নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আট বছর পূরণ করেছেন এবং ভারত যখন তার স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপনের নিবেদিত প্রাণ, তখন মোদির শক্তিশালী নির্বাচনী প্রভাব তাঁকে প্রায়-অজেয় নেতা হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু তুমুল জনপ্রিয় এই নেতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিকৌশল অতিশয় আবেগনির্ভর ও মূর্খতাপূর্ণ, যা ভারতের শাসনব্যবস্থার জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনছে। বর্তমান ভারতের ভবিষ্যৎ পরিণতি বিশ্লেষণ করেছেন শশী থারুর। আজ প্রথম কিস্তি।
নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আট বছর পূরণ করেছেন এবং ভারত যখন তার স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপনে নিবেদিত প্রাণ, তখন মোদির শক্তিশালী নির্বাচনী প্রভাব তাঁকে প্রায়-অজেয় নেতা হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু তুমুল জনপ্রিয় এই নেতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিকৌশল অতিশয় আবেগনির্ভর ও মূর্খতাপূর্ণ, যা ভারতের শাসনব্যবস্থার জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা তছনছ হওয়ার পর গত মে মাসে মোদির সরকার ঘোষণা করেছিল, ভারত আগে যে পরিমাণ গম রপ্তানি করত, তার চেয়ে বেশি রপ্তানি করে ‘বিশ্বকে খাওয়াবে’। কিন্তু সে ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিন যেতেই মোদি সরকারের সুর একেবারে উল্টে যায়। খাদ্যের দাম দ্রুতই বেড়ে যায়। এ ছাড়া সেনাবাহিনীতে পেনশন সুবিধাসহ গ্যারান্টিযুক্ত দীর্ঘমেয়াদি নিয়মিত চাকরির স্থলে চার বছরের চুক্তিতে অস্থায়ী সেনা নিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর সারা দেশে তরুণেরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং প্রতিবাদে তাঁরা রাজপথে নেমে পড়েন।
এ সিদ্ধান্তগুলো শুধু ভারতের বিভক্তিতে ভরা রাজনীতিতে মোদির অস্বাভাবিক আধিপত্যকেই নয়, এগুলো তাঁর নিজের মুঠোয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার বিষয়টিকেও চিত্রিত করে। মোদি একটি সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার চালাচ্ছেন বটে, কিন্তু তা একেবারেই কাগজে-কলমে। আদতে তিনি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় সবকিছু চালাচ্ছেন। একটি স্বাধীন আইনসভাকে সামনে রেখে কার্যত একজন প্রেসিডেন্টের মতো নিরঙ্কুশ শক্তিশালী নির্বাহী ক্ষমতায় তিনি সবকিছু চালাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত মোদি সরকারের সবচেয়ে নাটকীয় সিদ্ধান্তগুলোর দিকে নজর বোলালে দেখা যাবে, তিনি ২০১৬ সালে রাতারাতি ভারতের ৮৬ শতাংশ ব্যাংক নোট বাতিল করেন; কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলার পদক্ষেপ হিসেবে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন দেন, যা গোটা দেশবাসীর জন্য মহাদুর্ভোগ নিয়ে আসে; এ ছাড়া তিনি ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অব কন্ট্রোল) ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’–এর নির্দেশ দেন। এ তিন সিদ্ধান্তই মোদি এবং তাঁর মুষ্টিমেয় অনির্বাচিত উপদেষ্টারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই গ্রহণ করেছিলেন। অথচ সংসদীয় ব্যবস্থায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত একমাত্র মন্ত্রিসভাই নেবে—এমনটাই প্রত্যাশা করা হয়ে থাকে। ঠিক একই কায়দায় মোদি সরকার আরও তিনটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেগুলো হলো কৃষি ও খামার সংস্কার আইন আরোপ করা, জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার এবং জাতীয় নাগরিকত্ব নিবন্ধন (এনআরসি) তৈরির জন্য একটি প্রচারাভিযান চালু ও তা পরে স্থগিত করা।
এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনসভার কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। এমনকি মোদির বিশ্বস্ত এমপিদেরও কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। ভারতে একটি ফেডারেল সরকারব্যবস্থা জারি থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারগুলোকে এসব বিষয়ে আগে থেকে কিছু জানানোও হয়নি। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বুট্রোস বুট্রোস ঘালি একবার একটি গোপন কার্যক্রমকে ‘ঘাপটি মারা ও অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়া’ কৌশল বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। মোদির নেতৃত্বের ধরন অনেকটা সে রকম। তিনি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই তিনি এই চর্চা করে আসছেন। সে সময় তিনি সুবিদিতভাবে তাঁর মন্ত্রিসভাকে পাশ কাটিয়ে অনির্বাচিত কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বিশ্বস্ত গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। তখন থেকেই তিনি রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের প্রতি বেশি বিশ্বাস দেখিয়ে আসছেন। সংসদীয় ব্যবস্থার স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতার কোনোটিই মোদিকে তাঁর কোনো কাজে বাধা দিতে পারে না। ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় তাঁর শক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এবং সে কারণেই আইন প্রণয়নের চুক্তিতে পৌঁছাতে তাঁর সময় নষ্ট করার প্রয়োজন হয় না। তাঁর মন্ত্রিসভার বৈঠকগুলোয় ‘একমুখী যোগাযোগ’ এবং ‘টপ-ডাউন’ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুশীলন চলে। মন্ত্রীরা চাহিদা অনুযায়ী উপস্থাপনা ও প্রস্তাবনা দেন এবং কখনোই প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করেন না। ক্ষমতাসীন বিজেপির শরিক দলগুলোর গুটিকয় প্রতীকী কেবিনেট মন্ত্রী আছেন। পার্লামেন্টে তাঁদের কর্তৃত্ব খুবই কম এবং তাঁরা নিজেরাও জানেন, তাঁরা নিষ্ক্রিয়, কারণ মোদি পার্লামেন্টে নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে তাঁদের ওপর মোটেও নির্ভর করেন না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct