আজিজ রসুলঃ আমরা যদি আমাদের চারপাশের মানুষজনদের একটু খুঁটিয়ে দেখি , তবে দেখা যাবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু গুণ রয়েছে । তবে ইংরেজিতে যাকে genius এবং বাংলায় প্রতিভা বলি তা কিন্তু সকলের মধ্যে থাকে না। প্রতিভা এমন একটি যোগ্যতা যা জন্ম থেকেই স্বভাব-প্রকৃতিতে বিদ্যমান থাকে। এ এমন এক গুণ যা প্রতিটি মানুষকে আরেকজনের থেকে আলাদা করে তোলে। এই প্রতিভা যার থাকে তাকে ভিড়ের থেকে আলাদা করে চিনতে শেখায়। সাহিত্যজগতে আমরা এরকম বেশ কিছু প্রতিভাবানদের দেখা পেয়েছি- শেকসপীয়ার, গেটে, কীটস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরো অনেকে। প্রতিভাবানদের জগত ভিন্ন- যেখানে স্বাভাবিক ভাবনার চাইতে ব্যতিক্রমী ভাবনা থাকে এবং গতানুগতিক ভাবনার বাহিরের ভাবনা থাকে। প্রতিভার মূলে অলৌকিকত্ব, আবেগ, ইচ্ছা ও প্রেরণা যাই থাকুক না কেন সাধনা ছাড়া কিন্তু প্রতিভার বিন্দুমাত্র দাম নেই। প্রতিভা মানুষের ভেতর ঘুমিয়ে থাকে এবং এটাকে অসাধারণ ধৈর্য ও নিরন্তন সাধনার মাধ্যমেই বের করে আনতে হয়। একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি খুবই সৃজনশীলতার অধিকারী হন এবং এমন এমন অসম্ভব ধরনের কাজ করতে পারেন যা কেউ, কখনো কল্পনাও করতে পারেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রতিভা অনেক সময় নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক বিরল প্রতিভার অধিকারী । প্রতিভার ছোঁয়াচ লেগে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে জ্বলে উঠেছিলেন, কিন্তু তারপর দ্রুত নিভে গিয়েছিলেন। একটি উল্কার মত বাংলার সাহিত্যের আকাশে দেখা দিয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্যিক কাল বলতে গেলে কুড়ি - বাইশ বছরের বেশি নয়। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যজীবন শুরু হয় পালাগান রচনার মধ্য দিয়ে । যেমন – ‘শকুনি বধ’ , ‘মেঘনাদ বধ’ , ‘চাষার সং’ , ‘রাজদূত’ , ‘দাতাকর্ণ’ ইত্যাদি ।
১৯২২ সালেই নজরুলের উল্লেখযোগ্য প্রথম কবিতাগ্রন্থ “অগ্নিবীণা” প্রকাশিত হয়। এভাবেই নজরুল তার সাহিত্য জীবনের মোট বিশ- বাইশ বছর লেখালেখির সাথে যুক্ত থেকে কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গান, হাম, নাত, গজল, শ্যামাসঙ্গীত, পদাবলী, কীর্তন, সম্পাদনা ও চিঠিপত্র সাহিত্য সমূহ রচনা করে গেছেন।
কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর সময়ের গুণীজনেরা ‘যুগের কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে আমরা জানি, নজরুল সেই কবি যিনি তাঁর যুগের দাবিই শুধু পূরণ করেন নি চিরকালের মানুষের জন্যও তিনি রেখে গেছেন তাঁর শাশ্বত বাণী। তাই তিনি কালের কবি এবং একই সঙ্গে কালোত্তীর্ণ। তিনি মানুষটা ছিলেন অসাধারণ, কিন্তু একটা বেহিসেবী উড়নচণ্ডী প্রতিভা তাঁর মধ্যে সবসময় জাগরূক ছিল। যে কেউ তাঁর সাহিত্য সাধনা নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে আলোচনা করলে এই বেহিসেবী উড়নচণ্ডী প্রতিভার লক্ষণগুলির মুখোমুখি হবে। প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মে এবং একইসঙ্গে ব্যক্তিত্বে রেখে গেছেন। কবি নজরুল ইসলাম সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন হল - ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ তাঁর মানবতার পরিচয় ফুটে উঠেছে কুলি মজুর কবিতায়:
“দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?”
সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে আকস্মিকভাবেই ধূমকেতুর মতোই বাংলার সাহিত্যাকাশে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। ‘অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ’ যতক্ষণ না স্তব্ধ হবে ততক্ষণ পর্যন্ত শান্ত না হওয়ার ঘোষণা করেন তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে জবানবন্দী দেন তাতে তিনি বলেছিলেন :“আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে।”
নজরুল কিন্তু অচিরেই বুঝতে পেরেছিলেন যে কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদই ভারত উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাধা নয় । শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার রাস্তায় বড় বাধা সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ। তিনি দেখেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের শেকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের শেকড়কে সমূলে উৎপাটিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। সেখানেও তাঁকে প্রচুর বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং সেসব কথা তিনি তাঁর ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। এক দুর্জয় সাহসের ওপর ভর করে তিনি হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে আক্রমণ করেছিলেন। এই কবিতায় তিরস্কার করার জন্য যে সমস্ত পরুষবাক্য ব্যবহার করেছিলেন তা যে সঠিক ছিল দুই ধর্মের লোকেরা বুঝতে পারেন। তাঁর মধ্যে ছিল মানুষের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। তাই মানুষের বেদনা, যাতনা, পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেছেন:
“ আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,.....
মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।..”
সাম্প্রদায়িক বিভেদমুক্ত সম্প্রীতির জন্য লাগাতার সংগ্রাম করে গেছেন নজরুল । অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকেই তিনি সম্প্রদায়গত বিভেদ-বিভাজনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। মনে প্রাণে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। সাম্প্রদায়িক হানাহানিকারীদের নজরুল বলেছেন ‘ধর্ম-মাতাল’। তাঁর ভাষায়, ‘ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের এলকোহল পান করিয়াছে।’ মাত্রার বেশি অ্যালকোহল বা মদ পান করলে যেমন মাতালের পরিণতি অবধারিত মৃত্যু, তেমনি ধর্ম নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে সেই সব ‘ধর্ম-মাতাল’-এরও করুণ পরিণতির কথা বলেছেন নজরুল।
সুতরাং , সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার মতো সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতাও হয় নজরুলের প্রধান কাজ। হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু বিস্তারিত জানা না গেলেও তার সারমর্ম জানিয়েছেন নজরুল তাঁর এক লেখায়। তাঁর ভাষায়:একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে।
গুরুদেব বললেন: দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে? হিন্দু-মুসলমানের কথা মনে উঠলে আমার বারে বারে গুরুদেবের ঐ কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে যে, এ ন্যাজ গজালো কি করে? এর আদি উদ্ভব কোথায়? ঐ সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায়—তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক—তারাই হয়ে ওঠে পশু।( প্রবন্ধ,হিন্দু- মুসলমান)
নজরুলের ভাষায়, ‘অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি—আলোর মত, সকলের জন্য।’ (প্রবন্ধ,হিন্দু- মুসলমান) নজরুলের দর্শনই হল অসাম্প্রদায়িকতা এবং মানবতার। যেখানে সবার উপরে মানুষ সত্য। ধর্ম-বর্ণ, ধনী- দরিদ্র , ভৌগলিক সীমানা দ্বারা তিনি আবদ্ধ থাকতে চান নি। আর তা যে তিনি চাননি ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে জীবনের শেষ ভাষণ থেকেই তা খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নজরুল সেই ভাষণে খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, “ আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কুলষিত-পুরাতন-পচা সেই সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দু’টোর কোনটাই নয়। আমি কেবল হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি”। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাই তাঁর ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে। তাঁর সেই ধারণা আজকের দিনে এবং বর্তমান করোনা আবহে সমানভাবে প্রযোজ্য। তিনি লিখেছেন, “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।“ ধর্মের ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বিবাদের প্রসঙ্গে নজরুল বলেছিলেন, ‘আলো নিয়ে কখনও ঝগড়া করে না মানুষে, কিন্তু গরু-ছাগল নিয়ে করে।’ কিন্তু নজরুল জানতেন যে দেশের নেতারা যদি পরিস্থিতির পরিবর্তন না চান তাহলে সাম্প্রদায়িক বিভেদজনিত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। জগতের পরিবর্তন দেশের নেতারাই আনতে পারেন। তাই তিনি লিখলেন,
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?
ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ,
সন্তান মোর মা’র!”
বিভিন্ন কবিতা ও গদ্য রচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি নজরুল-ভাবনার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল হিন্দু-মুসলমান বিরোধ ও তার প্রতিকার। ভারত উপমহাদেশে উপনিবেশকে ধরে রাখার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ খুব কৌশল করে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল এবং দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় পরস্পর বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে বার বার। রাজনৈতিক প্রয়োজনে অর্থাৎ উপনিবেশবাদের দূরীকরণের জন্য দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করা যে কত হাস্যকর আর অর্থহীন সে কথা নজরুল বুঝেছিলেন। ‘ভাই বলিয়া গলা জড়াইয়া’ ধরলেই সত্যিকার বন্ধন সৃষ্টি হয় না।
নজরুল হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য-চিন্তা-চেতনার ভাব বিনিময়ের ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম এডুকেশন (মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা, রুদ্র-মঙ্গল) সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেছেন: ‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা।’ তাঁর লেখা “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান।/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ ||” গান আর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ দিককে তুলে ধরে। হিন্দু - মুসলিম এই দুই ধর্মকে ঘিরে যেভাবে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ আর বিদ্বেষ, সেই পটভূমিকে কেন্দ্র করে এই লেখাটি লিখেছিলেন।
বাঙালি জাতির ঐক্য সংস্কৃতির সেতু রচনায় ।
অসাম্প্রদায়িক বাঙালি ঐক্য সংস্কৃতির সেতু রচনার কাজে হাত দিয়েছিলেন নজরুল । নজরুলের সময়ে তাঁকে নিয়ে বাঙালির কোনো কোনো অংশ তাঁর আত্মপরিচয় নিয়ে সংশয়ে ছিল - তিনি কার , হিন্দুর না মুসলিমের ? এক শ্রেণির মুসলমান নেতারা আশা করতেন তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে বেশি করে লিখবেন। কিন্তু নজরুল খুব ভালো করেই জানতেন যে ধর্ম নিয়ে কবিতা চর্চা করলে শিল্প থাকে না, তাই তিনি সেদিকে যাননি। এরকম নানা সংকট ও প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয়েছে নজরুলকে। আত্মপরিচয় দিতে দিতে ক্লান্ত হতে হয়েছে তাঁকে। এর উত্তর বিভিন্ন কবিতার মাধ্যমে বিভিন্নভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যদিও অধিকাংশ বাঙালি নজরুল কোন ধর্মের সদস্য, তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আচার্য প্রফুল্ল রায়ের সভাপতিত্বে তিনি বলেছিলেন, “আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্ম গ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।’ আর সভাপতি বলেছিলেন, ‘নজরুল কবি, প্রতিভাবান মৌলিক কবি। আজ এই ভেবে বিপুল আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি বাঙ্গালির কবি।’ ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে কোনো দিনই তিনি প্রশ্রয় দেন নি। মনেপ্রাণে কবি ছিলেন বলেই বিভেদমূলক কোন চিন্তা কোন সময়েই তাঁর মনে স্থান পায় নি। যদিও কবিতায় ও গানে হিন্দু মুসলিম ধর্মে প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু মননে মগজে তিনি ছিলেন পুরোমাত্রায় অসম্প্রদায়িক।
এতক্ষণ আমরা নজরুলের মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা ছাড়াও আরো একটা বিষয় নিয়ে নজরুল জোর কলম চালিয়েছিলেন। সেই বিষয়টি হল নারীমুক্তি। নারীকে পুরুষের সমান অধিকার প্রদানের পক্ষে কলম ধরেছিলেন তিনি।
তিনি দেখেছিলেন যে সমাজের অর্ধেক মানুষ নারী। তিনি বুঝেছিলেন সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ নারীকে সমাজের সকল স্তরে তাকে পদে পদে বাধা পেতে হয়েছে। তিনি আরো দেখেছিলেন যে বাংলার সামাজিক জীবনে নারীরা যেমন উপেক্ষিত ছিল, সাহিত্যেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তিনি আরো বুঝেছিলেন যে নারীকে বন্দী করে রেখে সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। এইটা খুব ভেবে দেখার বিষয় যে নারীমুক্তি প্রশ্নে সেই সময়ে নজরুলের চেয়ে বেশি আর কেউ কঠোর অবস্থান নেননি। সেই সময়ে মুসলমান নারীর অবস্থান ছিলো আরো শোচনীয়। সাহিত্য সাধনা শুরুর সাথে সাথেই সমাজে নারীর প্রতিষ্ঠা ও যথোচিত মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নজরুল যেমন বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা করেন, তেমনই গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও নাটকেও নারীদের চিত্রিত করেন । পুরুষই সর্বেসর্বা। কিন্তু পুরুষদের সর্বেসর্বা মনোভাবকে দলিত করে নজরুল তাঁর কবিতায় দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সাম্যের বাণী— ‘সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। ‘ (নারী, সাম্যবাদী)। নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ‘নারী’ কবিতাটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। নজরুল তাঁর কবিতায় চেয়েছিলেন নারীরা জেগে উঠুক। ভাঙুক তাদের কয়েকশ’ বছরের দীর্ঘ ঘুম। সেজন্য কবিতাটি রক্ষণশীল পুরুষেরা খুব সহজভাবে নেয়নি।
নজরুল বুঝেছিলেন যে নারীদের সমান অধিকার পেতে হলে নারীদের অধিকার সম্পর্কে তাদেরই আগে সচেতন হতে হবে এবং তাদেরকেই বেশি বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে কবির যা মনে হয়েছিল তা হল সমাজে অবরোধের কারণে নারীরা সময়ের সাথে তাল মেলাতে পারেনি। নারীকে পুরুষের সমান অধিকার ও মূল্যায়ন করার বিষয়টি উঠে এসেছে তাঁর’ নারী’ কবিতায় এবং কবি তাঁর সময়কে ‘বেদনার যুগ’ বলেছেন। কবির প্রত্যাশা ছিল পুরুষের অবদান যেমন সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃতি পায়, তেমনি নারীর প্রতিটি কাজকেও মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের দুঃখ-বেদনাকেও পুরুষ সমভাবে অনুভব করবে। নারীর অবদান যে পুরুষের চেয়ে কম নয়, এই বোধের প্রতি কবি অনেক বেশি সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল বলে উদ্দীপকের চেয়ে ‘নারী’ কবিতার বক্তব্য আরো বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। কবি ‘নারী’ কবিতায় নারীদের দাসত্ব, ভীতি ঘোচাতে আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে— ‘আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা/ আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!/ চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায়ে মল,/ মাথায় ঘোমটা, ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল!/ যে-ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ!/ দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যতো আবরণ।’ নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন যে নারীর অশিক্ষার কারণ পুরুষের অবরোধ। সেই সময়ের মুসলিম নারীদের বেদনা ও বিড়ম্বনা নজরুল খুব ভালোই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই, নজরুল নারী শিক্ষার গুরুত্ব যর্থাথভাবে বুঝতে পেরে লিখেছেন- ‘‘কন্যাকে পুত্রের মতই শিক্ষা দেওয়া যে আমাদের ধর্মের আদেশ তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা জায়া জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চিরবন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের শত শত বর্ষের এই অত্যাচারে ইহাদের দেহ মন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই র্সবপ্রথমে বাহিরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কীসে দুঃখ কীসের যে অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে।” (তরুনের সাধনা)
নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় নজরুল তিনি অবিচল থেকেছেন । নরনারীকে সমান সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই নজরুলের ‘বারাঙ্গনা‘, ‘নারী’ প্রভৃতি কবিতার জন্ম। ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় পতিতাবৃত্তিকে সতীকর্ম না বললেও পতিতার ভাল হবার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়াকে নজরুল সমর্থন করেননি। ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটিতে তিনি পতিতা নারীর মাতৃত্বকেই মা বলে সম্বোধন করেছেন। কবিতার শুরুতেই বলেছেন, “কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও- গায়ে?/হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।/না’ই হলে সতী তবু ত তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি’/তোমাদের ছেলে আমাদেরই মত, তারা আমাদের জ্ঞাতি।” তিনি এই কবিতায় দাবি তুলেছেন, “অসৎ মাতার সন্তান যদি জারজ হয়, তবে যারা অসৎ পিতা, তাদের সন্তানও জারজ হবে। অনৈতিকতার শাস্তি কেবল নারীরা পাবে, পুরুষরা তার ধারও ধারবে না— নজরুল ছিলেন তার ঘোর বিরোধী। তাই কবি ঘোষণা করেছেন— ‘শুন ধর্মের চাঁই/ জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো প্রবেধ নাই!/ অসত্য মাতার পুত্র যদি জারজ পুত্র হয়,/ অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।’ নারীদের সমান অধিকারের কথা নজরুল তাঁর কবিতায় তুলেছিলেন বলে সেই সময়ে পুরুষরা তাঁকে ভাবতো নারীবাদী, নারীঘেঁষা কবি হিসেবে। সেকথা নজরুল নিজেই তার কবিতায় বলেছেন— ‘নর-ভাবে আমি বড় নারী ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী!’ (আমার কৈফিয়ত)
বর্তমানে নারীদের সমানাধিকার ও নারী ক্ষমতায়নের জন্য বেশ জোরেশোরেই সভা, সেমিনার, লেখালেখি চলছে। কিন্তু নজরুল আরো কয়েক দশক আগেই নারীদের সমানাধিকারের কথা বলে গেছেন এবং এখানেই তাঁর চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মহত্ব। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘সাম্য’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মনুষ্যে মনুষ্যে সমানাধিকার বিশিষ্ট, স্ত্রীগণও মনুষ্য জাতি, অতএব স্ত্রীগণও পুরুষের তুল্য অধিকারশালী, যে যে কার্যে পুরুষের অধিকার আছে, স্ত্রীগণেরও সেই সেই কার্যে অধিকার থাকা ন্যায় সঙ্গত।’ সাহিত্য সম্রাট যেমন তাঁর প্রবন্ধে নারীদের সমান অধিকারের কথা তুলেছেন তেমনি করে
আমরা দেখতে পাই অগ্নিবীণার ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো নজরুল তাঁর নারীবিষয়ক কবিতায়ও সেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। মৌলবাদী সমাজে নজরুল নারীদের অধিকারের পক্ষে দ্বিধাহীন, শঙ্কামুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিতে পেরেছেন। নজরুল যে কেবল নারীদের সমানাধিকারের কথা বলেছিলেন তাই নয়, নারীদের বিভিন্ন রূপকে খুব সচেতনভাবে তাঁর কবিতায় স্থান দিয়েছেন। মাতৃরূপী নারীর মমতাময়ী স্নেহ, প্রেমময়ী নারীর প্রেমমূর্তি, নারীর বধূরূপ, কন্যারূপ, নারীর অসহায়ত্ব, গ্লানি, বঞ্চনা, নারীর উল্লাস, আনন্দ সবকিছুই তিনি তাঁর কবিতায় একে একে তুলে ধরেছেন। আবার কখনও বা ইতিহাস খুঁড়ে ঐতিহাসিক নারী চরিত্রদের তাঁর কবিতায় স্থান দিয়েছেন। ‘নওরোজ’ কবিতায় ইতিহাসখ্যাত প্রেয়সী নারীদের জীবন তুলে ধরেছেন এভাবে : “শিরী লায়লিরে খোঁজ ফরহাদ খোঁজে কায়েস/নওরোজের এই সে দেশ!/ঢুড়েঁ ফেরে হেথা যুবা সেলিম/নূরজাহানের দূর সাকিম,/....দোকান বসেছে মোমতাজের/ সওদা করিতে এসেছে ফের/শাজাহান হেথা রূপ-পাগল।/হেরিতেছে কবি সুদূরের ছবি/ভবিষ্যতের তাজমহল–/নওরোজের স্বপ্ন-ফল!” গ্রামের সহজ-সরল মেয়েদের জীবনের ছবিও আঁকা হয়েছে নজরুলের কবিতায় ।‘বসিয়া বিজনে একা মনে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, বেলা গেল বধু ডাকে ননদী/ চ’লো জল নিতে যাবি লো যদি/কালো হয়ে আসে সুদূর নদী/নাগরিকা-সাজে সাজে নগরী ।। “
মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মনুষ্যত্বের জয়গানে যেমন আহবান করেছেন তেমনি নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করেছেন। আবার নারীদের সমানাধিকার, নারীর প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ করে নারীর অবস্থানকে সমাজের উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন তেমনি তাঁর নারীরা হয়ে উঠেছে মুক্ত জীবনসন্ধানী। বিংশ শতাব্দীর স্বনামধন্য বাঙালি চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, এবং সাহিত্য সমালোচক শিবনারায়ণ রায় নজরুল সম্পর্কে বলেছেন,”এক হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে তাঁর মত অসাম্প্রদায়িক কবি আর দেখা যায়নি। তাঁর পরিচয় ছিল মানুষ হিসাবে’।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct