বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। ত্রয়োদশ কিস্তি।
সি এস দাগ নং ৫৮৫-এর উপর তিন গম্বুজওয়ালা যে স্থাপত্যটি দীর্ঘদিন দণ্ডায়মান ছিল তা জাহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবরের নামাঙ্কিত। মসজিদের দালানের এককোণে একটি প্রস্তর ফলকের গায়ে ফার্সি ভাযায় যুগ্মাকারে তিন ছত্রের বয়ান আছে :
‘বা ফারমুদা-ই-শাহ বাবর কি আদিলাশ বানাইসত তা কাখ-ই গরদুন মুলাকি বানা করদ-ই মুহবিত-ই-কুদসিঁয়া আমির-ই-সাআদাত নিশাঁ মীর বাকী বুঅদ খয়ের বাকি চৌসাল-ই-বানাইশ ইঁয় শুদ কি-গুফতম বুঅদ খয়ের বাকি’।
যার অর্থ :
‘৯৩৫ হিজরীতে (১৫২৯ খ্রিঃ)শেয হয়েছে মসজিদটির নির্মাণ কার্য। যাঁর ন্যায়পরতা মহিমায় মহিমান্বিত সেই আদিল শাহ বাবরের নির্দেশে ফেরেশতাতুল্য সুজন মীর বাকী তৈরি করেছেন এই সৌধ। চিরকাল টিকে থাকবে তাঁর মাহাত্ম্য’।
মসজিদের তিনটি গম্বুজ মাথায় তুলে রেখেছে আঁটোসাঁটো ইঁটের স্তম্ভ। স্তম্ভের গায়ে মন্দিরের শৈলী, যা শিল্পের ইতিহাসে শারকী স্থাপত্যরীতি নামে খ্যাত। জৌনপুরে শারকী রাজাদের আমলে ভারত ও আরব স্থাপত্যরীতির যে অদ্ভুত সমন্ব্য় ঘটেছিল, এ মসজিদ তারই নজির। শারকী রাজারা যে কোন স্থাপত্য নির্মাণে হিন্দু-মুসলমান রাজমিস্ত্রিদের কাজে লাগাতেন। কেবলমাত্র স্তম্ভের গায়ে নয়, মসজিদের দেওয়ালেও আছে শারকী মিশ্ররীতির নিদর্শন।
অবশ্য তিনটি স্তম্ভ ও দেওয়ালের দু-এক জায়গা ব্যতীত অন্যত্র মিশ্ররীতির নিদর্শন নেই। মেহরাবটি অভিনব। এর একপাশে দেওয়ালে উৎকীর্ণ আছে কলমা।
মসজিদে ওঠা-নামার সিঁড়ি নেই। পা বাড়ালেই সমতল ছোট ইটের অনুচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত দালান। ভেতরে প্রবেশের প্রধান দরজা দুটি। বেশ চওড়া দরজা দুটিকে ধরে রেখেছে দেওয়াল সমেত এককটি স্তম্ভ। তার গায়ে উৎকীর্ণ আছে কোরানের আয়াত। পাশে ফার্সিভাযায় এক কবিতা। এর অল্প দূরে দালানের এক কোণে এক প্রস্তর ফলক। ফলকের গায়ে ফার্সি লিপিতে উৎকীর্ণ ফলক, যার কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। (মন্দিরের মানুষ মানুষের মসজিদ / মহম্মদ বরজাহান / পৃঃ ৬৬)।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় এর স্থাপত্যরীতি সম্পর্কে লেখা আছে, ‘The mosque was constructed in a style developed under short-lived Lodi dynasty that preceded Mughals : small with a single aisle arrangement of three domes bays along the wall of the quiblah . The gateway of the middle bay—a pishtaq emphasizing the buildings presence and importance—was considerably than those of the side bays.’
মসজিদের পার্শ্ববর্তী দেওয়ালগুলির খাঁজ অনুনাদক হিসেবে কার্যকরী। এতে ব্যবহৃত হয়েছে বেলেপাথর, যা শব্দ-নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর এই বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। কাজটা সহজ ছিল না। প্রত্যেকটি কঠিন কাজে সফল হতে গেলে পর্যাপ্ত অনুশীলন, সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও অধ্যবসায় প্রয়োজন। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার জন্যও সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও অধ্যবসায় যে ছিল, তার কয়েকটি প্রমাণ :
ক] মধ্যপ্রদেশের বজরং দলের প্রাক্তন বিধায়ক ধর্মেন্দ্র গুর্জরের মতে মসজিদ ধ্বংসের জন্য ১২০০ জনকে নিয়ে এক সুইসাইড স্কোয়াড গঠিত হয়েছিল। সৈনিকদের মতো এদের শিক্ষা দেওয়া হত।
খ] উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন শিবসেনা নেতা পবনকুমারের মতে এটা পূর্বপরিকল্পিত এবং এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি ও উমা ভারতী। ৫ ডিসেম্বর রাতের বেলায় গোপন মিটিং হয় পরের দিনের কাজের।
গ] ২০০৫ সালের ৩০ জানুয়ারি ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর প্রধান মলয়কৃষ্ণ ধর তাঁর লেখা একটি বইতে বলেন যে ১০ মাস আগেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিজেপি, আরএসএস, ভিএইচপি নেতারা ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় প্রলয় নৃত্যের নীল নকশা তৈরি করেছিলেন। শ্রীধর জানিয়েছেন তিনি ভারতীয় জনতা দল ও সংঘ পরিবারের একটি বৈঠকে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। সেখানেই প্রলয় নৃত্যের নীল নকশা তৈরি করা হয়। তিনি সে বৈঠকের কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন।
ঘ] কোবরাপোস্ট একটি ওয়েব পোর্টাল। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে এতে ‘ অপারেশন জন্মভূমি’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে ১৯৯০ সালে অযোধ্যায় করসেবকদের উপর গুলি চালনার কথা আছে। আপাতভাবে গুলি চালনার দায়িত্ব বর্তেছিল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুলায়ম সিং যাদবের সরকারের উপর। কিন্তু কোবরাপোস্টকে আচার্য ভামদেব বলেছিলেন যে মানুষের মৃত্যু না হলে আন্দোলন গতিবেগ পায় না। মুলায়ম গুলি চালনার হুকুম দিয়েছিলেন কিনা সে প্রশ্নে ভামদেব বলেন যে মুলায়ম নয়, গুলি চালিয়েছিল আমাদের লোক; তাদের নাম আমি বলব না, কারণ তারা আমাদের আন্দোলনের পরিচালক। ‘ যিনি গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছিলেন তিনি মুলায়ম সিং নন। বরং তার আদেশদাতা আমাদেরই লোক। যেহেতু তাঁরা আমাদের নের্তৃস্থানীয় তাই আমি তাঁদের নাম উচ্চারণ করব না।’
প্রতিবেদনটি জানিয়েছে যে তাঁদের প্রতিবেদক ২ বছর ধরে ২৩ জন নেতার কথোপকথন রেকর্ড করে রেখেছেন। গোপন সভায় বাবরি মসজিদ ধ্ংস করার পরিকল্পনা করা হয়। এল কে আদবানি, মুরলিমনোহর যোশী, অশোক সিঙঘল প্রমুখ নেতারা সভায় ছিলেন। মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার শপথ গ্রহণ করা হয়। এসব বিষয়ে অবগত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ঙ] প্রখ্যাত ফটোজার্নালিস্ট প্রভিন জৈনের মতে কেবলমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রযুক্তি বিষয়ে অবগত কর্মীরাই এভাবে ধ্বংস করতে পারে। মুখোশপরা মানুষরা বিষয়টি পরিচালনা করছিলেন। পূর্বপরিকল্পনা নিশ্চয়ই ছিল।
প্রভিন জৈন ৫ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মহড়া দেখেছিলেন, তার ফটোও তুলেছিলেন। তিনি বলেছেন :
১৯৮৭ সালে আমি পাইওনিয়র পত্রিকায় যোগ দিই। পত্রিকার তরফে আমি কয়েক বছর অযোধ্যা আন্দোলন কভার করেছি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের আগে আমি বার কয়েক সেখানে গিয়েছিলাম। সুতরাং পরিবেশটা আমার চেনা ছিল। পত্রিকা সম্পাদক আমাকে ৪ ডিসেম্বর অযোধ্যা যেতে বলেন। তদনুযায়ী আমি ৪ তারিখে অযোধ্যা চলে যাই। উঠি একটা হোটেলে। পরের দিন সে হোটেলে অন্যান্য সাংবাদিকরাও উঠেছিলেন। চারপাশের ঘটনা দেখে আমার কেমন যেন মনে হয়, শুধু আন্দোলন নয়, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পরিকল্পনা আ্ছে। সেদিন এক প্রেস কনফারেন্সে আমরা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিংঘলকে তাঁদের পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি ধূর্ত হাসি হেসে বলেন, অপেক্ষা করুন আর দেখতে থাকুন।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা বি এল শর্মার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। তাঁর সঙ্গে ৪ ডিসেম্বর দেখা করতে তিনি বলেন, আগামী কাল আমার সঙ্গে দেখা করুন ; আপনাকে একটা অভিনব জিনিস দেখাব।
শর্মা আমাকে সমাবেশের ভেতরে ঢোকার জন্য একটা পরিচয় পত্র দিলেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পরিচয়পত্র। যেন আমি তাঁদের ফটোগ্রাফার।
৫ ডিসেম্বর গিয়ে দেখি পরের দিন অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর কিভাবে বাবরি মসজিদ ভাঙা হবে তার মহড়া চলছে। সেখানে অন্য কোন সাংবাদিক বা ফটোগ্রাফার ছিলেন না। আমি অবাক হয়ে সেই মহড়া দেখেছি। শর্মার পাশে দাঁড়িয়ে মহড়ার ফটো তুলেছি। কেউ কিছু বলে নি বা সন্দেহ করে নি।
সন্ধেবেলা সান-ই-আওধ হোটেলে ফিরে অন্য সাংবাদিকদের যখন আমার সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা বললাম, তাঁরা কেউ বিশ্বাস করলেন না। পাইওনিয়ার পত্রিকা সম্পাদক বিখ্যাত বিনোদ মেহেতাও বিশ্বাস করেন নি। পরের দিন আমার কথা যখন অক্ষরে অক্ষরে সত্য হল তখন সম্পাদক বললেন ৫ডিসেম্বরে আমি মহড়ার যে ছবি তুলেছি, তা যেন যত্ন করে রেখে দিই ; অনুকূল সময়ে তা প্রকাশ করা হবে।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct