প্রথম বিমানে উঠেছিলেন ছয় বছর বয়সে। অবশেষে সত্যি সত্যি তিনি চাঁদের বুকে পা রাখলেন ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। তিনি মহাকাশে ছিলেন ৮ দিন ১৪ ঘণ্টা ১২ মিনিট ৩০ সেকেন্ড এবং চাঁদের বুকে ছিলেন প্রায় ২১ ঘণ্টা। তাকে নিয়ে লিখেছেন নাজমুল হোসেন।
নীল আর্মস্ট্রং যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োতে ১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। মা ভায়োলা লুইজ এনজেল, বাবা স্টিফেন কোয়েনিগ আর্মস্ট্রং। ১৯৫৬ সালে জ্যানেট শিরনকে বিয়ে করেন। দুই ছেলে এরিক ও মার্ক এবং এক মেয়ে ক্যারেন। ১৯৬২ সালে নিউমোনিয়ায় মারা যায় ক্যারেন। ১৯৯৪ সালে জেনেটের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে ক্যারোল নাইট নামের এক বিধবাকে বিয়ে করেন। গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার আগে বিমান চালানোর লাইসেন্স পেয়েছিলেন মানুষটা! বিমান দেখে প্রথম মুগ্ধ হন দুই বছর বয়সে, বাবার সাথে ন্যাশনাল এয়ার রেস দেখতে গিয়ে। প্রথম বিমানে উঠেছিলেন ছয় বছর বয়সে। অবশেষে সত্যি সত্যি তিনি চাঁদের বুকে পা রাখলেন ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। তিনি মহাকাশে ছিলেন ৮ দিন ১৪ ঘণ্টা ১২ মিনিট ৩০ সেকেন্ড এবং চাঁদের বুকে ছিলেন প্রায় ২১ ঘণ্টা। কোরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৬২ সালে তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ‘মহাকাশ কর্মসূচি’তে যোগ দেন নিল। ১৯৬৬ সালে ‘জেমিনি-৮’ মহাশূন্য মিশন দিয়ে তার প্রথম মহাকাশযাত্রা শুরু। তিনি ছিলেন এই মিশনের কমান্ড পাইলট। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে চাঁদে প্রথম মনুষ্য অভিযান অ্যাপোলো-১১-এর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ফোরিডার কেনেডি মহাকাশকেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপিত হল দুই হাজার ৯০০ টন ওজনের স্যাটার্ন ভি রকেট। সাথে বয়ে নিয়ে গেল কলম্বিয়া লুনার কমান্ড মডিউল আর এক প্রজন্মের রাশি রাশি স্বপ্ন।মিশনটি ছিল অ্যাপোলো-১১। মিশনের অধিনায়ক ছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর ৩৮ বছর বয়সী সাবেক পাইলট নিল আর্মস্ট্রং। গন্তব্য চাঁদের সি অব ট্রাঙ্কুইলিটি। বিশাল আকৃতির রকেটটি মহাকাশযান কলম্বিয়া এবং নভোচারী আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সকে নিয়ে পৃথিবীর কপথে দুই ঘণ্টা ৩৩ মিনিট অবস্থান করে। এরপর পৃথিবীর মহাকর্ষ বল অতিক্রমের জন্য যানটির এস-আইভিবি নামের ইঞ্জিনটি আবার চালু করা হয়। মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রমের পর শুরু হয় চাঁদের দিকে যাত্রা। মহাকাশযান কলম্বিয়ার সাথে যুক্ত ছিল চাঁদে অবতরণের মডিউল, যেটি ঈগল নামে পরিচিত। ঈগলে আরোহী হিসেবে ছিলেন নভোচারী আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন। অভিযান শুরুর তিন দিন পর সংযুক্ত অবস্থায় অ্যাপোলো-১১ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। ২০ জুলাই আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন ঈগলকে কলম্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে চাঁদের মাটিতে অবতরণ শুরু করেন। অপর নভোচারী কলিন্স থেকে যান কলম্বিয়ায়, যেটি কমান্ড-সার্ভিস মডিউল নামে পরিচিত। অভিযান শুরুর ১০২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট ৪০ সেকেন্ড পরে ঈগল চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করে। এরপর সব প্রস্তুতি সেরে ঈগল থেকে ছোট্ট একটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে চাঁদের মাটিতে প্রথমে পা রাখেন কমান্ডার আর্মস্ট্রং। ২০ মিনিট পর তাকে অনুসরণ করেন সহযোগী অলড্রিন। চাঁদের বুকে রচিত হয় মানুষের বিজয়গাথা। এ অভিযান শেষে দুই নভোচারীকে নিয়ে ২৪ জুলাই নিরাপদে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসেন তিনি। অ্যাপোলো-১১ ছিল আর্মস্ট্রংয়ের শেষ মহাকাশ অভিযান। ১৯৭১ সালে তিনি নাসা ছেড়ে যান। পরে শিকতা পেশায় যুক্ত হন। নভোচারী হিসেবে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। অক্লান্ত প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেলসহ বহু পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি। চাঁদের মাটি স্পর্শ করার অনুভূতি সম্পর্কে আর্মস্ট্রং জানিয়েছিলেন, ‘এটি মানুষের জন্য ছোট্ট পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য এক বিরাট অগ্রগতি।’ চাঁদে পা রেখেই করা আর্মস্ট্রংয়ের উক্তিটি মানব ইতিহাসে বহুল আলোচিত উক্তিগুলোর অন্যতম। কিন্তু ক্ষণিকের উত্তেজনায় কি ব্যাকরণগত কোনো ভুল করে ফেলেছিলেন তিনি? রেডিওতে ভেসে আসা কথাটি পৃথিবীর মানুষ শুনেছিল এভাবে ‘দ্যাটস ওয়ান স্মল স্টেপ ফর ম্যান, ওয়ান জায়ান্ট লিপ ফর ম্যানকাইন্ড।’ এখানে ম্যানের আগে ব্যাকরণ মেনে যে একটা ‘অ্যা’ বসাতে হবে, শ্রোতাদের দাবি ওই সময় তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন আর্মস্ট্রং। পৃথিবীতে ফেরার পর তাকে ঘিরে কৌতূহলী জনতাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘অ্যা’ তিনি ঠিকই উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু শুনতে না পারাটা স্রেফ শ্রোতাদের ব্যর্থতা।১৯৯৯ সালে চন্দ্র জয়ের ৩০ বছর পূর্তিতে আর্মস্ট্রং স্বীকার করেন, রেকর্ড করা কথাটি তিনি পরে শুনেছিলেন, মনে হচ্ছে ‘অ্যা’টা আসলেই বাদ পড়ে গেছে! তাই ‘অ্যা’কে বরং উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে রাখাই ভালো। পরে এটির কথা উল্লেখ করার সময় ‘অ্যা’কে উদ্ধৃতিচিহ্ন বা বন্ধনীর ভেতরে রাখা চল হয়ে দাঁড়ায়। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই উক্তি নিয়ে এর পরও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। পিটার শান ফোর্ড নামের একজন অস্ট্রেলীয় কম্পিউটার প্রোগ্রামার একটি সফটওয়্যার দিয়ে কথাটিকে পুঙ্খানুপঙ্খ বিশ্লেষণ করে রায় দেন, একটি শব্দ শুনতে প্রায় ‘অ্যা’র মতোই লাগছে। মাত্র ৩৫ মিলিসেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল এই ‘অ্যা’। ফলে মানুষের শ্রবণযন্ত্রে বাদ পড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয় মোটেও। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর্মস্ট্রং স্বয়ং মনে করতেন ‘অ্যা’টা সত্যিই বাদ পড়ে গিয়েছিল। ২০১১ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘তখন আসলে এত কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছিল, কথাটা বলার সময় খুব মনোযোগী থাকতে পারিনি।’ ১৯৭১ সালে নাসা ছেড়ে দিয়ে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য আমিরিকার ওহাইও রাজ্যের সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন আর্মস্ট্রং। তিনি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct