আপনজন প্রতিবেদক, দেরাদুন: দেশের সাংবাদিকতা নিয়ে এখন জোর চর্চা। বিশেষ করে ফেক নিউজ বা ভুয়ো খবর নিয়ে এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে সোশ্যাল মিডিয়া হোয়াটসঅ্যাপও। ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে ভুয়ো খবরের জেরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে কিছু সংস্থা। একই সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক দলও মানুষকে তাদের ফাঁদে ফেলে দিচ্ছে এই ফেক নিউজ ব্যবহার করে। ফলে সমাজে এই ফেক নিউজের প্রভাবে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা অস্তিত্বের সস্মুখীন হয়ে উঠেছে। তা থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষের কাছে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে ও ফেক নিউজের বিপদ নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ-এর উদ্যোগে তিনদিন ধরে এক সাংবাদিকতার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হল উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুনে। দেরাদুনের ‘ফেয়ারফিল্ড বাই মারিয়ট’ হোটেলে সভাকক্ষে ইউনিসেফের এই কর্মশালার বিষয় ছিল ‘সমালোচনামূলক মূল্যায়ণ দক্ষতা: তথ্যপ্রমাণ ভিত্তিক স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা কর্মশালা।’ হায়দরাবাদের মৌলানা আজাদ উর্দু ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইউনিসেফের সঙ্গে যৌথ উদ্যোক্তা। এই কর্মশালায় দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রায় দেড়শোজন পেশাদার সাংবাদিক ছাড়াও বেসরকারি রেডিও চ্যানেলগুলির রেডিও জকিদের পাশাপাশি মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং হিমাচল প্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস কমিউনিকেশনের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। করোনা ভাইরাসের থেকেও যে বেশি ভয়ং্কর ফেক নিউজ সেই কথাই মূলত উঠে এসেছে এই কর্মশালায়। কিভাবে ফেক নিউজের মোকাবিলা করা যায় এবং ফেক নিউজের নানা প্রকার নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেন বিশিষ্টজনরা।
ইউনিসেফ ইন্ডিয়ার কমিউনিকেশনস, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড পার্টনারশিপের প্রধান জাফরিন চৌধুরী বলেন, ভুল তথ্য সম্ভবত ভাইরাসের চেয়ে বেশি সংক্রামক। এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য একটি আসন্ন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ‘সমালোচনামূলক মূল্যায়ণ দক্ষতা: তথ্যপ্রমাণ ভিত্তিক স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা কর্মশালা’ বা সিএএস ভুল তথ্য মোকাবেলা করার প্রভূত কাজে লাগবে। এই ধরনের কর্মশালা মিডিয়াকর্মীদের বিজ্ঞান-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
জাফরিন চৌধুরী আরও বলেন, কার্যকর দ্বিমুখী যোগাযোগ নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যাতে টিকা ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বাস্তবতা নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অন ইমিউনাইজেশন (এনটিএজিআই) এর কোভিড-১৯ ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ারম্যান ডা. এন কে অরোরা কোভিড-১৯ টিকা দান নিয়ে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তথ্যের গতি মন্থর না হয়। যোগ্য ব্যক্তিদের সময়মতো ভ্যাকসিনের ডোজ নিতে উৎসাহিত করার জন্য নতুন উপায় খুঁজে বের করারও আহ্বান জানান। তথ্যপ্রমাণ ভিত্তিক স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বক্তা বক্তব্য রাখলেও ইউনিসেফ-এর বিভিন্ন পদাধিকারী টিকাকরণ নিয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার আহ্বান জানান। ইউনিসেফের প্রতিনিধিরা শুধু টিকাকরণ নয়, শিশুদের পুষ্টি নিয়েও নানা বক্তব্র তুলে ধরেন। এ বিষয়ে ইউনিসেফের ইমুনাইজেশন বিশেষজ্ঞ ডা. মৈনাক চ্যাাটার্জি বলেন, শিশুদের জিরো বয়স থেকেই তাদের টিকাকরণের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। টিকাকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে মানুষের উপকারে লাগে এমন সাংবাদিকতার আর্জি জানান।
ইউনিসেফের শিশু উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ গায়ত্রী সিং শিশুদের পুষ্টির উপর জোর দেন। তিনি বলেন, শিশুরা সঠিক পুষ্টি পেলে তারা অনেক রোগ থেকেই রেহাই পেতে পারে। ইউনিসেফের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিবেক বীরেন্দ্র সিং প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিয়ে সজাগ থাকার আহ্বান জানান। এছাড়া দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক রাজীব দাশগুপ্ত বলেন, কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে বহু মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ছিল। কিন্তু কোভিড ভ্যাকসিন যে প্রয়োজনীয় সেই সচেতনতা না থাকলে সমাজের ক্ষতি।
গো নিউজের প্রতিষ্ঠাতা তথা মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার মিডিয়া উপদেষ্টা প্রবীণ সাংবাদিক পঙ্কজ পচৌরি বলেন, বর্তমান জমানায় ভুয়া খবরের রমরমা। ভুয়ো খবরের বিষ গ্রাস করছে সাধারণ মানুষকে। সেই ফেক নিউজ ছড়ানোর সবচেয়ে বেশি কাজ করে থাকেন, তাহলে সেটা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। সাধারণ মানুষ তাদের বিনোদনের জন্য এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কয়েক মিনিটের মধ্যে যে ভাবে ভুয়ো খবর পৌঁছে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে, তা শুধু দেশের জন্যই নয়, বিশ্বের জন্যও এক বিপদ ঘণ্টা। পঙ্কজ পচৌরি সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ ছড়ানোর স্বেচ্ছাচারিতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায এখন সমস্ত ধরনের খবরের প্ল্যাটফর্ম হয়ে সম্পাদক নেই। তাদের কাছে এমন লোক নেই যারা সঠিক সংবাদ বলতে পারে এবং খারাপ খবর বন্ধ করতে পারে। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় যা-ই পোস্ট করছেন, কেউ বাধা দিয়ে তা বন্ধ করতে পারেন না। যদি না কেউ অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে তিনি কোভিড-এর সময় নানা ঘটনা নিয়ে পঙ্কজ পচৌরি বলেন, এখন বহু সংবাদমাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়ার খবর ব্যবহার করে। কিন্তু তার সত্যতা যাচাই করে না। কখনো সেই খবরের সঠিক উৎস থাকে না। তাই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সজাগ থাকতে হবে। পচৌরির পরামর্শ, সব সময় তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজ করবেন না, যাতে ভুল তথ্য আমাদের পাঠকের কাছে না পৌঁছায়। ফেক নিউজ সাংবাদিকতার বিপদ নিয়ে তিনি বলেন, মহামারির সময় আমরা দেখেছি, সারা বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পাচ্ছে, তখন অনেকেই টিকা নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা ছড়াচ্ছেন। বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মানুষ তার সাথে যুক্ত ছিলেন। এর ফলে অনেক শহর, গ্রাম, এলাকা, শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মানুষ টিকা নেয়নি। এ নিয়ে অনেক ধর্মীয় নেতা ফতোয়াও জারি করেছেন বলেও কথা রয়েছে। বুঝতেই পারছেন এটা কতটা বিপজ্জনক যে মানুষের জীবন বাঁচাতে যে ওষুধ তৈরি করা হয়েছিল, তা নিয়ে ভুল তথ্য হোয়াটসঅ্যাপ এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করা হচ্ছিল। আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন যে একটি ছোট্ট বার্তা ভাইরাল হয়ে যায় এবং আমাদের শহর, গ্রামে দাঙ্গা শুরু হয়। পরে জানা যায়, একটি ম্যাসেজ ছড়িয়ে পড়ায় এ সব হয়েছে। সাধারণত জায়গায় জায়গায় দেখা গিয়েছে, যে বার্তা প্রচার করা হয়েছে, তা সত্যি নয়।
উদাহরণস্বরূপ বলেন, অনেকে না জেনেই ম্যাসেজ ফরওয়ার্ড করায় তার পর ভুগতে হয় সাধারণ মানুষের। এভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করা থেকে কোনো সরকারই এটা বন্ধ করতে পারবে না। তা ঠেকাতে হলে সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।
যদিও তিনি বলেন, বহু ফ্যাক্ট চেক ওয়েবসাইট আছে যা ফ্যাক্ট চেক করে বলে যে ঘটনা, বিবৃতি বা চিত্রটি সঠিক কিনা। তিনি সুপারিশ করেন, সিনিয়র সম্পাদক এবং মিডিয়া মালিকদেরও সিএএস পাঠ্যক্রম গ্রহণ করা উচিত, যা প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া, নিউজ ব্রডকাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়া এবং বিভিন্ন প্রেস ক্লাবের মতো পেশাদার সংস্থার মাধ্যমে উদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
দেরাদুনের অমর উজালার এক্সিকিউটিভ এডিটর সঞ্জয় অভিজ্ঞান বলেন, করোনা মহামরির সময় ভুল তথ্য এবং ভুল তথ্যের সুনামি নিয়ে এসেছে, যাকে আমরা একটি ইনফোডেমিক বলি। সিএএস-এর মাধ্যমে অর্থাৎ তথ্যপ্রমাণ ভিত্তিক স্বাস্থ্য সাংবাদিকতার মাধ্যমে ভুল তথ্য পরিবেশন থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, এই নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, থমসন রয়টার্স এবং আইআইএমসির সহযোগী স্বাস্থ্য সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা এবং গণযোগাযোগের শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিসেফ সমালোচনামূলক মূল্যায়ণ দক্ষতা’ বা সিএএস কোর্স চালু করে ২০১৪ সালে। এটি যা পরে আইআইএমসি এবং মৌলানা আজাদ জাতীয় উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। হিমাচল প্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয়, সিমলার সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, এই বছর তার তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের সিলেবাসে ক্যাস যুক্ত করেছে। এই সিএএস বা ক্যাস কোর্সের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সঞ্জয় অভিজ্ঞান বলেন, করোনার সময় দেখা গেছে এক জায়গায দু হাজারজন কোভিড ভ্যাকসিন নিয়েছেন। সেখানে মাত্র দু চারজনের জ্বর হয়েছে। সেই খবর নিয়ে কোনও কোনও মিডিয়া প্রচার করে দিল ভ্যাকসিন নিয়ে অসুস্থ হয়েছে পড়েছে মানুষ। তারা তুলে ধরেনি তাদের অসুস্থতা হওয়ার কারণ এই ভ্যাকসিন কিনা। কিংবা তারা হেডিং করেনি দু হাজার জন ভ্যাকসিন নিয়ে আঠারো শো জন সুস্থ আছেন। তেমনি মিশুদের টিকা দেওয়ার পরও কেউ অসুস্থ হযে পড়লে তা নিয়ে কারণ না জেনে বগ বড় হেডিংয়ে লিখে দেয় যে, ভ্যাকসিন নিয়ে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এর ফলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তারা পজিটিভ প্রচার করে না। সমাজের উপকারে সব সময় পজিটিভ খবর করা দরকার। এমন করা উচিত নয় তা সামগ্রিকভাবে সমাজের ক্ষতি হয়। এটা রোধ করতে হলে তথ্যপ্রমাণ ভিত্তিক সাংবাদিকতার প্রয়োজন আছে। তাহলে প্রমাণ সহ সাংবাদিকতা করা যাবে। সেক্ষেত্রে মানুষের বিপদ অনেকটাই রক্ষা পাবে।
এই কর্মশালা কি করে ফেক নিউজ নির্ধারণ করা হয় তার নিযে বিশেষ প্রেজেন্টেশন দেখানো হয়। কীবাবে গুগল কিংবা কোন কোনও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভিডিও, ফটো থেকে শুরু করে তা পুরনো কিনা খবরের সত্যতা যাচাই করে নেওয়া যায় তার পুঙ্খনাপুঙ্খ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এছাড়া বক্তব্য রাখেন দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন-এর প্রাক্তন সহযোগী সম্পাদক সোমশেখর মুলুগু, প্রাক্তন সহযোগী সম্পাদক, নবভারত টাইমসের ডেপুটি এডিটর সৌরভ শ্রীবাস্তব, ইউনাইটেড নিউজ নেটওয়ার্কের সম্পাদক মুজাফ্ফর হোসেন গাজালি প্রমুখ।
এই কর্মশালায় অংশ নেন মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮জন পড়ুয়া, অসমের ডিডি িনউজের এডিটর শান্তনু, সুদীপ ঘোষ, ধুবড়ি ডিডি িনউজের আশিকুর রহমান, দিল্লির মুসলিম মিররের সাংবাদিক আবদুল বারি মাসুদ, ইউএনআই উর্দু দিল্লির আবিদ হুসেন আনওয়ার, কলকাতা থেকে ইউএনআই উর্দুর নুরুল্লাহ জাভেদ, দৈনিক আপনজন পত্রিকার সম্পাদক জাইদুল হক প্রমুখ। সমগ্র কর্মশালাটি সুচারুভাবে সঞ্চালনা করেন বাঙালি কন্যা সোনিয়া সরকার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct