নায়িকার সন্ধানে
আসগার আলি মণ্ডল
_______________________
সকাল থেকে একটা ব্যাপার নিয়ে সৌমেনের ব্যস্ততার শেষ নেই। নিজের লেখা চিত্রনাট্যের জন্য আর বুঝি মানানসই নায়িকা খুঁজে পাওয়া যাবে না। নায়িকার খোঁজে এখানে ওখানে,হাটে-বাজারে অনেক সময় অতিবাহিত করেছ। এবার হাল ছেড়ে দেবার পালা। তবুও মন মানে না।আর একটি বার চেষ্টা করে দেখার জন্য মনস্থির করলো।
সেই মতো পরের দিন সকালে স্নান খাওয়া সেরে বাউড়িয়া স্টেশন থেকে বর্ধমান জংসনের একটা রিটার্ন টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলো। ট্রেন চলতে লাগলো নিজের গতিতে। সৌমেন চোখ বন্ধ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বসে আছে মনের মধ্যে অনেক চিন্তা নিয়ে।হাওড়া স্টেশনে ট্রেন যখন পৌঁছালো বেলা তখন দশটা।এবার পূর্ব রেলের ট্রেনে চাপতে হবে বর্ধমান যাওয়ার জন্য।
স্টেশনের মাইকে ঘোষণা শুনে সেই মতো চার নম্বর প্লাটফর্মে উপস্থিত হলো।থেমে থাকা ট্রেনের জানালার ধারে একটা শিটে গিয়ে বসলো।ঠিক সাড়ে দশটার সময় ট্রেন ছাড়লো। ডানকুনি,মশাগ্রাম ছাড়িয়ে ট্রেন যখন বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছালো তখন দুপুর বারোটা। ট্রি স্টল থেকে একটু চা খেয়ে স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে সিয়ারা বাজার গামী বাসে উঠতেই এক অপরুপা সুন্দরী মহিলার দেখা মিললো। সৌমেনের বাঁ চোখটা আনন্দে নেচে উঠলো। এত দিন পর একটা মনের মতো নায়িকার দেখা পাওয়া গেছে। কিন্তু না,ভালো করে নিরীক্ষণ করার পর কপালের উপরে একটা কাটা দাগ দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে সৌমেনের মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল।এ জন্মের মতো আর বুঝি নায়িকা পাওয়া যাবে না।
সিয়ারা বাজারে বাস থেকে নেমে বেশ খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালো সৌমেন।ভালো কিছু চোখে না পড়ায় ওখান থেকেই আবার বাসে চেপে সোজা চলে এলো কার্জন গেট। পড়ন্ত বেলায় রাস্তায় লোকজনের ভীড়ও রয়েছে। এবার কিছু খেতে হবে খুব ক্ষিদে পেয়েছে সৌমেনের। একটা খাবারের দোকান দেখে সামান্য কিছু খেয়ে নিলো। তারপর যে ভাবে বর্ধমান পৌঁছে ছিলো ঠিক সেই ভাবেই সেই পথ ধরেই বাউড়িয়া স্টেশনে ফিরে এলো। প্লাটফর্মে বসে ভাবতে লাগলো কি করা যায় ! ভাবনাএকটা এলো বটে,তবে কতটুকু ফল পাওয়া যাবে সেটাই চিন্তার ব্যাপার। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এসে একটা টো-টো গাড়ি চেপে চলে এলো বাউড়িয়া লঞ্চ ঘাটে। সূর্য তখন অস্ত চলে গেছে। চারিদিকে নেমে এসেছে অন্ধকার। দূরে নদীবক্ষে জেলেদের নৌকায় টিম-টিম করে জ্বলছে তেলের বাতি। দু’পাড়ে জ্বলে থাকা লাল সাদা আলো নদীর শোভা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। তেলের জাহাজগুলো সেজে উঠেছে অপরুপ আলোক মালায়।
পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে লঞ্চের এক কোনে গিয়ে বসলো সৌমেন। সামনে বসে থাকা এক মহিলার উপর চোখটা আঁটকে গেল। গায়ের রঙ দুধে আলতায় গোলা। নাকটা বাঁশির মতো,পটলের মতো চোখ,ঠোঁট দুটি কমলা লেবুর কোয়ার মতো। আনন্দে আত্মহারা হয়ে অপলোক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। একবার দু’জন দু’জনের চোখে চোখ রাখলো। পরক্ষণে দু’জনেই খুব লজ্জা পেয়ে গেল।
বজবজ কালীবাড়ি ঘাটে লঞ্চ ভিড়লো। ওরা দু’জনেই লঞ্চ থেকে নেমে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। সৌমেন একবার ভাবলো নামটা জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়। পরক্ষণে আবার ভাবলো জিজ্ঞাসা না করাই ভালো। কোথা কি ভেবে বসবে ! এই ভাবে দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় পড়ে থাকা একটি ডাবের খোলে পা লেগে গেল সৌমেনের। সঙ্গে সঙ্গে ডাবের খোলটি রাস্তার মধ্যে ঘড়-ঘড় শব্দ করে গড়িয়ে যেতে লাগলো। তা দেখে মহিলাটি মুখে হাত চাপা দিয়ে খিল-খিল করে হেসে উঠলো।সৌমেন খুব লজ্জা পেয়ে গেল।
দুলকি চালে হাঁটতে-হাঁটতে ওরা দু,জন পৌঁছে গেল বজবজ প্লাটফর্মে। থেমে থাকা বজবজ-শিয়ালদহ ট্রেনের কামরায় জানালার ধারে একটা শিট দেখে মহিলাটি বসে পড়লো। অগত্যা উপায় কিছু নেই ভেবে সৌমেন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইলো। অফিস ফেরত লোকজনে ভরে উঠলো ট্রেনের প্রতিটি কামরা। এক সময় হলুদ আলোর সিগন্যাল বাতি দেখা দিতেই হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। সৌমেন দেখলো মহিলাটি হাত নাড়ছে তাকে উদ্দেশ্যে করে। বিদায় জানাচ্ছে।এই সব দেখে সৌমেনের চোখের কোন জলে ভিজে গেল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে লাগলো এবং মনে মনে ভাবতে লাগলো,একেই বোধ হয় বলে প্রেম। সৌমেনের হৃদয় দলে-পিশে একাকার করে দিয়ে প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল ট্রেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct