চোখের পলকে
এরসাদ মির্জা
_______________
একা একা সফর করার কথা ভাবলেই আমার টেনশন শুরু হয়ে যায়। সামান্য কিছু পথ যাওয়ার হলেও একে ওকে জিজ্ঞাসা ক’রে, কারো সঙ্গ পেলে তবেই যাই। সমস্যাটা হয় শহর থেকে গ্রামে ফেরার সময়; সঙ্গ পাওয়া খুবই দুঃসাধ্য। তেমনি ছিল আজকের দিনটা। বিষণ্ণ মনে একা একা ফিরছিলাম গ্রামে।
ট্রেনের উইন্ডো সিটে বসে চোখ মেলে দেখছিলাম বাইরের জগৎটাকে। সবুজে ভরা মাঠ আর তার বুক চিরে আঁকাবাঁকা মেঠোপথগুলি দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আহঃ! কি মনোরম দৃশ্য! কিন্তু, কথা বলার মতো পাশে কোনো সঙ্গী না থাকায় মনের ভেতর কেমন যেন একটি অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। বাইরের ওসব সৌন্দর্যের ছোঁয়া মনে লাগছিল না। তাই, ডাইরিটা বের করে বুনতে শুরু করলাম আপন মনের জগৎ।
মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরের জগৎটাকে অবলোকন করছি আর আপন মনে গল্প লিখে চলেছি। দেড় দু পৃষ্ঠা মতো হবে, হঠাৎ অনুভব করলাম, পাশ থেকে কেউ যেন ঝাঁকি দিয়ে দেখছে। ঘাড় কাত করে দেখি, একটি মেয়ে। দুধে-আলতা গায়ের রঙ, টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো ছুঁচলো নাক, একটু লম্বাটে মুখ, দীর্ঘ চোখের পাতা আর তার মাঝখানে লাজুক চঞ্চল দুটি ঘন কালো চোখ।
কলম থামিয়ে, আমি ফ্যালফ্যাল তার দিকে চেয়ে দেখছি আর সে চোখের পাতাগুলো পিটপিট ক’রে আপন মনে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছে ডাইরির লেখাগুলি। একটু পর, চমকে উঠে বলল, ‘ওহ্, স্যরি.. স্যরি। না বলে পড়ে ফেল...।’ আমার ধ্যানও ভ্রষ্ট হল। বললাম, ‘ইটস্ ও’কে।’ বলেই ডাইরিটা বন্ধ করে দিলাম।
জানালা দিয়ে বাইরের দিকেই দেখছিলাম, হঠাৎ আওয়াজ এল, ‘সুন্দর লিখেছ। গল্প টল্প লেখালেখি করো বুঝি?’ আমি ফিরে দেখলাম। কিছু বলার আগেই সে বলল, ‘আজকাল ট্রেনে-বাসে সেরকম কাউকে বই পড়তে দেখা যায় না। তোমাকে লিখতে দেখে কৌতুহল বাড়ল, তাই পড়তে...।’ আমি বললাম, ‘না, না.. ঠিক আছে।’ বলেই তার ছুঁচলো নাকটির দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ সে বলল, ‘আমি রেশু।’ চোখ না সরিয়েই বললাম, ‘ওহ্.., আমি সা’দ।’
বাকি পথটুকু আর কথা হয়নি। গল্পের শেষটুকু লিখতেও ইচ্ছে হল না। চুপচাপ বসে রইলাম। একটু পর, দু’একবার চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে মুচকি হেসে উঠল রেশু। তারপর কি যে হল, ঘনঘন ফিরে দেখতে লাগল। আমি তেমনটি করিনি, একভাবেই তার দিকে চেয়ে রইলাম। বার্বিডলের মত পিটপিট চোখে, ঘনঘন দ্যাখে আর না-বলা অনেক কিছুই যেন ব’লে যায়- কাছে আসার আকুতি, পাশে থাকার অধিকার ও তাকে নিয়েই গল্প লেখার কথা।
চমক ভাঙল, সুটকেসটা হাতে নিয়ে ট্রেন থেকে তাকে নেমে যেতে দেখে। ভারাক্রান্ত চোখে সে ফিরে ফিরে দেখছিল, তারপর শুকনো হাসি হেসে নেমে গেল।
জানালা দিয়ে এদিক ওদিক নজর ফিরিয়ে তাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, পাশের প্লাটফর্মে একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে রেশু। মন উথালপাথাল করতে শুরু করল। চোখ ভরে এল। শেষে, সব বাধা পেরিয়ে ইশারায় তার থেকে ফোন নম্বর চাইলাম। ছলছল চোখে মাথা নেড়ে সায় দিল সে। সিট ছেড়ে দৌড়াতে লাগলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে ট্রেন কেঁপে উঠল। ধুকপুক ধুকপুক হৃদয়ে গেটে গিয়ে দেখি চারপাশে অগণিত মানুষের ভিড়, সেই ফাঁকা জায়গাটায়, রেশুকে ঘিরে। দুরুদুরু মনে মানুষের ব্যারিকেড ভেদ করে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, জমিনে লুটিয়ে প’ড়ে রেশু, রক্তে স্নাত! আর, ঘাতক ট্রেনটি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct