সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১ কিস্তি ৩
(একজন ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখে কীভাবে নিজেকে আমূল পাল্টে নিতে পারলেন, তা নিয়ে এ উপন্যাসের শুরুতে পরতে পরতে বিতর্ক জমে উঠেছে। কে শেষ পর্যন্ত সেই বিতর্কে প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারলেন? স্বদেশের বিবেক দেবনাথ, নাকি বিদেশের জুলিয়াস ফুসিক? জানতে হলে পড়তে হবে ‘সময়ের স্বরলিপি’ উপন্যাসের সূচনাপর্ব।)
তখনও কেউ জানতে পারেন নি, সভাপতির আসনে বসে বিবেক দেবনাথ নিজের মতামত জানানোর ক্ষেত্রে কত বড়ো বিবেকবান হয়ে উঠতে পারেন, মানসিকতায় কী অসম সাহসী হয়ে যেতে পারেন। একটা বসার আসন একজন মানুষের ভিতরের জগতকে কীভাবে পাহাড়ের মতো উঁচু করে তুলতে পারে, তা বিবেক দেবনাথ ভালো করেই বুঝতে পারলেন। সদর্পে উঠে দাঁড়ালেন সভাপতি হিসেবে ভাষণ দিতে। মরা বাঘ দেখতে মানুষের মধ্যে যেমন হঠাৎ করে কৌতুহল তৈরি হয়, উপস্থিত সকলের মধ্যে তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ তৈরি হল বিবেকের ভাষণ নিয়ে। একেবারে থমথমে পরিবেশ। বিশেষ করে শিক্ষিত মানুষরা অনেক বেশি হতচকিত। ভরাটি গলায় থেমে থেমে বিবেক দেবনাথ বেশ দাম্ভিকতার সাথে বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী।
সভার মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু হল। হিসেব মিলে যাওয়ায় কারুর কারুর মধ্যে গোপন আত্মতৃপ্তির হাসি। আয়োজকদের মধ্যে অনেকেই হতভম্ভ। তরুণ সম্পাদক ভেবে পেল না, এত বড়ো ড্যামেজ কীভাবে পূরণ করা সম্ভব। দুচোখের সামনে একমাসের বেশি অমানবিক পরিশ্রম যেন হঠাৎ করে পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়ে গেল। তার মাথার ভিতরে একটাই চিন্তা, আশেপাশের গ্রাম থেকে যেসব শিক্ষিত মানুষ এসেছেন, তাঁরা কত না খারাপ ভাবছেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বিবেক দেবনাথ যে ক্ষতি করলেন, তা মূল্যবোধের অঙ্কে অপরিসীম। সভাপতি হিসেবে নিজেই অনুষ্ঠানটা মাটি করে দিলেন। সাধারণ দর্শক শ্রোতারাও বিবেকের ব্যবসাতত্ত্বকে ঠিকমতো মেনে নিতে পারলেন না। শুনে শুনে তাদের মধ্যে যে পুরনো ধারণা গড়ে উঠেছিল, তা হল, রবি ঠাকুর জমিদার ফেমিলির লোক। সারা জীবন লেখালেখি করেছেন। ‘গাতীঞ্জলী’ কাব্যের জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। সেজন্য তিনিই একমাত্র বাঙালী বিশ্বকবি। সেই কবিগুরুকে বিবেক দেবনাথ কেন যে বড়ো ব্যবসায়ী বললেন, তা তাদের মাথায় ঢুকল না। একজনের মন্তব্য, ব্যাটা চাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বলেই রবি ঠাকুরকে নিজের লাইনে ঢুকিয়ে নিতে পারলেন।
বিবেক দেবনাথ আবার বলতে শুক্ত করলেন, আপনাদের মুখ দেখে বুঝতে পারছি, আমার মন্তব্যে আপনারা সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। যা কেউ বলেন নি, তা বলার জন্যে এমনি বিরূপ ভাবনাই স্বাভাবিক কিন্তু আমার ব্যাখ্যা শুনলে আপনারা বুঝতে পারবেন, আমি কিছু ভুল বলি নি।
মূর্খ দেবনাথের মুখে আবার নতুন মন্তব্য শোনার জন্যে সকলের মধ্যে অভিনব কৌতূহল তৈরি হল। তারা এত নীরব হল যে পিন পড়লে শোনা যেতে পারত।
আমার ব্যাখ্যাটুকু মন দিয়ে শুনুন, তাহলে আপনাদের ভিতরের বিড়ম্বনা সম্পূর্ণ দূর হয়ে যাবে। রবি ঠাকুর সর্বপ্রথম শিখিয়ে গেছেন, বিনা পয়সায় বাঙালীরা কীভাবে বই ব্যবসা করতে পারে। এ বিষয়ে আমি তাকে কবিগুরু মনে করি না, পরম শিক্ষাগুরু হিসেবেই ভাবি। রবি ঠাকুরের বই ঘরে রেখে সকলে নিজেদের কৌলীন্য রক্ষা করতে চায়। বাঙালি জাতির বিশেষ অহঙ্কার। তাই প্রকাশকরা লাভের আশায় নিজেদের এজেন্টদের হাতে রবীন্দ্রনাথের বই বিক্রির দায়িত্ব ছেড়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠা করেন না। তাঁরা জানেন, এ সব বই বিক্রি হবেই। ফলে যাদের গেঁটে পয়সা নেই, তারা মূলধন না নিয়ে রবি ঠাকুরের বই বিক্রি করে দিব্যি নিজেদের সংসার চালিয়ে নিতে পারে। এভাবেই বিশ্বকবি বাঙালি সমাজে বিনা পুঁজির ব্যবসা চালু করে দিয়ে গেছেন। সেজন্যে আমি তাকে সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী বলে উল্লেখ করেছি।
সম্পূর্ণ নতুন মূল্যায়ন। অভিনব ব্যাখ্যা। একেবারে নতুন আলো। সামনে দাঁড়ানো উপস্থিত সকলে কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। কালবৈশাখী ঝড়ে গাছপালা তছনছ হয়ে গেলে প্রকৃতির বুকে নেমে আসে শান্ত থমথমে ভাব। তাৎক্ষণিক পরিবর্তিত পরিস্থিতি ঠিক সেরকম। নতুন জীবনরস জাগছে সবার মধ্যে। বিবেক দেবনাথ কীভাবে এত বড়ো কথা বলতে পারলেন, তা ঠিক করতে পারলেন না হাইস্কুলের দুই শিক্ষক। জীবনরসের এত বড়ো উপাদান লুকিয়ে ছিল একজন মূর্খ চাল ব্যবসায়ীর মধ্যে? তাহলে কী ভিতরে আরও গুরুত্বপূর্ণ মালমশলা লুকিয়ে রয়েছে? এতক্ষণ যারা সামনে দাঁড়িয়ে বিবেককে সমালোচনার কাঁটায় বিদ্ধ করতে ব্যস্ত ছিল, তারা নতুন যুক্তি জালে আটকে নিজেদেরকে পাল্টাতে শুরু করল। যদিও মনের আকাশে জমে ওঠা থোকা থোকা কালো মেঘের বিস্তার তখনও শেষ হয়ে যায় নি। মেঘলা আকাশ প্রথমে সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলে, তারপর পরিপূর্ণ রোদে ঝলমলিয়ে ওঠে। বিবেকের কথায় গ্রামের দুই শিক্ষক নতুন করে ভাবার সুযোগ পেলেও অর্জিত শিক্ষাদীক্ষার কথা ভেবে কিছুতেই নিজেদের বিরুদ্ধ অবস্থান থেকে সরে আসতে পারলেন না।
একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার নাম স্থবিরতা, জীবনের নতুন বাঁকে মিশে যাওয়ার নাম আধুনিকতা—এসব জেনেও দুজন শিক্ষক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন।
শীতের জড়তা তাঁদের মনে, তাতে বসন্তের হাওয়া লাগাতে রাজি নন তাঁরা। শীতের ক্ষমতা নেই আগত বসন্তকে আটকে রাখার— তা জেনেও না জানার ভানে আটকে থাকলেন। তবে অবাক হলেন এই ভেবে যে বিবেক দেবনাথ ভিতরে ভিতরে নিজেকে এত বেশি পাল্টে ফেললেন কী করে?
নাটক শুরু হল সাড়ম্বরে। মঞ্চে রঙ-বেরঙের আলো। দর্শকদের মনে নতুন কৌতুহল। বিবেক দেবনাথ দর্শক আসনের সামনের সারিতে ভারিক্কি মনে বসে আছেন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। তা নিয়ে অন্যদের মনে কোনো আপত্তি ছিল না, বরং অন্য কৌতুহল ছিল। যে মানুষ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যভাবনা নিয়ে এত বড়ো কথা বলতে পারলেন, রক্তকরবী নাটক দেখে তিনিও পারেন নতুন কিছু মন্তব্য করতে। আয়োজকদের মনে অন্য মূল্যায়ন। বিবেক দেবনাথ সাহায্য না করলে তারা এ নাটক মঞ্চস্থ করতে পারত না। প্রতি বছর ২৫শে বৈশাখ নতুন নাটক নামাতে গেলে তার সাহায্য নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। নাটকের প্রতি বিবেক দেবনাথের কতটুকু প্রকৃত ভালোবাসা আছে, তা জানার প্রয়োজন বোধ করল না তারা, বরং ভাবল, তাদের আয়োজনে বিবেক দেবনাথের বদান্যতা স্থায়ী হয়ে উঠুক। নিজেদের যুক্তিজালে নিজেরাই আটকে থাকল বন্দী মানুষের মতো।
আলো আঁধারের দ্বন্দ্ব চিরকালের। নাট্যদ্বন্দ্বে সেই সুর থাকে। রক্তকরবী নাটকের একদিকে রয়েছে জীবন বিকাশের প্রতি অনন্য ভালোবাসা, অন্যদিকে কেবলমাত্র অর্থবলকে সম্বল করে জীবনের সব মূল্য শুষে নেওয়ার তাগিদ। ধনকুবের যক্ষপুরীতে আর্থিক শক্তিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও কেন যে শেষ পর্যন্ত নন্দিনী বিশুকে জয় করতে পারলেন না, সেই প্রশ্ন তাঁর কাছে প্রবল হয়ে উঠল। শেষ উপলব্ধি হল, এত অর্থবল থাকা সত্ত্বেও মানুষ তাকে ভীষণ ঘৃণা করে। কেউ তার পক্ষে নেই। অথচ বিশু নন্দিনী কেবল ভালোবাসা দিয়ে সকলের মন জয় করতে পারল। ধনকুবের হয়েও তাকে ঠায় দাঁড়িয়ে তাদের কাছে হারতে হল। অন্যায় আর্থিক শক্তির চেয়ে মানুষ যে খুব বেশি করে জীবন বিকাশের অনুসঙ্গ পছন্দ করে, নন্দিনী বিশুর জয়লাভ সেই সত্য প্রমাণ করে দিল।
রাত দশটায় নাটক শেষ হলে সাধারণ দর্শকরা হইহই করে বিশু নন্দিনীর মানসিক ইমেজ নিয়ে বাড়িতে ফিরল। কেবল বিবেক দেবনাথ বেশ কিছু সময় গুম মুখে বসে থাকলেন। এ নাটক তাঁর ব্যক্তিজীবনের পরাজয়কে কেমন যেন বড়ো করে তুলল। সেই গ্লানি তাঁর মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে। জীবন কী, তাই নিয়ে অনেক প্রশ্ন জাগছে তাঁর মধ্যে। ভালোবাসার সাথে আর্থিক জোরের যে পার্থক্য, তার একটা ছবি ভেসে উঠল বিমুঢ় বিবেকের মধ্যে। জলের স্রোত গভীর হলেও ভারী পাথর সহজে সরতে চায় না। নতুন পরাজয়ের ভ্রুকুটিতে বিবেক দেবনাথের ভিতরের অবস্থা তেমনি। পথ চলতে চলতে ভাবনার গভীরতায় নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলেন না। বাড়ির ভিতর ঢুকে বারান্দার উপরে ধপাস করে বসে পড়লেন।
নমিতা এতক্ষণ বারান্দার উপরে বসে সাতপাঁচ ভাবনায় ডুবে ছিল। ঘুমের ঝিমুনি সারা শরীর জুড়ে। অন্যদিন ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস। সারা দিন খাটাখাটুনির পরে সন্ধে হলে নমিতার শরীর আর টানে না। সেদিন স্বামীর টানে তাকে বারান্দায় বসে থাকতে হয়েছিল। বিবেক দেবনাথ সংসারের নানা কাজ সারার জন্যে কোনোদিন বাইরের লোক রাখতে চান নি। মাঝে মাঝে নমিতাকে শুনিয়ে বলতেন, বসে থেকে এভাবে গতর নষ্ট করে লাভ কী বলতো? হাতে গোনা মাত্র কটা কাজ, তার জন্যে বাইরের লোক রাখতে হবে কেন? কাজের ইচ্ছায় একবার মরিচা পড়লে তা থেকে বের হয়ে আসা ভীষণ কঠিন ব্যাপার। আমি চাই না, তোমার শরীরে এত বড়ো ক্ষতি হয়ে যাক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct