আপনজন ডেস্ক: হরিয়ানার নুহ থেকে শুরু হয়ে রাজ্যের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় গুরুগ্রামে এখন চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। হিন্দুত্ব বাহিনীর লোকজন বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুসলিমদের এলাকা ছাড়ার কথা বলছে। এর ফলে মহা বিপদে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেখানে যাওয়া পরিযায়ী মুসলিম শ্রমিকরা। গুরুগ্রামে আবাসন শিল্প আর বিভিন্ন হাসপাতাল সহ নানা সংস্থায় ঠিকা কর্মীর কাজ করতে পশ্চিম বাংলা থেকে প্রায় একশোটি মুসলিম পরিবার ঠিকানা করে নেয়। কিন্তু নুহ জেলার ঘটনার জেরে গুরুগ্রমে থাকা সেই সব পরিবারকে গত কয়েকদিন ধরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের কর্মীরা হুমকি দিয়ে যাচ্ছে এলাকা ছেড়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য। ইতিমধ্যে হামলার আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গের ১০০টিরও বেশি মুসলিম পরিবারের মধ্যে বেশিরভাগ পরিবার বাড়ি ফিরে গেছে। তবু মাত্র ১৫ টি এখনও রয়ে গেছে,। তাদের কাছে বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি ভাড়া না থাকায় আটকে রয়েছেন। তার মধ্যে তাদেরকে ক্রমাগত বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফলে তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন গুজরান করছে। জানা যাচ্ছে এইসব পরিযায়ী শ্রমিকদের বেশিরভাগই এসেছেন মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে। তারা ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছে জীবন সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন। গুরুগ্রামের ডেপুটি কমিশনার নিশান্ত যাদব জানিয়েছেন, জেলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছি এবং আস্থা তৈরির পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমি তাদের সুরক্ষার আশ্বাস দিতে চাই।দিল্লি থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে হরিয়ানার নুহে দাঙ্গায় সোমবার থেকে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। ভিএইচপি এবং বজরং দলের একটি ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে গুরুগ্রাম সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। তার জেরে গুরুগ্রামে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের অবিলম্বে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার নিদান দেওয়া হয়েছে। আর বাইরে বের হলেই মুসলিম পরিচয় জানতে পারলে তাদেরকে হামলার শিকার হতে হচ্ছে। তারা যে চরম আতঙ্কে রয়েছেন সেই চিত্রা তুলে ধরছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। নিউজ চ্যানেল এনডি টিভির সাংবাদিককে এক পরিযায়ী শ্রমিক বলেন, আমার এক বছরের ছেলের নাম আলিশান। আমি ভয় পাচ্ছি যে তারা এসে আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে মারধর করবে। আমার ছেলে এটি দেখে কাঁদবে। আমার স্ত্রীও ভয় পাচ্ছে এবং গত দুই রাত ধরে কাঁদছে। আমরা ফিরে যেতে পারছি না কারণ আমাদের কাছে কোনো টাকা নেই। আমরা কীভাবে বাঁচব, তিনি সেই প্রশ্ন তোলেন। আরেক বাসিন্দা বলেন, এটা হিন্দু বা মুসলমানদের বিষয় নয়। যারাই সহিংসতায় লিপ্ত, তারাই দায়ী। কিন্তু আমাদের মতো গরীব মানুষ এর মূল্য পরিশোধ করছে। আমরা দিনমজুর এবং আমরা কাজে যাওয়ার জন্য এলাকা ছেড়ে যেতে পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।গুরুগ্রামের জেলা কমিশনার এর আগে বলেছিলেন যে পরিস্থিতি এখন শান্তিপূর্ণ এবং আগামীকাল শহরে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকতা ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।পরে নিজের ঘরে বসে এনডিটিভির সঙ্গে কথা বলার সময় ২৫ বছর বয়সি শামীম হুসেন বলেন, জীবিকার তাগিদে বাংলা থেকে গুরুগ্রামে আসার পর মাত্র সাত দিন হয়ে গেছে। মাত্র দু’দিন আগে তিনি ফুড ডেলিভারি এজেন্টের চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু এখনও বেতন পাননি।
অশ্রুসজল চোখে হাত জোড় করে তিনি অনুরোধ করেন, গতকাল সন্ধ্যায় কিছু লোক এসে সমস্ত মুসলমানকে চলে যেতে বলেছিল। আমাদের কাছে ফিরে যাওয়ার মতো অর্থ নেই এবং এমনকি স্থানীয় দোকানদারদের কাছে ঋণও রয়েছে। পরিশোধ করার মতো অর্থ নেই। আমার যদি কিছু হয় তবে ঠিক আছে, তবে আমার এক বছরের একটি ছেলে রয়েছে। সরকার, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে আমার আন্তরিক অনুরোধ আমাদের রক্ষা করার জন্য। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন’। এর আগে গুরুগ্রামের জেলা কমিশনার আশ্বাস দিয়েছিলেন যে পরিযায়ী পরিবারগুলিকে সুরক্ষিত করা হবে। তিনি বলেন, সংবেদনশীল এলাকা এবং উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থান - মসজিদ এবং মন্দিরের আশেপাশে রাতারাতি পুলিশ মোতায়েন করা হবে। ওই সব পরিযায়ী শ্রমিকরা বলছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রায় ৬০ জন লোক শহরের কয়েকটি অভিজাত ভবনের ঠিক পাশে অবস্থিত ওই এলাকার এক বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে নির্দেশ দেন, দুই দিনের মধ্যে সব মুসলিম পরিবারকে চলে যেতে বলুন। এলাকার লোকেরা জানত যে হুমকিটি কোনও ফাঁকা হুমকি নয়, কারণ মঙ্গলবার বিকেলে এক গৃহকর্মীকে তার নাম জিজ্ঞেস করে মুসলিম পরিচয় পাওয়ায় তাকে মারধর করেছিল। এলাকার একটি হাউজিংয়ের তদারকি করা এবং তার জন্য ৩০ জনকে নিয়ে কাজ করতে আসা কর এক ব্যক্তি বলেন, আজ মাত্র চারজন লোক কাজ করতে এসেছিল। এখানে কাজ করা এক ব্যক্তি রাস্তায় ভ্রমণ করছিলেন যখন জনতা তাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করেছিল। তিনি উত্তর দিতেই তাকে মারধর করা হয়েছিল। আমরা তাকে এখানে নিয়ে এসে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি। তিনি আজ সকালে পশ্চিমবাংলায় নিজের গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। আমরাও ভয় পাচ্ছি। আমরা রাস্তায় বের হলে কেউ আমাদের মারধর করবে। আমরা কিছুই করতে পারি না কারণ আমাদের গ্রাম অনেক দূরে, পশ্চিমবঙ্গে। আপনি যদি আমাদের সাহায্য করতে পারেন তবে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব, এই আর্জি জানান সাংবাদিকের কাছে। তবে এনডিটিভির সাংবাদিক যখন এই সব পরিবারের সঙ্গে কথা বলছিলেন সেই সময়, মোটরসাইকেলে করে দু’জন এসে মুসলিম বাসিন্দাদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে এনডিটিভি জানিয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct