“পরিবেশই সবকিছুর উর্দ্ধে, আমি না”-এলবার্ট আইনস্টাইন
“ধরীত্রি আমাদের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট দিয়েছে, কিন্তু সবার লোভ একই নয়”-মহাত্মা গান্ধী
“ঈশ্বর গাছগুলিকে খরা, বন্যা, তুষারপাত, পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে, কিন্তু এই বোকা মানুষের থেকে পারে না”-জন ম্যুর
________________________________________________________________________________
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর
ফৈয়াজ আহমেদ: আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন পরিবেশ-প্রকৃতি। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ পরিবেশকে আমরা নানাভাবে দূষিত করে আসছি। বিশ্বজুড়ে এখন পরিবেশদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। পরিবেশদূষণের উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে রয়েছে অত্যাধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, দ্রুত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অ্যাসিড বৃষ্টি, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী, প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে গিয়ে মানুষই পরিবেশের ক্ষতি করছে। বেড়েই চলেছে গ্রিন হাউজ গ্যাস নি:সরণ। বাড়ছে তাপমাত্রা, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্য, ভূমিধ্বসের মতো প্রাকৃতি দুর্যোগ হানা দিচ্ছে বার বার। এর ফলেই ধ্বংস হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ চক্র বজায় রাখতে জীবজগতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটি প্রজাতি ধংস হলে মানুষের জন্য তা হুমকি।
প্রতি বছর ৫ই জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয় পরিবেশ দিবস। মানুষ আর পরিবেশের দূরত্ব ঘুচিয়ে এক সবুজ নির্মল পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে দিবসটিকে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
ফিরে দেখা:
১৯৬৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন জাতিসংঘের কাছে মানব পরিবেশ সম্পর্কিত একটি সম্মেলন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব দেন অধিবেশনে উপস্থিত সুইডিশ প্রতিনিধিরা। প্রস্তাবনায় বলা হয়,
“সমন্বয় সাধনের সুবিধার্থে এবং মানব পরিবেশ সম্পর্কিত অত্যন্ত জটিল সমস্যাগুলোর বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর আগ্রহের দিকে মনোনিবেশ করার জন্য এমন সম্মেলন আয়োজন জরুরী।”
সে প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫-১৬ জুন অনুষ্ঠিত হয় মানব পরিবেশ সম্পর্কিত জাতিসংঘের প্রথম সম্মেলন, যেটি ‘স্টকহোম সম্মেলন’ নামেও বেশ পরিচিত।
আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্পর্কিত সমস্যা ও সমাধান কিংবা ভবিষ্যত ভাবনাগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের প্রথম এই বৃহত্তম সম্মেলনকে দেখা হয় পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিকাশের একটি মাইলফলক হিসেবে। স্টকহোম সম্মেলন পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার কীভাবে একসাথে কাজ করতে পারে, সে সম্পর্কে ধারণা তৈরি করেছিল। এ সম্মেলন থেকে পাওয়া ধারণা এবং পরিকল্পনাগুলো বিগত বছরগুলোর প্রতিটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং পরিবেশ বিষয়ক চুক্তিতে প্রতিফলন রেখেছে।
এ সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো পরিবেশ দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক সুপারিশ আসে৷ এ লক্ষ্যে ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে মনোনীত করার সুপারিশ করা হয় সাধারণ সম্মেলনে। একইসঙ্গে পরিবেশ ব্যবস্হাপনায় আলাদা একটি সংস্থা গঠনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয় সম্মেলনে, যেটি পরে ‘ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম’ (UNEP) নামে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ পরিবেশ বিষয়ক বিশেষায়িত এই সংস্থাটিই বর্তমানে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজনগুলোর মূল সমন্বয়ক। সংস্থাটির সদর দপ্তর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে৷
১৯৭৪ সালে প্রথম উদযাপনের সময় থেকেই প্রতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের জন্য নির্দিষ্ট একটি থিম বা বিষয় নির্ধারণ করে দেয় জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, সমসাময়িক পরিবেশগত উদ্বেগের বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই থিম নির্বাচনের ভাবনাটি এসেছে। একইসাথে প্রতি বছর যেকোনো একটি শহর বা দেশকে দিবসটির মূল আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শহর বা দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থিমের ব্যাপারটি জড়িত। সাধারণত সংশ্লিষ্ট থিমে যে শহর বা দেশ সাফল্য পেয়েছে এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারটিতে আয়োজক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সে শহর বা দেশকেই নির্বাচন করা হয়।
এই বছর(২০২১) এর আয়োজক আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান। এবারের থিম “বাস্তুতন্ত্র পুনরোদ্ধার”।
বিপদ:
ভয়াবহ পরিবেশদূষণের কবলে পড়ে আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। অপেক্ষা করছে এক মহাধ্বংস! আজ জলে বিষ। বাতাসে আতঙ্ক। মাটিতে মহাত্রাস। গত ৬০ বছরে ৮০টির বেশি প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কয়েক শ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত।
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। এ পরিণামে বাতাসে প্রতিবছর ২২ কোটি টন কার্বন মনোক্সাইড সঞ্চিত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের আনুপাতিক হার ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে বৃষ্টির জলে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। এই অ্যাসিড বর্ষণ অরণ্যে মহামারির সৃষ্টি করছে। খাদ্যশস্যকে বিষাক্ত করছে। দ্রুতগতিতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবুজ অরণ্য। সারা বিশ্বে বর্তমান ৮০ শতাংশ হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্য। এর মধ্যে প্রতি মিনিটে ২১ হেক্টর কৃষিযোগ্য জমি বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর ৭৫ লাখ হেক্টর জমি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে।
প্রতি মিনিটে ৫০ হেক্টর উর্বর জমি বালুকাকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বাতাসে বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন কমছে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারে ভূপ্রকৃতির ওপর অত্যাচার বাড়ছেই। শস্য রক্ষার জন্য নানা ধরনের কীটনাশক ওষুধ তৈরি ও প্রয়োগ হচ্ছে। এসব বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যের অনুপ্রবেশ ঘটছে মানুষের শরীরে। ফলে নানা জটিল ও কঠিন রোগের দানা বাঁধছে আমাদের শরীরে।
পরিবেশদূষণের জন্য পৃথিবীতে ৮০ শতাংশ নিত্যনতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশদূষণের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে জলে পরিণত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের আয়তন ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ফলে সূর্যের মারাত্মক অতিবেগুনি রশ্মি প্রাণিজগৎকে স্পর্শ করবে। দূষণের ফলে উদ্ভিদ ও জীবজগৎ আজ বিপন্ন। সমুদ্রে-নদীতে-জলাশয়ে মাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে। মাছের শরীরে নানা রোগ দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাপি উদ্যোগ:
বর্তমানে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই একটু একটু করে পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সময় যত এগোচ্ছে ততোই বাড়ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের গুরুত্ব, উদ্যম এবং প্রয়োজনীয়তাও। প্রত্যেক বছর উত্তর গোলার্ধে বসন্ত ঋতুতে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দিনটি শরৎ ঋতুতে মহা ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। বিশ্বজুড়ে এই দিন বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হয়। জাতীয়, আন্তর্জাতিক তথা তৃণমূল স্তর থেকে পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে গৃহীত হয় এই সকল কর্মসূচি।
এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পরিচ্ছন্নতার প্রসার, দূষণ রোধ এবং বৃক্ষরোপণ। আন্তর্জাতিক স্তরে অন্তর্দেশীয় লাভজনক তথা অলাভজনক বিভিন্ন সংস্থা এমনকি নানা অন্তর্দেশীয় কোম্পানিও এই দিনটিতে বিশ্বব্যাপী বনসৃজন, বন সংরক্ষণ, সাগর মহাসাগর পরিষ্কার করা, সকল প্রকার দূষণ রোধের মতন নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।
যেমন ২০১৮ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবসটি পৃথিবীজুড়ে প্লাস্টিকের ব্যাপক দূষণ রোধের আহবানে ‘বিট প্লাস্টিক পলিউশন’ শিরোনামে পালিত হয়েছিল। তাছাড়া বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশের সরকারের তরফে গৃহীত হয় পরিবেশ সচেতনতা মূলক নানা কর্মসূচি। এই সকল কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে পৃথিবীর স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারাও। তাছাড়া সমাজের সকল স্তরে এই দিনে পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বর্তমানকালে বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পরিবেশেকে রক্ষা এবং সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশের পুনঃস্থাপনের উদ্দেশ্যে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের গুরুত্ব অসীম। সময়ের সাথে সাথে এই অসীমতা বাড়ছে বৈ কমছে না। তবে পরিবেশের রক্ষার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে একটি দিনকে পালন করাই যথেষ্ট নয়।
এক নজরে: ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ আয়োজনকারী দেশ ও থিম
১৯৭৪- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: একটি পৃথিবী
১৯৭৫- বাংলাদেশ: মানব বসতি
১৯৭৬- কানাডা: জল
১৯৭৭- বাংলাদেশ: ভূমির ক্ষতি অবক্ষয়
১৯৭৮- বাংলাদেশ: ধংস্ববিনা উন্নয়ন
১৯৭৯- বাংলাদেশ: শিশুর ভবিষ্যৎ
১৯৮০- বাংলাদেশ: ধংস্ববিনা উন্নয়ন
১৯৮১- বাংলাদেশ: ভূগর্ভস্থ জল
১৯৮২বাংলাদেশ:পরিবেশে পুনর্নবীকরণ
১৯৮৩- বাংলাদেশ: বিপজ্জনক বর্জ্য
১৯৮৪- বাংলাদেশ: মরুভূমি
১৯৮৫- পাকিস্তান: যুবক জনসংখ্যা
১৯৮৬- কানাডা: শান্তির জন্য বৃক্ষ
১৯৮৭- কেনিয়া: পরিবেশ এবং আশ্রয়
১৯৮৮- থাইল্যান্ড: পরিবেশ ও উন্নয়ন
১৯৮৯- বেলজিয়াম: বিশ্ব উষ্ণায়ন
১৯৯০- মেক্সিকো: শিশু এবং পরিবেশ
১৯৯১- সুইডেন: জলবায়ু পরিবর্তন
১৯৯২- ব্রাজিল: একটাই পৃথিবী
১৯৯৩- চীন: দারিদ্র্য এবং পরিবেশ
১৯৯৪- যুক্তরাজ্য: পৃথিবী এক পরিবার
১৯৯৫- দক্ষিণ আফ্রিকা: পরিবেশ জোট
১৯৯৬- তুরস্ক: পৃথিবী আমাদের ঘর
১৯৯৭- কোরিয়া: পৃথিবীর জন্য জীবন
১৯৯৮- রাশিয়া: সমুদ্রকে বাঁচান
১৯৯৯- জাপান: পৃথিবীই ভবিষ্যত
২০০০- অস্ট্রেলিয়া: পরিবেশ সহস্রাব্দ
২০০১- ইতালি ও কিউবা: ডব্লুডব্লুডব্লু
২০০২- চীন: পৃথিবীকে সুযোগ দিন
২০০৩- লেবানন: জল
২০০৪- স্পেন: সমুদ্র জীবিত না মৃত
২০০৫- আমেরিকা: সবুজ শহর
২০০৬- আলজেরিয়া: মরুভূমি
২০০৭- ইংল্যান্ড: বরফ গলা বিষয়
২০০৮নিউজিল্যান্ড:কার্বনহীন অর্থনীতি
২০০৯- মেক্সিকো: জলবায়ু পরিবর্তন
২০১০- বাংলাদেশ: এক পৃথিবী ভবিষ্যৎ
২০১১- ভারত: বন
২০১২- ব্রাজিল: সবুজ অর্থনীতি
২০১৩- মঙ্গোলিয়া: খাদ্য সঞ্চয়
২০১৪- বার্বাডোস: সমুদ্রপৃষ্ট বৃদ্ধি
২০১৫- ইতালি: সাত বিলিয়ন স্বপ্ন
২০১৬- অ্যাঙ্গোলা: অবৈধ বন্যজীবন
২০১৭-কানাডা: পরিবেশের সঙ্গে মানুষ
২০১৮- ভারত: প্লাস্টিক দূষণ
২০১৯- চীন: বায়ু দূষণ
২০২০- কলম্বিয়া: প্রকৃতির জন্য সময়
২০২১- পাকিস্তান: বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct