমান সমাজে জাঁকিয়ে বসেছিল অজ্ঞতা এবং কুসংস্কার। বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনের অনাচার প্রবেশ করেছিল। (দ্য মুসলিম কমিউনিটি অফ দ্য ইন্দো-পাকিস্তান সাব-কন্টিনেন্ট’ পৃঃ ১২২ এবং এবং রফিউদ্দিন আহমদ ‘দ্য মুসলিমস, ১৮৭১-১৯০৬: আ কোয়েস্ট ফর আইডেন্টিটি’, পৃঃ ২৩-৩৫)।
সেই অনাচার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের মধ্যে চারটি আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল। এই চারটি আন্দোলনের নেতা ছিলেন দিল্লির শাহ আব্দুল আজিজ, বেরিলীর সৈয়দ আহমেদ জৌনপুরের কেরামত আলি (১৮০০-১৮৭৩) এবং ফরিদপুরের হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০)। তথাকথিত ওয়াহাবি আন্দোলনের একটি বিশেষ রূপ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল মীর নিসার আলীর (১৭৭২-১৮৩১) নেতৃত্বে। তিনি তিতুমীর নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। ধর্মীয় কুসংস্কার উচ্ছেদ আর হিন্দু-মুসলমান মজলুম শ্রেণির মুক্তিদাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কি হিন্দু কি মুসলমান শ্রেণির জমিদারদের অত্যাচার নিষ্পেষণ থেকে দরিদ্র, নিঃস্ব কৃষক বর্গকে তিনি রক্ষা করার অভিপ্রায়ে জানপাত লড়াই করেছিলেন, শহীদ হয়েছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকেও তিনি কৃষক আর শ্রমিকদের রক্ষা করেন। এমনকি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মীর নিসার আলী (তিতুমীর) ‘ডেডিকেশন’-এর কারণে মার্কসবাদী ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজ তাকে আজাদী ও কৃষক আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। উপরোক্ত আন্দোলনের চরিত্র ও প্রকৃতি সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী ব্যাপক বিশ্লেষণ ও মতামত রয়েছে। বিস্তর গবেষণা গ্রন্থ ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। (M.A Khan: Faridi Movement karadwi 1965., A. R. Mallick: British Policy & Muslims in Bengal, আব্দুল মওদুদ, ওয়াহাবি আন্দোলন, আব্দুল গফুর সিদ্দিকী, শহীদ তিতুমীর)।
ধর্ম সংস্কারের প্রেরণায় আদি ইসলামে প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশী ওয়াহাবিরা একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলনের ব্যাপক সূচনা হয়। সৈয়দ আহমদ বেরলভী এই আন্দোলনটির নাম দিয়েছিলেন, ‘তরিকা-ই মোহাম্মদিয়া’ অর্থাৎ ‘The order of Muhammad (To be peace on him). এই আন্দোলনে ব্রিটিশবিরোধী একটি দিক ছিল। অনেকে মন্তব্য করেছেন, ওয়াহাবি আন্দোলন ‘আধুনিক ভারতের প্রথম অর্থনৈতিক আন্দোলন।’ এখান থেকেই ভারতের কৃষক আন্দোলনের সূচনা। (আজিজ আহমেদ, ইসলামিক মর্ডানিজম ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান. পৃঃ ১০। উইলফ্রেড কস্টিওয়েল স্মিথ, ইসলাম ইন ইন্ডিয়া, পৃঃ ১)। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। এ আন্দোলন মূলত আরম্ভ হয় ‘বিশুদ্ধ ইসলামে প্রত্যাবর্তনের জন্য’। গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় মুসলমানরা নিজেদের ওয়াহাবি না বলে ‘ফারায়েজী’ (অনাবশ্যক অনুষ্ঠান বর্জনকারী) হিসেবে পরিচিত করেন। বদরুদ্দিন উমর মন্তব্য করেছেন, ‘এই আন্দোলন মূলত কৃষক শ্রেণীর আন্দোলন ছিল।’ ফরাজি আন্দোলনকে অনেকে ‘গণ আন্দোলন’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ফরাজিরা বিশ্বাস করতেন যেহেতু সমগ্র পৃথিবীর মালিক আল্লাহ, সেহেতু জমির উপর তাঁর বান্দার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। উপরন্তু হিন্দুসমাজের অনুকরণে মুসলমানদের সমাজে প্রাদুর্ভূত উচ্চ নিচ ভেদাভেদ অস্বীকার করে সামাজিক বৈষম্য দূর করা। (বদরুদ্দিন উমর, ‘ঊনিশ শতকের বাঙালি সমাজ, পৃ. ১৯, এম. এ রহিম ‘বাঙলার মুসলমানদের ইতিহাস’ পৃ. ৯৮, আনিসুজ্জামান, ‘মুসলিম নাম ও বাংলা সাহিত্য’, পৃ. ৪৭)।
মির নিসার আলী (তিতুমীর)র আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল, ইসলামের গাম্ভীর্য প্রতিষ্ঠা করা। বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে যে অবক্ষয় মুসলমান জীবনকে গ্রাস করেছে তা প্রতিরোধ করা। অনেকেই তাঁকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘প্রথম বাঙালি শহীদের গৌরব’ প্রদান করে থাকেন। (রশিদ আল ফারুকি, ‘বা. উ. মু. লে. অবদান, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ১৫. এম. এ. খান, তিতুমীর অ্যন্ড ফলোয়ার্স, পৃ. ১০, এবং আবদুল মওদুদ, ওহাবী আন্দোলন, পৃ. ১২৫)। সৈয়দ আহমদ বেরলভী নিজেকে ‘খলিফা’ হিসাবে দাবি করেন। তিনি হিন্দুস্তানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিলেন। পরিষ্কার কথা হল, ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য উপেক্ষনীয় নয়। কিন্তু আন্দোলনের নেতারা ইসলামকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ফলত, মুসলমানরা নিজেদের ধর্মীয় সত্তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। ফরাজি আন্দোলনকে ‘সংস্কার আন্দোলন’ (Reform Movement) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন প্রখ্যাত পণ্ডিত আজিজুর রহমান মল্লিক। (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৩ এবং ৭৬)।
হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) এই আন্দোলনের উদ্গাতা, প্রবক্তা। মোহসেনউদ্দিন দুদু মিঞা (১৮১৯-১৮৬২) এবং আব্দুল গফুর ওরফে নোয়া মিঞা (১৮৫২-১৮৮৩) ধর্মীয় সংস্কারে আগ্রহী ছিলেন এবং ফরাজি আন্দোলনে ক্রমানুসারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ‘তারাও চেয়েছিলেন মুসলিম হুকুমতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা’। (মুজাফফর আহমেদ, আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, পৃ. ৯১)। বিশিষ্ট ইসলামী ধর্মতত্ত্ববিদদের নেতৃত্বে ফরাজী ওয়াহাবি আন্দোলন পরিচালিত হয়। তারাই মুসলমানদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। ... প্রথমদিকে এইসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের জাগরণ ঘটে। তাতে ধর্মতত্ত্ববিদদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তাদের কাছে ব্রিটিশ শাসনের অধীন ভারত ছিল ‘দারুল হরব’, তাকে তার ‘দারুল ইসলাম’-এ পরিণত করতে চেষ্টা করেন। সিপাহী বিদ্রোহেও মুসলমানদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক এবং বিস্তৃত। কারণ, মুসলমানদের কাছ থেকেই ব্রিটিশ কোম্পান ‘এই দেশ কেড়ে নিয়েছিল’। (অমলেন্দু দে, ‘ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুসলিম সমাজ’, চতুরঙ্গ, নভেম্বর ১৯৮৭। এবং ফারুকি, ‘দ্য দেওবন্দ স্কুল’, পৃ. ২-৩, আনিসুজ্জামান, ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, পৃ. ৭১, কাজী আব্দুল মান্নান, ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’, পৃ. ৫৯। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ‘সামাজিক প্রবন্ধ’, ভূদেব রচনা সম্ভার, তৃতীয়াংশ)। স্বভাবতই ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষোভ ও বিদ্বেষ স্বাভাবিক ছিল। অবশ্য এই বিদ্রোহে হিন্দু, মুসলিম, শিখ সকলেই অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এই বিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। অনেকে বলে থাকেন এ বিদ্রোহের মারফত মুসলিম রাজ শক্তির পুনরুদ্ধার সূচনার চেষ্টা হয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিকবর্গ বিশ্লেষণ করে থাকেন, ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘সর্বশ্রেণীর সর্বস্তরের মানুষের একটি জাতীয় অভ্যুত্থান’ এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম গণবিদ্রোহ হিসেবে। (প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, ভারতের জাতীয় আন্দোলন, পৃ. ২৪। বদরুদ্দীন উমর, সাম্প্রদায়িকতা, পৃ. ৪, নরহরি কবিরাজ, স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা, পৃ. ২০০ এবং ৮৭।) ১৮৫৭-র পর গোটা মুসলমান সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়, তারা অসি ছেড়ে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে থাকে, পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণেও আগ্রহী হয়। মুসলমানরাও উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অগ্রসর হয়। এতদিন এই ক্ষেত্রটি ছিল বর্ণহিন্দুদেরই একমাত্র আধিপত্যের ক্ষেত্র। এখন নতুন উপদ্রবের আশঙ্কায় তারা জনশিক্ষার বিরুদ্ধতা আরম্ভ করল। (আব্দুল মওদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃ. ১৪২।) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে শিক্ষিত মুসলমান সমাজেও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত থেকে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় মুসলিম সমাজের উন্নতি সাধনের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। মুসলিম সমাজের স্বাতন্ত্র্য বোধ বজায় রেখেই তারা সমাজের উন্নতি সাধনের প্রয়াসী হন। ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করার মধ্যে আধুনিকীকরণের সূচনা এবং আত্মানুভূতির সংমিশ্রণেই মুসলিম সংঘটিত হয়। (অমলেন্দু দে, প্রাগুক্ত প্রবন্ধ, চতুরঙ্গ, নভেম্বর ১৯৮৭। এবং এম. মুজিব, ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলিমস’, পৃ. ৪৩২-৪৩৩)।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct