সাহিত্যে থাক প্রকৃতির ছোঁয়া
মোঃ আব্দুর রহমান
আজ কবিতার সুরেই বলতে হয়, “পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো”- মহামূল্যবান পঙক্তিটি করেছিলেন কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার(কবিতাঃ পাখি সব করে রব)। আর একটু পরিস্কার করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বটের ছায়ায় বলা যায়, সাহিত্য যেহেতু আমাদের জীবনের ভিটামিন-তাই সাহিত্যকেতো বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। তবে সাহিত্যের অক্সিজেন কিন্তু আবার প্রকৃতি। তাহলে এবার নিশ্চই কবির পঙক্তটির মর্মার্থ পরিস্কার অনুধাবন করা যায়-অর্থাৎ, ভোর হয়েছে সাহিত্যের সকল সেবক(কবি, লেখক)কে ঘুম থেকে জেগে যেতে হবে প্রকৃতির মানচিত্রে। এই সাহিত্যের সাথে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্কটা পূর্বেও ছিলো, বতর্মান এবং ভবিষ্যতেও অবশ্যই রাখতে হবে। প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে আমাদের- প্রকৃতি কী? এই আলোচনার ধোয়াটা সরাতে একটু পাখা চালানো দরকার। প্রকৃতি যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Nature। মূলত এই পৃথিবী তথা সমগ্র সৃষ্টিনির্দেশ করে। অর্থাৎ, জাগতিক বিশ্বের মানব সৃষ্ট-নয় দৃশ্য-অদৃশ্য বিষয় এবং জীবন ও প্রাণকে বুঝায়। যেমনঃ গাছ-পালা , নদী-নালা ,পশু-পাখি, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি। প্রকৃতি সম্পর্কে নানান মতামত থাকলেও গোগলের একটি মতামত বর্তমানকালে অজ্ঞতার পাথরটাকে দুই খন্ড করে ছাড়ে,”পুরো পৃথিবীটা তোমার জানালার বাইরে, তুমি না দেখলে সেটা তোমার বোকামী ।” আশারাখি প্রকৃতির গুরুত্বটা বুঝতে এই পঙক্তিটি আপাতত যথেষ্ট। তবে প্রকৃতির অজস্র উপাদানগুলি সাহিত্যে যথাযথ নির্বাচন ও প্রয়োগের কৌশল রপ্তকরা বড্ড জরুরি। যেটা করেগেছেন কালের সাক্ষীগন।
এক্ষেত্রে যাওয়া যায় কবি খান মাহমুদের ঐ লাইনটিতে,”ঐ দেখা যায় তালগাছ ঐ আমাদের গাঁ।”(কবিতাঃকানা বগীর ছা)। অর্থাৎ, গাঁয়ের রূপ,রস ও গন্ধকে ফুটিয়ে তুলতে হবে সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় এবং শিরা-উপশিরায়। যেটা করেছেন পল্লীকবি জসীম উদ্দিন, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাস সহ অসংখ্য গুনি কবি ও লেখক। আজ গ্রামটা মনের ভিতর ঘুরে বেড়ায়, এমনকি চিত্রকল্প অঙ্কন করে তাঁদের কলমের অবদানে। তাই গাঁয়ের লুকিয়ে থাকা সাহিত্যের রশদ তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করতে হবে। এবার বলা যায় বিশ্বকবির একটি পঙক্তি, “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে। “ আহা!ছোট্ট নদীর সৌন্দর্যটা কত সুন্দরভাবে কবিতায় সেলাই করেছেন মাত্রা এবং ছন্দে। আর এই কথাটাই কিন্তু যার যার গাঁয়ের ছোট্ট নদীটাকে কল্পনায় বা বাস্তবে নিঃসন্দেহে ভালোবাসতে সাহায্যে করেছে। আরও যোগ করা যায় লোকান্তরের কবির সোনালী কাবিনের সেই হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়া পঙক্তি, “নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তুমার কাছে? -হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।” (কবিতাঃ নোলক) বাহ্! শব্দের অলঙ্কারে পঙক্তিটি চিরদিন অমর করে রাখবে পৃথিবীর সকল নদীকে। এটাইতো হলো কবির প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল বা কারিসীমা। ধারাবাহিকতা মনে করিয়ে দেয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পঙক্তি,”অনেক দিন থেকে আমার একটি পাহাড় কেনার শখ।”( কবিতাঃ পাহাড় চূড়ায়)। এই পঙক্তি পাহাড়ের যৌবন,ঝর্না ধারা,কান্না, পাথরের গড়িয়ে চলা সব মনে পড়ে যায় লাইনটি উচ্চারনের মধ্য দিয়ে। এটাই কবির অর্জন, বিশাল পাহাড়টিও স্থান করে নিয়েছে পাঠকের অশান্ত মনে। এভাবেই আজ ময়নামতি, গারো পাহাড় থেকে হিমালয় পর্যন্ত অন্বেষনে ছুটে বেড়াবে সাহিত্য সেবকদের কলম। আর এটাই স্বাভাবিক। শিশুদের উদ্দেশ্যে লেখা নজরুলের পঙক্তির কথাতো না বললেই নয়,”ঐ ডাকে জুঁই-শাখে ফুল-খুকি ছোট রে।”(কবিতাঃ ভোর হলো)। বা “সূয্যি মামা উঠার আগে, উঠবো আমি জেগে”। (কবিতাঃ আমি হবো)। কখনও ফুল আবার প্রকৃতির সূয্যি মামার সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে লেখাটাকে চিরসজীব করে রাখলেন ধরাতে নজরুল। এই ভাবেইতো প্রকৃতির সমস্ত ফুল-ফল এবং গাছগুলিকে সাহিত্যের সংসারে সংযোজন করতে হবে।
মানব জাতিও কিন্তু প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, সে কথা মাথায় রেখে রচনাশৈলীতে মানুষকে কলমের ডগায় বিভিন্নরঙে রাঙাতে হবে । যে কাজটি যুগ যুগ ধরে করে চলেছেন সাহিত্যিকরা। বাস্তবজীবনের মহাসাগর সেচে ভাল-মন্দ সবকিছু তুলে আনতে হবে এখানে...। কারণ সাহিত্যে হলো মানব কল্যানের সেবক। পাশাপাশি সব চাইতে প্রকৃতির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নারী। নারী ও নদীর সাথেতো মহামূল্যবান মিল রয়েছে সেটা প্রমান পাওয়া যায় আলমাহমুদের কবিতার জন্য বহুদূর কাব্যগ্রন্থে। পাশাপাশি কবি নজরুল বলেছেন, “ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”(কবিতাঃ নারী)। আর জীবনানন্দ দাসতো লিখেই গেছেন বিখ্যাত “বনলেতা সেন” নামক অমর কবিতা। তাই নারীর বিষয়টিকে অবশ্যই টেনে আনতে হবে সাহিত্যের আঙিনায়। এভাবেই প্রকৃতির সকল উপাদানগুলিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাজে লাগিয়ে সাহিত্যের ঝুলিকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। অনুজদের কাধে তুলে নিতে হবে অগ্রজদের দায়িত্বটুকু। মানবকল্যানেই অবদান রাখা যেহেতু সাহিত্যের উদ্দেশ্য। তাই প্রকৃতির ছোঁয়াতেই বেড়ে উঠুক সাহিত্যের গতর। বিদায় বেলায় কবি জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয়,” আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে হয়তোবা মানুষ ন্যায় হয়তোবা অসংখ্য চিল...।”
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct