রূপভান কন্যা
হেদায়েতুল্লাহ
কানা ভাঙা থালার মতো চাঁদ সবে পশ্চিমের আকাশে মাথা গলিয়েছে, এমন সময় রাতের কুহক ভেঙে যায়। একা মানুষ মোতিলাল। বোধহয় জেগে যায় সে।
পূর্ণ মহিমায় পৌঁছুতে আরো দু’রাত। তবু জোছনা যেন চরাচরকে মুগ্ধ করে রেখেছে। রাতের ছন্দ মেঘে আবার একটানা মায়াবি ডাক। আর বিছানায় থাকতে পারে না সে। এই লকডাউনের বাজারে কেউ বদ মতলবে এলো?
ঘরের দরজা খুলে বেরোয় মোতিলাল। দাওয়ার বাঁশের দরজা যেমনকার তেননি। বাইরে জোছনাভরা উঠোনের দিকে তাকায়। কেউ কোথাও নেই। তবে কি খিদে পেয়েছে রূপভানের? সাঁজের বেলা অন্যদিনের মতো ভরপেট খাবার জুগিয়েছে। ওকে? একটু যেন বিরক্ত হয়ে তাকায় দাওয়ার পুব পানে। জোছনার রূপসী আলোয় তার অদ্ভুত ভঙ্গিমা দেখে অবাক হয় মোতিলাল। আকাশের চাঁদের দিকে উদাম নয়নে তাকিয়ে আছে রূপভান।
এবার থমকে যায় মোতিলাল। মেঘে মেঘে বেলা বেড়েছে, খেয়াল করেনি। তার বৌ রোহিলা বিবি আর বুধি পিঠোপিঠি মারা যায়। তখন তার বছর খানেক বয়েস। ছেলেরা বিক্রি করে টাকা ভাগাভাগি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মোতিলাল রাজি হয়নি। তার কাজল চোখ দুধে আলতা রং। কৈশোরে দেখা রূপভান পালার কথা মনে পড়ে। মোতিলাল এই জীবন পালায় যেন এক বিয়োগান্তুক সাজে।
সে এবার এগিয়ে যায়। রূপভানের মাথায় হাত রাখে। দিন দিন সে রূপসী কন্যা হয়ে উঠেছে। মোতিলাল এবার সস্নেহে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোর? ঘাড় ঘোরায় না রূপভান। প্রায় পূর্ণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে সলাজ ডেকে ওঠে। মোতিলালের আর বুঝতে দেরি হয় না। এ যেন কন্যার এক ভরা যৌনতার অপেক্ষা তার গায়ে হাত বুলিয়ে সে বলে, শান্ত হব রাতটুকু কাটুক।
ভোরবেলা উঠে পড়ে মোতিলাল। আঙিনার বাইরে তাকে খুব একটা বের করে না। কিন্তু এবার উপায় কী? গোপালপুরে তার একটা চেনা জানা জায়গা আছে। বেশ কয়েকবার যাতায়াত আছে সেখানে। তবে এভাবে তাকে .... বের করবে না। পুরোনো টিনের বাক্স হাতড়ে একটা নীল রুমাল আর সবুজ চাদর পরে উঠোনে ঝরে পড়া ফুল মালা গাঁথে বকুলের।
গোপালপুর এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার। ভরপেট খেয়ে নেয় দুজনে। গলায় মালা মাথায় নীল ঘোমটা গায়ে সবুজ চাদর শাড়ির মতো জড়ানো। রূপভান যেন নতুন কনে । তৈরি হয় মোতিলালও। কী একটা মহামারি এখন। নাক মুখ ঢেকে বেরোতে হবে, নইলে রাস্তাঘাটে পুলিশ তাড়া দেবে। গামছা জড়িয়ে নেয় মানুষের নিঃশ্বাসে নাকি চড়ায় এ রোগ।
এত রাস্তা হেঁটে যখন সবুল ঘোষের বাড়ি পৌঁছায় তখন বেলা দশটা বাজে। রোদ বেশ চড়েছে। চেনা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে ডাক। বাইরের উঠোনে উবু হয়ে কাজ করছে সুবল। গলার স্বর চেনা চেনা ঠেকলেও ঠিক মতো বুঝতে পারে না। জিজ্ঞেস করে, কে? চিনতে পারছি নে!
মুখে জড়ানো গামছা খুলে ফেলে মোতিলাল, এবার পারলে?
-ওঃ! মোতিলাল; তা খবর কী?
-এই দ্যাকো কাকে এনেচি!
-সে তো দেখতে পারছি। কিন্তু তুই বোধহয় জানিস নে!
-কী?
এই লকডাউনের বাজারে ছেলেরা সব ফিরে এসেছে। এখন নিজেদের খোরাকি জোটে না! তাকেই বা কী দেব?
লকডাউনের মাস দেড়েক আগে কয়ালপুুর বাজারে দুজনের দেখা হয়। ভালো মন্দ দু-চারটে কথাবার্তা হয়। সুবলের দুই ছেলের আর জাত ব্যবসায় মন নেই। তারা চেন্নায় গেছে সোনা পালিশের কাজে। পাল্টা মোতিলাল তার কথা উপুড় করে। ছেলের সব ব্যালক হয়ে উঠে গেছে। বাপকে মাস কাবারি ভাগাভাগি করতে চাই। সে রাজি হয়নি। একা রাঁধে বাড়ে খায়।
-শিবচরণ নেই? একটু যেন ধাক্কা খায় মোতিলাল।
-তাহলে আর বলছি কী! ছেলেরা এসে তাকে হাত বদল করেছে।
-আমার রূপভানের তাহলে কী হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোতিলাল।
সুবল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমি জাত ব্যবসা তুলে দিলেও মাসতুতো ভাই রেখেছে।
-কোথায়?
গোঁসাইপুর গিয়ে তারেককে আমার নাম বলছি।
মোতিলাল গোঁসাইপুর চেনে কিন্তু ভাবুককে চেনে না। ইতিমধ্যে সুবলের এক ছেলে এসে কী দরকারে তাকে ডেকে নিয়ে যায়। তার মাসতুতো ভাইয়ের সুলুক সন্ধান আর ভালোভাবে জানা হল না।
বেলা বেড়ে যাচ্ছে। এখান থেকে গোঁসাইপুর আবার কম না। সে একবার ভাবে ফিরে গেলে হয়. তোড়জোড় করে আবার কালকে যাত্রা শুরু করা যাবে। রূপভান বাধ্য মেয়ের মতো তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মোতিলালের মনে পড়ে রাতের সেই উদাসি ডাক। আজ রাতেও তাহলে বিরহ বাসরে রাত জাগবে। তার কষ্ট মানে জনকের আঘাত। একবার যখন বেরিয়ে পড়েছে তখন থেমে লাব নেই। পথে কোথাও না হয় তারকের হদিশ জেনে নেবে। আবার মুখে জড়িয়ে গামছা।
গোঁসাইপুর ঢোকার আগে হরেক কাজের পঞ্চায়েতের নোটিশ বোর্ড। যখন তারা সেখানে পৌঁছায় তখন সূর্য একেবারে মাথার ওপর। থমকে গিয়ে মোতিলাল এদিক ওদিক তাকায়। রাস্তায় ধারে ছোট এক চায়ের দোকান। তখন উদ্যোগ চলছে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে দোকানি বিরক্ত গলায় এখুন চা ফা হবে না।
-সেজন্য আসিনি।
-তবে?
-তারকের বাড়িটা?
এবার তাদের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। আগাপাশতলা দেখে দোকানি বুঝি কিছু একটা আন্দাজ করে। কোমরে জড়ানো গামছায় মুখ মুখে বলে, ওই যে বোর্ডে গা দে রাস্তা নেমে গেচে। দশ মিনিট হেঁচে যাও, বাঁ হাতে পুকুরের ধারে বাজ পড়া তাল গাছ। তার পেছনে তারক ঘোষের বাড়ি।
একটানা বলে সে নিজের কাজে মন দেয়।
একেবারে নিখুঁত ধারা বিবরণী। পোড়া তালগাছের পেছনে এসে মুখের গামছা খুলে ফেলে সে। বাইরে কেউ নেই। বাড়ির দিকে তাকিয়ে ডাকাডাকি শুরু করতে জাবনা কাটা দা হাতে একজন মাঝ বয়েসি লোক বেরিয়ে আসে, কী ব্যাপার?
-সুবলদা এখানে পাঠালে।
লোকটা প্রথমে খেয়াল করেনি। মোতিলালের পেছনে দাঁড়ানো নীল ঘোমা লোকটা প্রথমে খেয়াল করেনি। মোতিলালের পেছনে দাঁড়ানো নীল ঘোমটা পরা কন্যাকে দেখে একটু বিভ্রান্ত হয়। পরে তার অভিজ্ঞ চোখে সব কিছু পরিষ্কার হয়। সে প্রসন্ন মুখে বলে, মা লক্ষ্মী কেনে বাইরি কেন? ভেতরে এসো।
তারক তাদের পথ দেখায়. কিন্তু নতুন বাড়িতে ঢুকতে ইতস্তত করে রূপভান। মোতিলাল তার গায়ে মাথায় আদর করে বলে, এটাও তোর একটা বাড়ি। পেছনের উঠোনে বড়ো এক আমগাছ। তার নিচে একটা টিন শেড। সেখানে জাবর কাটছে সে। তারক বলে, ভোলা বড়ো ছটফটে আর দামাল।
ভোলাকে দেখে খুব পছন্দ হয় মোতিলালের। তরতাজা নবীন যুবক তাদের দেখে সে দাপাদামি শুঁড় করেছে। কিন্তু তার মুগ্ধ দৃষ্টি যেন রূপভানে নিমগ্ন।
তারক বলে, চলো ভাই; বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে ওরা লজ্জা পাবে।
ঘাড় নাড়ে মোতিলাল।
বাইরের বারান্দায় পাতা চৌকির ওপর বসে তারা। দুজনে বিড়ি ধরায়। প্রাথমিক আলাপ: সালাম হয়ে গেলে তারক বলে, আজকাল খুব বিপদ।
-কোত্থেকে এক আপদ বালাই জুটেছে! মুখে গামছা বাঁধো। কোথাও ভীড় করো না।
-সে তো আছে। তা ছাড়াও-! চিন্তিত মুখে বিড়িতে এক লম্বা টান দেয় তারক। - পথে কেউ তোমাদের আটকায় নি তো?
-পুলিশের ভয়ে নাক মুখ দেকেচি।
- আমি সে কথা বলিনি।
-তবে?
-দেখুন তো সব বেড়েছে বাতিক। যাক্গে সে কথা। তুমি বোধহয় সকাল সকাল বেরিয়েচো!
-ঠিক ধবেচ। গোপালপুর ঘুরে আসতি হল।
-দুপুরবেলা কী বিড়ি টেনে থাকবে? সুবল মোতিলালের আয়েসি ধোঁয়া ছাড়ার দিকে তাকিয়ে বলে।
-তাছাড়া উপায় কী? মোতিলাল চোখে মুখে প্রশ্নচিহ্ন তুলে তার দিকে তাকায়।
-যদিও লকডাউনের বাজার। তবু অতিথি, যার কোন তিথি লক্ষণ নেই। তাছাড়া খদ্দের তো লক্ষ্মী!
একরকম জোর করে পাত বাড়ে সুবল। একা একা যা হোক বাঁধে বাড়ে খায় মোতিলাল। অনেকদিন পরগৃহস্থ বাড়িতে তৃপ্তি পেল সে।
সাঁজের একটু আগে মায়াবাসর সঙ্গে হয় তাদের। এবার ফেরার পালা। রূপভান ধ্বস্ত কাণ্ড কিন্তু চোখে মুখে পূর্ণতার ছাপ। ফুলে মালা ছিন্ন ভিন্ন। ঘোমটা নেই। পরনের শাড়ি বেহাল। মোতিলালের কোন খেদ নেই। এমন যে হয়, এবার কন্যাপণ মেটানোর দায়। তাড়াহুড়ো করে মোতিলাল। রাতে কার্ফু নামার আগে ফিরতে হবে। কালিকাপুর ফেরার জন্যে একটা শর্টকার্ট রাস্তা বাতলে দেয় তারক। গোবর্ধনপুর বাজারের ভেতর দিয়ে গেলে ভারি রাত নামার আগে পৌঁছে যাবে বাড়ি। সে পথ অবশ্য খুব একটা চেনা না মোতিলালের। তবে সে বাজারের একটা উচুঁ আগে তাকে পথ দেখাবে।
সাধ্যমতো কন্যাপণ মিটিয়ে রাস্তায় নামে মোতিলাল। মুখে আবার গামছা জড়িয়ে নেয়। কার্ফু নামার ভয়ে সুবলের বাতলানো পথ ধরে সে।
ফেরার পথে তাকে জীবন যাত্রাপালার পাঠ দেয় মোতিলাল। বাজার এদেশে যৌবনবতী রূপভানকে বনবাসে যেতে হয়েছে। কিন্তু সে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ কি শুধু মুখের? দুঃখ কি নেই? বনবাসের বিপদ কি নেই?
গোধূলির শেষে তারা একটা গঞ্জে এলে হাজির। দিনের আলো নিভে গেছে। রাস্তার ধারে খুব উঁচু একটা ল্যাম্প পোষ্টের ডগায় বড়ো এক বাতি সদ্য চোখ মেলেছে। এই তাহলে গোবর্ধনপুর বাজার।
ল্যাম্প পোষ্টটা একটা তেমাথার মোড়ে এসে খাড়া। সেখানে হাজির হয়ে একটু আতান্তরে পড়ে মোতিলাল। কোন পথ ধরবে ডাইনে না বাঁয়ে? কোনদিকে হাঁটলে সদর রাস্তায় উঠবে? তারক বাতলে দিয়েছিল কিন্তু এখন ঠিক মন করতে পারচে না। অথচ সময় রাস্তায় না উঠলে সে কালিকাপুর নিজের গাঁয়ে ফিরবে পারবে না। লোকজন নেই। দোকানপাট সব বন্ধ। হঠাৎ নজরে পড়ে একটা নীল উজ্জ্বল পারবে না।
আলোর সরু রেখা। একটা বন্ধ দোকানের সামনে মোবাইলের নড়াচড়া। একটা রোগ মতো ছেলে ফোন নিয়ে আপন মনে কী করছে. তার কাছে গিয়ে মোতিলাল সাড়া দেয়, বাবু শুনচ?
গেম খেলায় ব্যস্ত সে। বেশ কিছুক্ষণ পর স্ক্রিনে চোখ রেখেই বলে, কী?
-ডান না বাঁ - কোনটা যাবে সদর রাস্তা?
মোবাইল রেখে সে সোনা হয়ে দাঁড়ায়। রাস্তার আলোয় বুঝতে পাবে, লোকটা একা নন। কিন্তু এখানের কোন রাস্তাই সদরে যায় না। মুখে বা কেনগামছা বাঁশ? সে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, সদর রাস্তা খুঁজছো কেন?
মোতিলালও অবাক হয়ে বলে,এটা তো গোবর্ধনপুর।মুখ থেকে গামছা সরায় এবার। এবার তার সন্দেহ গাঢ় হয়। তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। লোকটা বোধহয় মাল নিয়ে বে-পথে চলে এসেছে। একটা কিছু তো করতে হয়। অজানা এক দায়িত্ববোধ যেন বাতিকের মতো তার কাঁধে এসে চাপে।
সে ব্যগ্র গলায় বলে, চল; তোমাকে পথ দেখিয়ে সিড়ি!
হাঁটতে হাঁটতে তেমাথা পেরোয় বাজারের শেষে একটা উজ্জ্বল আলোর কাছে হাজির হয় তারা। এখানে মানুষজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তাদের দেখে নড়ে চড়ে বসে বলরামপুর শক্তিসংঘ ক্লাব। প্রেসিডেন্ট ক্লাবের বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে মোবাইলে গান শুনছিল। সে হেডফোন নামিয়ে বিজ্ঞেস করে, ফটিক; ব্যাপার কী?
পঠিক তাদের সঙ্গে করে এনেছে। সে এগিয়ে এসে বান্টির কানে কানে কী সব বলে। বান্টি প্রেসিডেন্ট সুলভভাবে তাদের দিয়ে তাকায়। লোকটার আগাপাশতলা বান্টি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। গায়ে কীর্ণ পানজানি। পরণে ময়লা লঙ্গি। কাঁধে একটা গামছা ফেলা। এবার সে ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে, তুমি যাবে কোথায়?
-কালিকাপুর-আমার বাড়ি।
কিন্তু সে তো এদিকে নয়।
ক্লাবের ছেলেরা বান্টিকে ঘিরে ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ, করো মোতিলাল যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে মাঝখানে কোথায় পথ বদল হয়েছে টের পায়নি। সে হাজির হয়েছে গোবর্ধনপুরের একেবারে উল্টোদিকে বলরামপুর বাজারে। তারকও বোধ হয় জানে না সব বাজারে এখন উঁচু ল্যাম্প পোস্টের বাতি।
মিনিট দশেখ বাদে বান্টি এবার গলায় ঝেড়ে বলে, উপায় একটা আছে। মোতিলাল উৎসুকভাবে বলে, কী উপায় বাবু?
-ওকে কত পথ হাঁটিয়ে এনেছো-, আবার কোথায় নিয়ে যাবে, আমরা জানি নে। রূপভানের দিকে আঙুল তুলে বলে বান্টি। সে এবার প্রতিবাদ করে বলে, ওকে গোসাইপুরনিয়ে লে ......., একন বাড়ি ... থাকি।
-ওসব মিথ্যে কথা। পাল থেকে কে একজন বলে।
-মিথ্যে নয়, বাবু। ককিয়ে ওঠে মোতিলাল।
-আমার সত্যি মিথ্যের বিচারক ভালো জানি। তবে তোমাকে পুলিশে দেব না। তুমি ওকে রেখে যাও! রূপভানের দিকে আবার আঙুল তোলে বান্টি।
-এতো যাত্রাপালার মতো বিচার হল।
-কেন? বিরক্ত হয় বান্টি।
-আমার মেয়েকে আমি বনবাসে রেখে যাব?
-কী এত বড় কথা? আমাদের ক্লাব তোমার কাছে বন হল। তার পালে ঠাস করে একটা চড় কষায় বান্টি। মোতিলাল তার পা জড়িয়ে ধরে বলে, বাবু, রাজার মতো বিচার কর না।
কিন্তু তখন কে শোনে কার কথা। এই লকডাউনের বাজারে তাদের হাতে কোন রাদ নেই। অন্তত একটা মানবেতর জীবনকে তারা অনির্দিষ্ট কোন ঠিকানায় পৌঁছানোর আগে রক্ষা তো করথে পারবে। শ্রান্ত ক্লান্ত রূপভানের জন্যে তাদের মায়া হয়। কেউ এনে দেয় এক বালতি জল। কেউ ডাল সমতে কাঁঠাল পাতা। আর মোতিলালের জন্যে ক্লাব ঘর থেকে বেরোয় দড়াদড়ি।
সকালবেলা পুলিশ এসে যখন নিমগাছে পিছ মোড়া করে বাঁধা তার বাঁধন খোলে, তখন মোতিলালের শে নিঃশ্বাসটুকু পড়তে বাকি। সেখান থেকে ব্লক হাসপাতাল।
মহামারি নিয়ে পুলিশের ঘুম নেই। ডাক্তার ক্লান্ত। ক্লাবের ছেলেদের নাম কে কেস দেবে? এই দুঃসময়ে ভীমরুলের চাপে কে ঢিল মারতে চায়? মোতিলাল অনেক পথ হেঁটেছে। দুর্বল হার্ট সহ্য করতে পারেনি। পুলিশের অনুরোধে দেহে বেশ কয়েকটা গভীর আঘাতের চিহ্ন সত্ত্বেও এই রিপোর্ট এল।
বাপের ..... সঙ্গে রূপভানকে নিয়ে এলো দু-ভাই - বুলু আর খোকন। পুলিশ গম্ভীর হয়। সন্দেহ তাদেরও কাটেনি। সঠিক প্রমাণ কোথায়? গাঁয়ের কয়েকজন সাক্ষী দেয়। কিন্তু সাজিয়ে আনা এসব গোঁজা মি তারা সন্তুষ্ট না। শেষ পর্যন্ত বাইরের গাঁয়ের সুবল ঘোষ এলে কবু করে, সেদিন সকালবেলা মোতিলাল তার বাড়িতে একা আসেনি। তাকে সেই গোঁসাই হবে আত্মীয়ের ঠিখানা দেয়।
বাপের চারদিনের কাজ মিটে গেলে বাকি সব সবায় সম্পত্তি ভাগাভাগি করে তারা। কিন্তু রূপভানকে নিয়ে বেধে যায় কানিয়া। বুলুর বৌমনিরা বলে, আমরা বড়ো, আমাগো দাবি আগে।
খোকনের বৌ শিউলি মুখরা। সে বলে, বড়োর কোন দাবি তোমরা পূরণ করেচ? মাস কাবারি ভাগাভাগির সময় সউররি তোমরা এড়িয়ে যেতে চাওনি?
দু ভাই থামিয়ে দেয় তাঁদের। পান পরাগ খেতে খেতে পারমর্শ করে। বাপডা নি। কে আর বাধা দেবে। জীবনতলার কশাই ফকরু মিয়া তারে চেনা। তাড়াতাড়ি কাজ সারা ভালো। রূপভানের মতিগতি যেন কেমন।
ফকরু মিয়া সব শুনে মাথা নাড়ে। বাঘে ছুঁলি আঠারো ঘা। আর পুলিশে ছুঁরি বিশ ঘা। তার ওপরে পুলিশে ছোঁয়া সওদা-বাপরে, শেষে বেঘোরে জেলা খাটতি হবে।
বাড়ি ফিরে তারা ঠিক করে, মাসকাবারি ভাগাভাগি করে পুষবে তখন। তারপর সময় ফিরলে তখন দেখা যাবে। কিন্তু তারা যা ভেবেছে তা বুঝি আর হয় না। দিনকে দিন রূপভান যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। কখনো খায়। কখনো খায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখে অইবরল ধারা। কাঁচা বয়েসের ছেলেদের দেখলে ছোট শিং বাগিয়ে তেড়ে যায়. বেশ ফ্যাসাদে পড়ে দু-ভাই অগত্যা এই টানাটানির বাজারে নগদ গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে গো-বাজ ডেকে আনে। সে দূর থেকে দেখেই বলে, সব্বোনাশ!
বুলু কেমন মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, এমুন কুডাক দেচ্চো কেন গো-বাজ!
দিচ্চি কী আর সাধে! নতুন রোগের কথা শুনিশনি? বড্ডো ছোঁয়াছে! মানুষ গরু কারোর রেহাই নেই।
-তবে উপায়? খোকন এবার বলে।
-আয় শোন! গো-বাজের মুখের কাছে কান পাতে দুজন
আপনি বাঁচলে বাপের নাম! গোবাজ তাদের সঠিক পরামর্শ দেয়।
তাড়াতাড়ি করা সবার পক্ষে মঙ্গল। সেদিন বেলাবেলি দু’ভাইয়ের একজনকে নিত্যবাজারের ভবা মাস্টারের সার বিষের দোকানের সামনে দেখা গেল। আর সাঁজের বেলা দু’ভাই সবার অলক্ষ্যে কোদন আর শাবল নিয়ে বেরিয়ে গেল।
পরের দিন ভোরের আলো ফোটার আগে বিছানা ছাড়ে বুলু আর খোকন। সারা রাত প্রায় তাদের ঘুম হয়নি। রূপভান খাবে তো? ফ্যানে ভাতে মেখে দিয়ে এসেছে। যা খামখেয়ালি হয়ে উঠেছে সে।
রাতের বেলা তারা তাদের বাড়ি থেকে বেল দূরে আমবাগানের ঝুপসির মধ্যে বেঁধে রেখে এসেছে। সেখানে পৌঁছে আলো আঁধারিতে ঠিক ঠাহর করতে পারে না। তবে একটু কাছে এসে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারা যা আশঙ্কা করেছিল তা নয়। আগেই তারা তৈরি হয়ে এসেছে। প্লাস্টিকের বড়ো পেপার দিয়ে অতি সাবধানে তার দেহ মুড়ে দেয়।
বাড়ির পেছনে বাঁশ বাগানে বাপের কবর। তার পাশে এক চিলতে ভাগাড়। লোকজন এখনো জেগে ওঠেনি। আগের দিন সাঁজবেলায় এখানে মাপসই কবর খুঁড়ে রেখেছে তারা। সেখানে সতর্কভাবে নামায় তাদের কাঁধের ভার।
দ্রুত হাতের কাজ শেষ তারা একবার বাপের কবরের দিকে তাকায়। তখন মৃদু বাতাসে এক সর্সর্শব্দ ভেসে আসে। মোতিলাল কি যন্ত্রণায় পাশ ফেরে? বুলু আর খোকন ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আর রূপভান?
চোখের সামনে পরম আত্মীয়ের নিষ্ঠুর বিয়োগ বেদনা তাকে আচ্ছমু করেছে। নিরুপায় দাপাদাপিতে সে উন্মাদ হয়েছে। কোন মারি তাকে স্পর্শ করেনি। বারে অতিমারি ঠেকাতে রাস্তায় পুলিশ নেমেছে। কিন্তু ভেতরে? রূপভান কী বলতে পারবে, তোমরা তো মানুষ-, তোমাদের চৈতন্যে সে মড়ক লেগেছে তাকে ঠেকাবে জীবন যাত্রাপালায় রাজার সেপাই?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct