ফৈয়াজ আহমেদ: কত বিচিত্র শখই না থাকে মানুষের। তার মধ্যে বর্তমানে জনপ্রিয় একটি শখ হল ‘বার্ডিং’। প্রাণিকূলের সুন্দর সৃষ্টিগুলোর ভেতর অন্যতম হলো পাখি। পাখি দেখতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু পাখি তো বিলুপ্ত প্রায়। দেখা পাওয়া দুস্কর। কিন্তু এখনো অনেক পাখিই টিকে রয়েছে, যাদের নামও হয়তো আমরা জানি না। সেগুলোর দেখা পাওয়া কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। আর যদি দেখতে চান, তবে নেমে পড়তে হবে বার্ডিংয়ে! তবে বার্ডিং বলতে সবাই যেন চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে পাখি দেখাকেই শুধু ভেবে না বসেন। বার্ডিং এর চেয়েও অনেক বেশী কিছু, ওয়াইল্ড লাইভ প্রিজারভেশন, অচেনা ও বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের ডকুমেন্টেশনও এর সাথে জড়িত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বার্ডারদের থাকে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা এবং তারা পাখিদের বিলুপ্তি থেকে টিকের থাকার পথে সহযোগীর ন্যায়। বার্ডারদের কল্যাণেই আজ মানুষ পাখি সংরক্ষণে সচেতন হচ্ছে।
যারা এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত, তারাই হলো বার্ডার। তবে ‘Bird Watcher’ বলেও একটা টার্ম রয়েছে, যেটা বলতে বোঝায় শুধু মনোরঞ্জন বা অবসর কাটানোর জন্যে যারা পাখি দেখে। তবে এই শ্রেণীকরণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
বার্ডিংয়ের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় এর শুরুটা হয়েছিলো পাখির উপযোগীতার দিক থেকে, মূলত খাদ্য হিসেবেই। এছাড়াও ডিম সংগ্রহ ও পাখি শিকার করে সেটা নিদর্শনের বস্তু হিসেবে তৈরী হতো। এই প্রয়োজনীয়তার কারণে পাখি নিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানীরা বার্ডিং করতেন, অর্থাৎ এক্ষেত্রে বার্ডিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল পাখির প্রাপ্তিস্থান, শারীরবৃত্তীয় গঠন গবেষণা করা, যে তথ্য পরে শিকারে ব্যবহৃত হবে। পাখির কথা বলতে গেলে যাঁর নাম সবার আগে আসে তিনি সালিম আলি একজন বিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিদ এবং প্রকৃতিপ্রেমী। তিনিই প্রথম কয়েকজন ভারতীয়দের মধ্যে একজন যাঁরা ভারতের পাখিদের সম্বন্ধে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জরিপ পরিচালনা করেন। তার পাখিবিষয়ক বইগুলি পক্ষীবিজ্ঞানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
প্রয়োজনীয় রসদ:
আপনার যদি অবসরে প্রকৃতির মাঝে দু’দন্ড সময় কাটানোই উদ্দেশ্য হয়, তবে বেশি কিছু প্রয়োজন নেই। একটি বাইনোকুলার এবং পাখি চেনার একটি ফিল্ড গাইড হলেই যথেষ্ট। ব্যাকপ্যাকে কী কী নেবেন সেটা অবশ্য নির্ভর করবে আপনি কত দূরে এবং কতদিনের জন্য যাচ্ছেন তার উপর। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে নতুন নতুন পাখি দেখাও যে একটি অ্যাডভেঞ্চার সেটা বার্ডিংয়ে না নামলে বুঝবেন না! আর হ্যাঁ, একা না গিয়ে দল বেঁধে গেলে মজাটা জমবে আরো বেশী।
শুধু পাখি দেখেই মন ভরছে না? ছবি তোলা, পাখির ডাক রেকর্ড করতে চান? সেক্ষেত্রে কিছু উপকরণ নিয়ে নামতে হবে। ডিএসএলআর ক্যামেরা এবং সেই সাথে টেলিফটো লেন্স লাগবে। পাখির খুব নিকটে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় টেলিলেন্স ছাড়া ছবি তোলা মুশকিল। পাখির ডাক রেকর্ড করার জন্যে ডিজিটাল অডিও রেকর্ডার ব্যবহার করতে পারেন, কিংবা স্মার্টফোনের অডিও রেকর্ডারও ব্যবহার করা যায়। বিস্তারিত টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন জানার জন্য ফেসবুকে রয়েছে বার্ডারদের অনেক গ্রুপ। বার্ডারদের তোলা এসব ছবি ও অডিও পাখির জীবনাচরণ নিয়ে গবেষণা, পক্ষিবিদ্যা এবং পাখি সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত হতে পারে। সেদিক থেকে আপনি একজন বার্ডার হিসেবে পাখি সংরক্ষণেই অবদান রাখছেন।
শুরুতে কিছুটা তাত্ত্বিক ধারণা নিয়ে নামাও জরুরি। যেমন: কোন পাখি কোথায় কোন ধরনের জায়গায় পাওয়া যেতে পারে, কোন ঋতুতে কোন পাখি কোথায় থাকে, কোন পাখিগুলো বিলুপ্তির পথে, কোনগুলো অতিথি পাখি আর কোনগুলোই বা দেশি পাখি ইত্যাদি।
বার্ডারদের মধ্যে অনেকেই যে চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন তা হলো যেসব পাখিগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে সেগুলো খুঁজে বের করে ছবি তোলা। এই কাজের জন্যে প্রায় ঘাঘু গোয়েন্দার মতো লেগে থেকে এসব পাখি খুঁজে বের করতে হয়।
বার্ডিংয়ের নীতি-নৈতিকতা
বার্ডারের মূল উদ্দেশ্য হবে পাখি তথা জীববৈচিত্র সংরক্ষণ করা। ছবি তোলা, রেকর্ডিং ইত্যাদি করতে গিয়ে পাখির যাতে কোনো ক্ষতি বা অসুবিধা না হয় সেটার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। পাখিরা নিরিবিলি এবং মানুষ অধ্যুষিত নয় এমন জায়গায় থাকে। ছবি তুলতে গিয়ে যদি আপনি পাখির এলাকার ভেতর ঢুকে পড়েন, তবে পাখি ওখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। সেক্ষেত্রে আপনি পাখি সংরক্ষণের বদলে উল্টো ক্ষতির কারণ হলেন!
কোথাও কোনো দুষ্প্রাপ্য পাখির সন্ধান পেলে ঐ স্থানটিকে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে জনপ্রিয় করার আগে এটা ভেবে দেখুন এতে ঐ স্থানটি শৌখিন বার্ডারদের ভিড়ে জনবহুল হয়ে পড়বে কিনা। তেমনটা হলে উপকারের বদলে ক্ষতিই হবে। পাখিকে আকর্ষণ করতে কোনো ধরনের খাবার, ফাঁদ ইত্যাদি কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না।
পাখির সন্ধান করতে গিয়ে কোনো নিষিদ্ধ অঞ্চল, যেমন: সামরিক ঘাঁটি, সরকারি কোনো প্রবেশ নিষিদ্ধ জায়গা, কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ইত্যাদি জায়গায় যেন ঢুকে পড়া না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বার্ডিংয়ের জন্যে জনপ্রিয় কিছু জায়গা
যেকোনো গাছাগাছালি অধ্যুষিত জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাতেই বার্ডিং করা যায়। এসব জায়গাতেই পাখি বেশি থাকে। এছাড়া কেওলোদেও ঘানা ন্যাশনাল পার্ক-রাজস্থান, মঙ্গলজোদি-ওড়িশা, বিসমার বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য-উত্তরাখণ্ড, রঙ্গনাথিতু পাখি-কর্ণাটক, সুলতানপুর বার্ড আশ্রয়স্থল-হরিয়ানা, থেটিক্কাদ সলিম আলী বার্ড আশ্রয়স্থল-কেরালা, নামধাপ জাতীয় উদ্যান-অরুণাচল প্রদেশ ইত্যাদি যায়গা গুলি বিখ্যাত।
নাগরিক জীবন থেকে দু’দিনের ছুটি নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভাল সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে বার্ডিংয়ের মতো দারুণ আর কিছুই হতে পারে না। বন্য পরিবেশও যে আপনার চাপ কমাতে পারে, তা জঙ্গলে না গিয়ে বুঝবেনই না। সুতরাং তল্পিতল্পা গুছিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে নেমে পড়ুন বার্ডিংয়ে!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct