২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশি ট্রাজেডির দিন। ২৬৪ বছর আগে ১৭৫৭ সালের এ দিনে পলাশীর আম বাগানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা বিহার ও ওড়িশার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয় ঘটে। অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। উপমহাদেশকে সেই গোলামীর গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়েছে দুই শত বছর। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাবের পরাজয় এই জাতির জন্য এক বিরাট শিক্ষা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই ঐতিহাসিক পরাজয় থেকে জাতি ন্যূনতম শিক্ষাও অর্জন করেনি। পলাশির প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পেছনে ঐতিহাসিকগণ মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাকেই দায়ী করলেও সেটাই একমাত্র প্রধান কারণ ছিল না। এর পেছনে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। তা নিয়ে লিখেছেন ইয়ামিন খান।
২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশি ট্রাজেডির দিন। ২৬৪ বছর আগে ১৭৫৭ সালের এ দিনে পলাশীর আম বাগানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা বিহার ও ওড়িশার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয় ঘটে। অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। উপমহাদেশকে সেই গোলামীর গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়েছে দুই শত বছর। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাবের পরাজয় এই জাতির জন্য এক বিরাট শিক্ষা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই ঐতিহাসিক পরাজয় থেকে জাতি ন্যূনতম শিক্ষাও অর্জন করেনি। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পেছনে ঐতিহাসিকগণ মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাকেই দায়ী করলেও সেটাই একমাত্র প্রধান কারণ ছিল না। এর পেছনে ছিল আরো গভীর ও অন্তর্নিহিত কারণ।
ইতিহাসে দেখা যায়, ১৭১৯ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তার মৃত্যুর পর ওই বছরই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে বসেন সুজাউদ্দিন খাঁ। অতঃপর আলীবর্দী খাঁ ক্ষমতায় বসেন। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল ২২ বছর বয়সে সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন। তরুণ নবাবের সাথে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ইংরেজদের পূর্ণিয়ার শওকত জঙ্গকে সাহায্য করা, মীরজাফরের সিংহাসন লাভের বাসনা ও ইংরেজদের পুতুল নবাব বানানোর পরিকল্পনা, ঘষেটি বেগমের সাথে ইংরেজদের যোগাযোগ, ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ সংস্কার, কৃষ্ণ বল্লভকে কোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় দেয়া ইত্যাদির জন্যই ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে সকাল সাড়ে ১০টায় ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তি মাত্র জানেন, বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময়ে নবাবের অধীনে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫০,০০০। আর ইংরেজ কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের অধীনে ইংরেজ ও এ দেশীয় মিলে সর্বসাকুল্যে ৩,০০০ সৈন্য। যে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাবের পরাজয় হয় বলে উল্লেখ করা হয়, তার অধীনে ছিল ১৬,০০০ সৈন্য যারা নবাব বাহিনীর সাথে ইংরেজদের যুদ্ধের সময়ে সেনাপতির হুকুমে নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এরপরও নবাবের হাতে যে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ছিল, ইংরেজদের পরাজিত করে এদেশ থেকে বিতাড়িত করা ছিল তার বাম হাতের কাজ। এমনকি মীরজাফর যদি তার অধীনস্ত ১৬,০০০ সৈন্য নিয়ে নবাবের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো তথাপিও নবাবের বিজয় হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাংলার নবাব সেদিন পরাজিত হয়ে জীবন দিয়েও প্রিয় জন্মভূমিকে দাসত্বের নির্মম শৃঙ্খলে বন্দি হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলেন না। কিন্তু কেন? যেখানে সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রসম্ভার, রসদ ও বাহন সবকিছু ছিল বিদেশিদের তুলনায় অনেক বেশি, তাছাড়া আপন প্রকৃতি, পরিবেশ সবই ছিল নিজেদের অনুকূলে, তথাপি এই ঐতিহাসিক পরাজয়ের কারণ ছিল জাতির অনৈক্য, ক্ষমতালোভী, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এবং হিন্দু সরকারি কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্র।
সেদিন শুধু মীরজাফর নয়, ইয়ার লতিফ খান, রাজা রাজবল্লব, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণবল্লভ, মানিক চাঁদ, আমির চাঁদ, আমির বেগ, খাদিম হোসেন ও নবকুমারসহ সিরাজের বেশ কয়েকজন সেনাপতি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। সাম্রাজ্যবাদীদের সামান্য প্রলোভনে নিজ মাতৃভূমির সাথে বড় বিশ্বাসঘাতকতার একমাত্র কারণ ছিল নিজেদের মধ্যেকার অনৈক্য, ক্ষমতার কাড়াকাড়ি ও হানাহানি। আমরা জানি, আল্লাহ তার যেসকল প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা তার বিশাল সৃষ্টিজগৎ পরিচালিত করেন তার মধ্যে অন্যতম অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় বিধান হচ্ছে ঐক্য অনৈক্যের ওপর বিজয়ী। একশ’ জন ঐক্যহীন লোক তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে দশজন ঐক্যবদ্ধ লোক বিজয়ী হবে। এটা হাজার বছর আগেও যেমন সত্য ছিল, তেমনি হাজার বছর পরেও সত্য থাকবে। তাই ঐক্যে বিজয় আর অনৈক্যে পরাজয়। পলাশীর যুদ্ধে জাতির এই অনৈক্য তাদের এতটাই দুর্বল করে দিয়েছিল যে মাত্র ৩,০০০ সৈন্যের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল ৫০,০০০ সৈন্যের অধিপতি নবাবকে।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় আমাদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। আমরা সকলেই জানি, সুলতানী ও মোঘলদের সময়ে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। যার ফলে পরসম্পদলোভী বিদেশি লুটেরা ইংরেজরা এদেশে এসেছিল ভাগ্য পরীক্ষা করতে। তারা বণিকের বেশে তুলোদ-কে রাজদ-ে পরিণত করে ভারত দখল করে ভারতের সম্পদ, শস্য, অর্থ লুট করে নিঙড়ে নিয়ে নিজেদের দেশ তথা ব্রিটেনকে অধিকতর সমৃদ্ধ করেছে। ব্রিটিশদের নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মেরুদ- ভেঙে দিয়ে গেছে। ব্রিটিশরা এদেশের মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে শুধু বন্দুক আর চাবুকের জোরে শাসন করেছে। তারা আমাদের ওপর জাতিবিনাশী দলাদলির অপরাজনীতিক সিস্টেম চাপিয়ে দিয়ে গেছে, যেই সিস্টেম একটা দিনের জন্যও এজাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেয়নি। তাদেরই শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণিটি পশ্চিমাদের প্রভুজ্ঞান করে এবং নিজেদের মনে করে বর্বর এবং পশ্চাৎপদ একটি জাতি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct