মজিবুর রহমান: বাংলার বাঘ তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একবার একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, শিক্ষার ধারাকে স্বাভাবিক ও সাবলীল রাখতে প্রয়োজন পড়লে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকেও সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা যেতে পারে। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত ব্রিটেনে বিদ্যালয়ের পড়াশোনা যাতে ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে ওই দেশের পড়ুয়াদের যুদ্ধের প্রভাবমুক্ত অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর কথা ভেবেছিলেন। কোঠারি কমিশনের পর্যবেক্ষণ ছিল- “ভারতের ভাগ্য এখন তার শ্রেণিকক্ষে নির্মাণ হচ্ছে।” শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কিত এই ভাবনাগুলোর সঙ্গে আমাদের বঙ্গে বর্তমানে শিক্ষার যে অবস্থা তার কোনও সাযুজ্য আছে বলে মনে হয় না।
পশ্চিমবঙ্গে স্কুল কলেজে কারণে অকারণে পঠনপাঠন বন্ধ রাখার বহর থেকেই শিক্ষাকে গুরুত্বহীন বিবেচনা করার প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্ষায় একটু বেশি বৃষ্টি হলে, গ্ৰীষ্মকালে একটু রোদ-গরম বাড়লে অথবা শীতকালে জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়লে এ রাজ্যে বিদ্যালয় বন্ধ রাখাই দস্তুর। স্কুলে ‘সরকারি প্রোগ্ৰাম’, সুতরাং ক্লাস সাসপেণ্ড। ‘নির্বাচন জরুরি’, অতএব স্কুল ছুটি।বাজারে ব্যাধি এসেছে, অতএব অনির্দিষ্টকালের জন্য বিদ্যালয় বন্ধ। যেকোনও বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে যে ‘প্রেসক্রিপশন’ তৈরি হয় তার এক নম্বর পথ্য হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ প্রদান করা হয়ে থাকে। সমাজ, প্রকৃতি কিংবা রাজনীতি যেখানেই বিপত্তি ঘটুক না কেন তার প্রভাব বিদ্যালয়ের পঠন পাঠনের উপর পড়বেই। যেন সরকার তথা প্রশাসনের কাছে পড়াশোনার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই!
কোভিড-১৯ অতিমারির আবহে শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় ও অপাংক্তেয় মনে করার প্রবণতা আরও বেড়েছে। আমাদের সকলের মধ্যে একটা অদ্ভুত ও অযৌক্তিক ধারণা সৃষ্টি করা হচ্ছে যে, বিদ্যালয়ে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সমবেত হলেই করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাবে। পড়ুয়ারা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলে সংক্রমিত হয়ে পড়বে।সুতরাং শিক্ষার্থীদের ‘সুরক্ষা’র কথা ভেবে কোনও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না এবং পড়াশোনা ও পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার নামে যেভাবে মাসের পর মাস বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হচ্ছে তাতে তাদের ভবিষ্যতই বিপন্ন হয়ে উঠছে। আমরা বুঝবার চেষ্টাই করছি না যে, ছাত্রছাত্রীরা সংক্রমণ সংক্রান্ত মিথ্যা আশঙ্কার শিকার হচ্ছে। ঘটনা হল, স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা যে বয়স বিভাগের মধ্যে অবস্থান করে তাতে তাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।এজন্য গত দেড় বছর ধরে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ওই বয়সের ছেলেমেয়েদের সংখ্যা অতি নগণ্য।তাছাড়া সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের লোকজনের মতো দু-চারজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংক্রমণ অথবা মৃত্যুকেও স্বাভাবিক ঘটনা মনে করতে হবে।আর, সংক্রমণ বাড়িতেও হতে পারে আবার বিদ্যালয়েও হতে পারে। ভাইরাসের তো বাড়ি ও বিদ্যালয়ের মধ্যে কোনও পছন্দ (চয়েস) নেই! সুতরাং বিদ্যালয় বন্ধ রাখা জরুরি নয়।
স্কুল স্তরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।অথচ এই দুটো পরীক্ষার একুশ-বাইশ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে একজনেরও করোনায় মৃত্যু হওয়ার খবর নেই।একটা অমূলক আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে দিনের পর দিন পড়াশোনা ও পরীক্ষা বন্ধ রাখার কোনও মানে হয় না। বিদ্যালয়ে সুশৃঙ্খল ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে সমস্ত সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে ক্লাস ও পরীক্ষা আয়োজন করার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নেই। সাধারণত রাজনৈতিক ও সামাজিক সমাবেশে অনিয়ন্ত্রিত ভিড় হয়ে থাকে যা থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।অথচ সেগুলোই চলছে আর স্কুল কলেজ বন্ধ! অফিস কাছারিতে কাজকর্ম হচ্ছে, বিপণীতে সব ধরনের সামগ্ৰীর বিকিকিনি চলছে। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ।নেশা করার জন্য মদের দোকান কিংবা বিনোদনের জন্য প্রেক্ষাগৃহ খুললেও পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় খোলা যায় না! বিচিত্র ব্যাপার!
প্রশ্ন হল, যে ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজ যেতে দেওয়া হচ্ছে না তারা কি করোনার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাড়িতেই বসে থাকে? তারা কি পথে ঘাটে বের হয় না? হাটে বাজারে যায় না? সংসার সমাজের কাজ করে না? তাদের কোন কাজটা আটকে আছে? প্রকৃতপক্ষে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে তারা কিন্তু সবকিছুই করছে।বরং দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে ছাত্রছাত্রীদের কেন্দ্র করে কিছু সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে। যেমন, পড়ুয়াদের মধ্য থেকে এখন বেশি বেশি বেআইনি শিশু শ্রমিক তৈরি হচ্ছে। দারিদ্র্য পীড়িত পরিবারের ছেলেরা মজুরির বিনিময়ে কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের ছেলেরাও শুধু শুধু বাড়িতে বসে না থেকে দূরে পাড়ে কাজের সন্ধান করছে। এরই ফলশ্রুতিতে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের পড়ুয়াদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ চেন্নাই, কেরলে নির্মাণ শিল্প বা রাজমিস্ত্রীর কাজে ব্যস্ত রয়েছে। আপাতত এরা শখের শ্রমিক।কিন্তু এদের একাংশ উপার্জন ছেড়ে আর কখনও লেখাপড়ার অঙ্গনে ফিরে আসবে না। বলা যায়, এদের ছাত্র জীবনের ইতি ঘটে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে স্কুল কলেজ বন্ধ বলে ছাত্রীরা বাড়িতে বসে থেকে ‘বড়’ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং অভিভাবকরা তাদের ‘সম্বন্ধ’ দেখছে এবং অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সরকারি নির্দেশে বিদ্যালয় বন্ধ আছে ঠিকই কিন্তু সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নাবালিকা বিয়ে হয়েই চলেছে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের কত উপভোক্তা যে আঠারো বছরের কম বয়সে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ‘K2’-এর টাকা পায় তার ইয়ত্তা নেই।
অতিমারিতে পরীক্ষা ও পড়াশোনা বন্ধ কিন্ত পড়ুয়াদের বিভিন্ন ইন্সেন্টিভ স্কলারশিপ চালু রয়েছে।আসলে উপলক্ষ্য অঢেল, যত ঘাটতি মূল লক্ষ্য লেখাপড়ায়।বিদ্যালয় বন্ধ রাখার কারণে পড়াশোনার যে ভয়ংকর ক্ষতি হয়ে চলেছে তা নিয়ে যাতে ক্ষোভের সঞ্চার না হয় তার জন্য এখন পরীক্ষা না করেই প্রমোশন আর ঢালাও নাম্বার প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু পড়াশোনা ও পরীক্ষা ছাড়াই যে প্রমোশন অথবা অধিক নাম্বার পাওয়া যায় তাতে তো কারও যোগ্যতা বাড়ে না! আসলে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ইন্সেন্টিভ স্কলারশীপ দেওয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু যে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করলে তারা সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে মর্যাদাব্যঞ্জক পেশায় যুক্ত হয়ে উপার্জন করতে পারত সেই পথ রূদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ রাখা অথবা পরীক্ষা বাতিল করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনায় শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের শামিল করা হচ্ছে না।শিক্ষক-শিক্ষার্থী পরীক্ষক-পরীক্ষার্থীদের কোনও কথা শোনা হচ্ছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রের দুই প্রধান অংশকে ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে। অথচ তাঁদেরই পরীক্ষা-পড়াশোনা সংক্রান্ত সমস্যা-সমাধান সম্পর্কে সম্যক ধারণা রয়েছে।তাঁরাই ওই ব্যাপারে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। কিন্তু যে মন্ত্রী আমলা আধিকারিকরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই।ফলে তাঁদের গৃহীত সিদ্ধান্তে অনেক ফাঁক ফোকর থেকে যাচ্ছে। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। সবকিছু তাড়াহুড়ো করে করার ফলে ভুলের সম্ভাবনা বাড়ছে। ‘পরীক্ষা’র মূল্যায়ন সঠিক না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হঠকারী সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বিদ্যালয় প্রধানরা অমানসিক পরিশ্রম করছেন। কিন্তু পড়ুয়া বা পরীক্ষার্থীদের যেকোন ‘বঞ্চনা’র জন্য তাঁদেরই দায়ী করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।ছুটির মধ্যে জরুরি কাজে স্কুলে সহকারী শিক্ষকদের উপস্থিতি সংক্রান্ত নির্দিষ্ট সরকারি নির্দেশিকা না থাকার জন্য শিক্ষকদের মধ্যেও বিরোধ ও বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। অতিমারির অবসানে অবশ্যই আবার বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পঠনপাঠন শুরু হবে।কিন্তু ইতিমধ্যে যে ক্ষতগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো সহজে দূর হবে বলে মনে হয় না।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল, সাগরদীঘি, মুর্শিদাবাদ)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct