আপনজন ডেস্ক: মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে একটি পরিবার কাজের তাগিদে বছর দশেক আগে ঘাঁিট গেঁেড়ছিল কেরলে। পরিবারের সঙ্গে যেতে হয়েছিল ছোট্ট রোকশত খাতুনেরও। তখন সে পড়ত প্রথম শ্রেণিতে। বাংলা ভাষা ততটা আয়ত্তে করারর আগেই কেরলে পাড়ি দেওয়ায় বাংলা চর্চা অার সেভাবেই হয়ে ওঠেনি। অজ্ঞাত মালয়লাম ভাষার স্কুলেই তাকে ভর্তি হতে হয় পড়াশুনার জন্য। আস্তে আস্তে সড়গড় হয়ে ওঠে রোকশত। অবশেষে ভাষার গণ্ডি অতিক্রম করে এবছর কেরলের এসএসএলসি বা সেকেন্ডারি স্তুরের পরক্ষিায় সব বিষয়ে ‘এ + গ্রেড’ অর্জন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে মুর্শিদাবাদের মেয়ে রোকশত খাতুন। কেরলে এ বছর এসএসএলসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রায় ৩০ শতাংশ পরীক্ষার্থী এ + গ্রেড অর্জন করেছে। কাজেই দশম শ্রেণির মূল্যায়নে এ+ গ্রেড অর্জন করায় অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু এর মধ্যেও রোকশত খাতুনের কৃতিত্ব এক আলাদা মাত্রা পেয়েছে। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট মেয়ে রোকশত কেরলে রাজধানী কোঝিকোড জিএনএসএস-এর এনজিও কোয়ার্টারস স্কুলের ইতিহাসে সব বিষয়ে এ+ গ্রেড পেয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে।
এ বিষয়ে ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিককে রোকশত জানিয়েছে, ‘আমি খুব খুশি যে আমি সমস্ত বিষয়ে এ + গ্রেড পেয়েছি। এতটা আমি এটা আশা করিনি।’
রোকশত জানায়, ১২ বছর আগে কর্মসংস্থানের খোঁজে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে গোটা তার পরিবার মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম ছেড়ে কেরলে চলে আসে। রোকশতের কথায়, বাংলায় মাত্র ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে। পরে কেরলের স্কুলে ভর্তি হয়। যেহেতু কেরলে পড়াশোনা মালয়ালম ভাষাতে, তাই প্রথমে ভাষা বুঝতে আর পড়তে খুবই আসুবিধা হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে বন্ধুদের সাথে যখন থেকে মালয়ালম ভাষাতে কথা বলতে শুরু করে ধীরে ধীরে তার জড়তা কাটতে থাকে। এখন মালয়ালম আর তার কাছে কোনো কঠিন বিষয় নয়। এ ব্যাপারে স্কুলের শিক্ষিকরা তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। তারাও কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন রোকশতকে শব্দ, ভাষা ইত্যাদি বিষয় শেখাতে। হিন্দি তার প্রথম পছন্দের বিষয়।
রোকশতের কথায়, তার পরিবারের বাকি সকল সদস্য এখনও মুর্শিদাবাদেই থাকেন, ছুটি বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্রায়ই বাড়িতে আসে সে। তার পরিবারে আছেন মা-বাবা আর দিদি। তাদের সঙ্গেই থাকে ছোট্ট রোকশত। তার দিদি নাজিয়া খাতুনও একই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী। অত্যন্ত মেধাবী বলে তার দিদিরও যথেষ্ট সুনাম রয়েছে স্কুলে। দুবছর আগে এসএসএলসিতে নটি বিষয়ে এ + গ্রেড অর্জন করেছিল নাজিয়া খাতুন।
বর্তমানে কোঝিকোডের শেভরামবালামের সিএইচ হাউজিং কলোনিতে বর্তমানে রোকশতের পরিবারের বাস। তার বাবা রফিক শেখ কারখানার কর্মী। আর মা ঝুমা বিবি স্থানীয় এক বাড়িতে মহিলা কর্মচারী হিসাবে কাজ করেন। মেয়ের এই সাফল্যে পুরোপুরি খুশি তার মা। তার কথায়, খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে রোকশত, পড়াশোনা নিয়েই দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকে সে, বলেন মা। তিনি আরো বলেন, তার দুই মেয়ে যতদূর পড়াশোনা করতে চায়, তিনি তত দূর পর্যন্ত তাদের পড়াতে চান, তিনি এখনই চান না তার মেয়েরা উপার্জন করুক। রোকমতের মা ঝূমা বিবি বলেন, কেরলে আসার আগে আমাদের অনেক লড়াই করতে হয়েছিল। আমাদের কিছুই ছিল না। আমরা ভাষা জানতাম না এবং স্কুলে কীভাবে বাচ্চাদের ভর্তি করব সেই বিষয়েও কিছু জানতাম না।
খানিক ঋণ পরিশোধ করার জন্য এখানে আসা, এখন অবস্থা আগের থেকে ভালো। গ্রামের দিকে একটা ছোট্ট বাড়িও নিজেরা করতে পেরেছি।
তিনি আরো বলেন, কয়েক বছর ধরে, আমরা তাদের বাড়িতে পড়িয়েছি এবং পরে আমাদের এক প্রতিবেশী তাদের স্কুলে ভর্তি করতে সাহায্য করেছিলেন। সেই থেকে আমাদের দুই মেয়েই ওই স্কুলে পড়াশোনা করে। সেখানকার সমস্ত শিক্ষকই অত্যন্ত নম্র ও বিনয়ী স্বভাবের।
জিএনএসএস-এর এনজিও কোয়ার্টারের এক শিক্ষক বলেন, রোকশত খুবই মেধাবী ছাত্রী। প্রথমে সে এখানে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিল। তখন তার বয়স প্রায় সাত বছর। তার বয়স এবং মানসিক ক্ষমতা বিবেচনা করে স্কুল তাকে চতুর্থ শ্রেণিতে উন্নীত করে। পরীক্ষার পরে তার বোনকেও দ্বিগুণ পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতে একজন ব্যাংকার হিসাবে নিজেকে দেখতে চায় রোকশত খাতুন, তার স্কুলেই সে বাণিজ্য বিষয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct