ফৈয়াজ আহমেদ: করোনার বিধি নিষেধ এখনও বহাল আছে। ফলে ভ্রমণ পিপাসু মানুষজন ঘরবন্দি। তবুও মন মানে না তাই এবারে হদিশ দিলাম কোলকাতার একদম কাছে ইতিহাসকে ভর করে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ করার এক অসাধারণ জায়গার। যেখানে গেলে আপনি পিছিয়ে যাবেন একেবারে কয়েকশ বছর। চাক্ষুস করতে পারবেন তৎকালীন রীতি-রেওয়াজ ও এক মজার ইতিহাস।
১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় ঘটেছিল এক মজার ঘটনা। বজবজ থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে গঙ্গার ঘাটে নোঙর করল এক বিশাল বাণিজ্যতরী৷ সে দিন সেই আগন্তুক বাণিজ্যতরীটি দেখে তৎকালীন জমিদার মশাই তৎক্ষণাৎ তরীটি আটক করার নির্দেশ দিলেন। বাণিজ্যতরী থেকে নেমে এলেন ছোটো ছোটো চোখবিশিষ্ট এক ব্যক্তি। জমিদারের নায়েব তাঁর কাছে জানতে, তাঁদের জমিদারিতে এ ভাবে পা রাখার উদ্দেশ্য কী। প্রত্যুত্তরে মানুষটির কাছ থেকে জবাব এল, “আমি মি: টং আছিও, তোমাদের জন্য চা নিয়ে এসেছি।” জমিদারবাহিনী তো শুনে থ। এই ‘চা’ আবার কী বস্তু৷ তখন টং আছিও সেই মুহূর্তে জাহাজের কর্মীদের সাহায্যে সবাইকে চা বানিয়ে খাওয়ালেন৷ খেয়ে সবাই বুঝলেন কী অদ্ভুত পানীয়! খাওয়ামাত্র শরীর চাঙ্গা।
সেই থেকেও ভারতের মাটিতে আরম্ভ হল চা-পানের অধ্যায়। শুধু সে দিন ভারতীয় জমিদাররাই নন, তৎকালীন গভর্ণর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের মুখেও এই চা নামক বস্তুটির স্বাদ পৌঁছে গেল৷ টং আছিওর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল হেস্টিংস সাহেবের। আছিও সাহেব-এর ইচ্ছা ভারতে একটি চিনিকল স্থাপন করা। হেস্টিংস সাহেব তার প্রস্তাব মেনে চিনিকল তৈরি করার জন্য বজবজের কাছে গঙ্গার ধারে বার্ষিক ৪৫ টাকার বিনিময়ে ৬৫০ একর জমি প্রদান করলেন। এর কিছিুদিন পর থেকে সেই জমিতে চিনিকল বসিয়ে চিনি উৎপাদন শুরু করেন আছিও সাহেব। এছাড়া শোনা যায় টং আছিও সাহেবই নাকি কোলকাতায় টানা রিক্সার প্রচলন করেন।
টং আছিও ভারতে পাকাপাকি বসাবস শুরু করেছিলেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। জানা যায় তাঁকে দেখাশোনা করত এক মুসলিম মহিলা নাম টেলি বিবি।
চিনা সাহেব টং আছিওর সেই জায়গা আজ অছিপুর নামে পরিচিত। সেই অছিপুরেই একটি জায়গার নাম চিনেম্যানতলা। যে জায়গায় আছিও ও তাঁর সঙ্গীরা ভারতের মাটিতে প্রথম পা রাখেন বর্তমানে সেই স্থানটিই চিনেম্যানতলা নামে পরিচিত৷ কেউ কেউ আবার স্থানটিকে চিনেকুঠিতলা বলেও ডেকে থাকেন৷ নামে ‘চিনে’ থাকলেও বর্তমানে এখানে কোনো চিনার বাস নেই। তবে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির ১২ থেকে ২৪ তারিখ চিনা নববর্ষ উপলক্ষ্যে এখানে জাঁকালো উৎসব হয়। সেই সময়ে দেশের নানা প্রান্ত, এমনকি বিদেশ থেকেও চিনারা এখানে আসেন৷ চিনেম্যানতলার প্রধান দ্রষ্টব্য ‘পাকুমপাহ’র মন্দির। সেই মন্দিরের বিগ্রহ দু’টিকে স্থানীয় মানুষ খোদা-খুদি নামে ডাকেন৷ এই মন্দিরটি আছিও সাহেব নির্মাণ করান৷
তৎকালীন সময়ে বজবজও সুন্দরবন এলাকার মধ্যেই পড়ত, ফলতঃ এখানেও বাঘের উপদ্রব ছিল বলে বাঘদেবতাকে তুষ্ঠ করতে একটি দক্ষিনরায়ের মন্দিরও নির্মান করেছিলেন। এছাড়া চৈনিক দেবদেবীর মন্দির ‘পাকুমাহ’ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসবই এখনও বিদ্যমান গেলেই দেখতে পাবেন, আর একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে পারবেন।
মন্দিরের মুল গেট দিয়ে বেরিয়ে ডান হাতে কিছুটা পথ গিয়ে গঙ্গা৷ গঙ্গা এখানে বেশ চওড়া, অপর পারে উলুবেড়িয়া৷ এই গঙ্গার পাড় ধরে বাঁ দিকে কিছুটা গেলে রয়েছে আছিও সাহেবের সমাধি৷ সমাধিস্থলটি নির্জন। জোয়ারের সময়ে গঙ্গার জলের ছলাৎ ছলাত শব্দে মনটা ভরে ওঠে৷ জীবনের সমস্ত কষ্ট-বেদনা, না-পাওয়া, সব মিটিয়ে এক অনাবিল আনন্দে যেন পরিপূর্ণ পরিপুর্ন করে দেয় এই স্থান। সমাধিবেদিটি সুন্দর করে বাঁধানো, লাল রঙের।
আছিও সাহেবের সমাধি ছেড়ে দক্ষিণমুখী আরও পনেরো মিনিট হাঁটার পর বাঁ হাতে পড়বে নবাবি আমলে নির্মিত এবং বর্তমান আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত বারুদকল। গঙ্গার পাড় বরাবর বেশ কিছুটা সময় ধরে হেঁটে মনকে তৃপ্ত করে নেওয়া যায়৷ এই হল আজকের অছিপুর৷
ফেরার পথে চড়িয়াল মোড় থেকে অটো বা ম্যজিক গাড়িতে করে বাওয়ালি ট্রেকার স্ট্যান্ডে নেমে বাঁ হাতি পথে মিনিট পাঁচেক পথ হেঁটে ঘুরে নিতে পারেন বাওয়ালি রাজবাড়ি৷
কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে বজবজ লোকালে বজবজ স্টেশন। সেখান থেকে অছিপুরের অটোতে বড়োবটতলা নেমে বাঁহাতি রাস্তায় হেঁটে ১০ মিনিট বা রিকশায় ৫ মিনিটে পৌঁছে যান চিনেম্যানতলা৷ আর ধর্মতলা থেকে ৭৭ নং বাসে চড়ে সরাসরি পৌঁছে জেট পারেন অছিপুর বড়োবটতলা৷
এছাড়া প্রাইভেট গাড়ি করে কোলকাতা থেকে মাত্র ২০কিমি দূরে ঘুরে আসতেই পারেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct