দিলীপ মজুমদার: গত মার্চমাসের প্রথম দিকে আমার বন্ধু অমর নস্কর আমাকে একটি বই দিয়ে গিয়েছিলেন। পড়ার জন্য। ‘করোনা কালের কিসসা’। বাংলা পরিষদ বইটি প্রকাশ করেছেন। পাঁচটি প্রবন্ধ আছে বইটিতে। সুশান রায়ের ‘করোনাকালের কিসসা’, ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘করোনা ষড়যন্ত্র’ ও ‘করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, সন্দীপন মিত্রের ‘এক পরাক্রমী দাতা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য’, ধীমান বসাকের ‘লকডাউন ও জরুরি অবস্থা’।
বইটি পরে পড়ব বলে রেখে দিয়েছিলাম। তারপরে আমার এক প্রিয়জনের অসুস্থতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এপ্রিলের ৩ তারিখ থেকে আমি আক্রান্ত হই করোনায়। প্রথম তিন-চার দিন কিছুই ভালো লাগছিল না। তারপরে একটু সুস্থ হয়ে শুরু করি ‘করোনাকালের কিসসা’। পাঁচটি প্রবন্ধের আলাদা আলাদা আলোচনা না করে আমি বইটির মূল বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
ইংরেজি শব্দ ‘প্যানডেমিক’এর অর্থ হল অতিমারি । বইটির লেখকরা একে প্যানডেমিক না বলে প্ল্যানডেমিক বা প্যানিকডেমিক বলতে চান। এই অতিমারির ক্ষেত্রে তাঁরা এক প্ল্যান বা সুপরিকল্পনা দেখতে পেয়েছেন। এ পরিকল্পনা সাম্রাজ্যবাদীদের। লেনিন বলেছিলেন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুদ্ধ অপরিহার্য। যুদ্ধ না হলে তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হয় না। তাই তারা সবসময় একটা শত্রু চায়। বাস্তবে না থাকলে কাল্পনিক শত্রু খাড়া করে।যেমন সন্ত্রাসবাদ তৈরি করে সারা পৃথিবীর সামনে সন্ত্রাসবাদকে শত্রু হিসেবে খাড়া করেছিল তারা। তেমনিভাবে তারা রোগকেও গণশত্রু হিসেবে হাজির করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে পৃথিবীর মানুষকে দেখাতে চায় তারা কীরকম মানবহিতৈষী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এরা তৈরি করেছিল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স, বিশ্বায়নের যুগে তৈরি করেছে মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। কী কাজ এইসব সংস্থার ? এরা বিভিন্ন বিভিন্ন সংক্রমক রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যেমন এখন করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
এই যুদ্ধকে নিছক মানবহিতৈষণা বলতে নারাজ অনেকে। জার্মানি, স্পেন, বেলজিয়াম, নাইজিরিয়ার বহু ডাক্তার ও অন্যান্য পেশার মানুষ আছেন প্রতিবাদী দলে। এই প্রসঙ্গে এসে পড়ে বিল গেটসের নাম। মাইক্রোসফটের কর্ণধার। তিনি কীভাবে চার-পাঁচ বছর আগেই করোনার কথা জানতে পেরেছিলেন, সেটা এক রহস্য। ২০১৫ সালে এক বক্তৃতায় বিল গেটস পৃথিবীর আগামী দিনের মহামারির কথা বলেছিলেন। ২০১৭ সালে দাভোসের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামে’র মঞ্চে তৈরি হয় ‘কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস’, যার অন্যতম সদস্য ছিলেন বিল গেটস ও মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বিল গেটস জানান, ‘এই সংস্থা তৈরির অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হল কোনও নতুন ভ্যাক্সিন তৈরির তৈরির সময়সীমা ( গবেষণা থেকে বাজারজাত করা অবধি) দশ বছর থেকে বারো মাসে নামিয়ে আনা। ২০১৯ সালে জনস হপকিন্স সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির বিষয় ছিল ‘একটি উচ্চ স্তরের করোনা ভাইরাস অতিমারির মতো অবস্থার অনুশীলন’।
করোনাভাইরাসের প্রথম কেস ধরা পড়ে চিনে, ১৯১৯ সালের ১লা ডিসেম্বর। কিন্তু বাজারে করোনা কিটস এসে পড়ে ২০১৭ সালেই। এ যেন রাম না জন্মাতেই রামায়ণ রচনা। ভাস্কর চক্রবর্তী তাই বলেছেন, ‘ ইয়োরোপের বহু ডাক্তার সংগঠন গড়ে এই অভিযোগ করেছিলেন কোভিড-১৯ এর টেস্ট কিট ২০১৭ সালে অর্থাৎ কোভিড-১৯ এর প্রথম কেস ধরা পড়ার আগে থেকেই পৃথিবীর দেশে দেশে রপ্তানি হতে শুরু হয়ে গেছে। তাহলে এমন সন্দেহ করা কী খুব অমূলক হবে যে এই টেস্ট কিটগুলো আগে থাকতেই বিশেষভাবে তৈরি করে রাখা হয়েছিল যাতে বেশি বেশি করে কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে ! মানে যাকে বলে pre programmed .’
এর পরে আসে প্রতিযেধক বা টিকার কথা। বিল গেটস প্রতিযেধক তৈরির সময়সীমা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে ১০ বছর থেকে ১২ মাসে নামিয়ে আনার কথা। কোভিড-১৯এর ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে। সেজন্য টিকার কার্যকারিতা সম্বন্ধে আজ এত প্রশ্ন। যে ভাইরাস ৬০০০ বার তার চরিত্র বদল করেছে, দেশে দেশে যার রূপ বিভিন্ন হচ্ছে, তাকে টিকা দিয়ে জব্দ করা সহজ নয়। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস , ‘ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন প্রতিবছর নতুন করে তৈরি করতে হয়। আগের বছরের ভ্যাক্সিন পরের বছরে কাজ করে না। এক-একটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাক্সিনের স্থায়িত্ব ৩-৬ মাস। প্রতি বছর নতুন নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয় এবং ভ্যাক্সিন বদলাতে হয়। আজ পর্যন্ত শ্বাসতন্ত্রের কোন আর এন এ ভাইরাসের কার্যকরী ও দীর্ঘস্থায়ী ভ্যাক্সিন তৈরি করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।’
এই টিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিরাট বাণিজ্য। শুধু টিকা কেন, তার সঙ্গে আছে সংক্রমণ প্রতিরোধের নানা ওষুধ। আজ যখন আমাদের দেশ করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে বেসামাল, তখন দেখা যাচ্ছে বাজারে অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই। সেখানে শুরু হয়েছে কালোবাজার। ভ্যাক্সিন তৈরি করে প্রতি বছর লাভের গুড় খেতে পারবে লগ্নিকারীরা।
করোনা সামলাতে অর্থনৈতিক লকডাউনের পেছনেও গূঢ় উদ্দেশ্য সন্ধান করেছেন এই বইএর লেখকরা। তাঁদের বক্তব্য এই মুহুর্তে পৃথিবীতে জমে উঠেছে পণ্যের পাহাড়। মার্কস যাকে বলেছিলেন ‘অতি উৎপাদনের মহামারি ’। পণ্য ক্রয় করার ক্রেতা নেই, কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই। তাই সাম্রাজ্যবাদীরা পণ্য উৎপাদন বন্ধ রাখার জন্য লকডাউনের পথ বেছে নেয়। লকডাউনে চরম অসুবিধে হয় সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের।
এরপরে আর একটি মারাত্মক অভিযোগ উথ্থাপন করা হয়েছে। সাংবাদিক পেপে এস্কোবার ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বলেছিলেন সাম্রাজ্যবাদীরা সারা বিশ্বে এক ডিজিটাল ফিনান্স পুঁজির জাল ছড়াচ্ছে, যার সঙ্গে থাকবে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ন্যনোচিপ ঢুকিয়ে মানুষের উপর ডিজিটাল নজরদারি। ভাস্কর চক্রবর্তীর মন্তব্য , ‘ভ্যাক্সিনে শুধু যে ন্যনোচিপ ঢুকিয়ে দিয়ে নজরদারির অভিযোগ উঠেছে তাই নয়, অভিযোগ উঠেছে যে মানুষের শরীরকে ( এবং তার মানেই তার মনন) নিয়ন্ত্রণ করার এক প্রকল্পের, মানুষের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড মানুষ তৈরি করার এক প্রকল্প।’
এই যে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯, তা প্রাকৃতিক না মনুয্যসৃষ্ট, সে প্রশ্নের সুষ্ঠু মীমাংসা হয় নি। বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। এই বইএর লেখকরা মনে করেন প্রকৃতিতে বিদ্যমান এই ভাইরাসকে মানবদেহে চালান করা আজকের জৈব প্রযুক্তির যুগে অসম্ভব কিছু নয়। গবেষণাগারে তৈরি করা হোক, অথবা প্রকৃতিতে বিদ্যমান ভাইরাসটিকে মানবদেহে চালান করা হোক, তার কর্তা কে ? এই বইতে প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদকেই কর্তা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চিন সম্পর্কে বিস্ময়করভাবে নীরব বইএর লেখকরা। অথচ চিন সম্পর্কে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। এই রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে অনেক পরে বিশ্ব স্বাস্থ্যকে খবর দিয়েছে চিনা প্রশাসন, প্রতিবাদী ডাঃ ওয়েন লিয়াংকে গুজব রচনাকারী আখ্যা দেয় পুলিশ ও পরে তাঁকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়, সমস্ত জেনোমিক্স কোম্পানিকে ভাইরাস সংক্রান্ত পরীক্ষা বন্ধ করতে ও তথ্য নষ্ট করে দিতে নির্দেশ দেয় হুবেই প্রসাসন, উহানের জিনিইয়াতান হাসপাতালে খবর সংগ্রহকারীদের বাধা দেয় পুলিশ ও বাজেয়াপ্ত করে ফোন ও ক্যামেরা, ইন্টারনেটে হাসপাতালের ছবি প্রকাশ করার জন্য আ্যটর্নি ও সাংবাদিক চেন কুইশিকে ভ্যানিশ করে দেওয়া হয়, সাউথ চায়না ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির বিজ্ঞানী ড. বোটাও জিয়াও ও উহান ইউনিভার্সিট অফ সায়েন্স ও টেকনোলজির বিজ্ঞানী ড. লি জিয়াও ভাইরাস বিষয়ক যে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তাকে সেন্সার করা হয়, মহামারির সংবাদ সংগ্রহের অপরাধে ওয়াল স্ট্রিটের ৩ সাংবাদিককে বহিষ্কার করা হয় , উহানে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিকে চিনা প্রশাসন অনুমোদন দেয় নি। অতি সাম্প্রতিককালে এক চিনা বিজ্ঞানী বলেছেন করোনাভাইরাসকে হাতিয়ার করে চিন ২০১৫ সাল থেকে জৈব যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাহলে সাম্রাজ্যবাদ যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ। রাজায় রাজায় এই যুদ্ধে প্রাণ যাচ্ছে উলুখাগড়াদেরই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct